যুক্তি তর্ক গল্প-কোরবানির সূত্র ধরে অর্থনীতির হালহকিকত by আবুল মোমেন
একজন সফল মন্ত্রী এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি এই তিন সূত্রে জানা গেল এবার সারা দেশে গরু কোরবানি হয়েছে ৪০-৪৫ লাখ আর ছাগল ২০-২৫ লাখ। অর্থা ৎ রক্ষণশীল হিসেবে ধরা যায় গরু ৪০ লাখ ও ছাগল ২০ লাখ।
একটি গরুর যেহেতু সাত ভাগ হয় তাই ধরা যাক প্রতি গরু অন্তত দুই পরিবারে মিলে কোরবানি দিয়েছে। এতে যে কিছু পরিবার একাই দু-তিনটি গরু কোরবানি দেয় তারাও হিসাবের মধ্যে এসে যাবে। কারণ এ রকম পরিবারের সংখ্যা বেশি নয়। আর খাসি ধরা যাক ২০ লাখ পরিবার দিয়েছে। যেসব পরিবার গরুর পাশাপাশি খাসিও দেয় তাদের সংখ্যাও খুব বেশি নয়। এ হিসাব অনুযায়ী দেশে এক কোটি পরিবার এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানি দিয়েছে। প্রতি পরিবারে গড়ে পাঁচজন করে সদস্য ধরলে বলা যায় পাঁচ কোটি মানুষ এ বছর কোরবানি দিয়েছে। এ ছাড়া হজে অংশগ্রহণকারী লক্ষাধিক মানুষকেও হিসাবে ধরলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। এই হিসাবের ভিত্তিতে দেশের অর্থনীতি যে ভালোই আছে সে কথাটিই মাননীয় মন্ত্রী তুলে ধরতে চেয়েছেন।
এর সঙ্গে গরু-ছাগলের খামারি ও ব্যবসায়ীসহ যাঁরা কোরবানি-সংশ্লিষ্ট নানা ব্যবসায় জড়িত ছিলেন তাঁদের আলাদা করে ধরছি না, কারণ তাঁদের হিসাব কোরবানিদাতাদের মধ্যেই আছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
এর বাইরে দেশের হিন্দু সম্প্রদায় দুর্গাপূজার নবমীর দিনে, কালীপূজায় ছাগল বলি দিয়ে থাকে। অনেক অঞ্চলে পাঁঠাবলিসহ মনসাপূজা উদ্যাপনের রেওয়াজ বেশ জনপ্রিয়। আজকালকার বাজারে ছাগলও অত্যন্ত দামি প্রাণী। ফলে জনসংখ্যার সংখ্যালঘু অংশেও মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে—এমনটা বলা যায়।
অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত আমরা আরও নানা ক্ষেত্র থেকে পেয়ে থাকি। একসময় দেখেছি ছোট দোকানদার ও মিস্ত্রি-মজুরেরা নামাজের পরই দোকান খুলে বসতেন বা কাজে যোগ দিতেন। ইদানীং দোকানপাট বেশ কদিন বন্ধ থাকে। মিস্ত্রি-মজুরেরা ঈদের পরে কবে ফিরবে সেটা নিয়ে ভুক্তভোগীদের পেরেশানির কথা সবাই জানি। এর অর্থ তারা ব্যবসা ও কাজ কদিন বন্ধ রাখার মতো সামর্থ্য অর্জন করেছেন।
অর্থনীতির এই সরল সমীকরণটি সত্যিই ধোপে টিকবে কি না সেটা হয়তো ঝানু অর্থনীতিবিদেরা ভালোই বলতে পারবেন। এ কথা আমরা সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই জানি যে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ইদানীং ভয়ানক আকার নিচ্ছে, দেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনক হারেই বেশি এবং তা ছাড়া দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা (৩১.৫ শতাংশ) এখনো দারিদ্র্যরেখার নিচে, যা হতাশাব্যঞ্জক।
কোরবানির প্রসঙ্গে অন্য আরেকটি কথা সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনার জন্য তোলার আগে একটু ভণিতা করে নিতে চাই। আমরা সবাই বলি এবং জানি যে অনেক দেশ অনেক পেছন থেকে এসে উন্নয়নের ধারায় আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। মাস খানেক আগে এই কলামেই আমি লিখেছিলাম, এককালের পশ্চা ৎ পদ থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কীভাবে আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। মোদ্দাকথা, এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে কোনো আলাদিনের চেরাগের ভূমিকা নেই। তারা যে আকস্মিকভাবে ধনদৌলত পেয়ে গেছে তাও নয়। তারা একভাবে সুশাসন, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও কার্যকর শাসনব্যবস্থা চালু করতে ও রাখতে পেরেছে। এটা পারার পেছনে একটি কারণ হলো তারা ব্যক্তিগত লক্ষ্য পূরণের বিচ্ছিন্ন একক কোনো এজেন্ডাকে অগ্রাধিকার দেয়নি। একটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও পদ্ধতির ভেতরে থেকে কাজ করে নিজের উন্নতি করার অর্থ হলো অন্য দশজনের তথা দেশেরও উন্নতি করা।
কিন্তু আমরা কী করছি? আমরা সবকিছুর আগে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলকে গুরুত্ব দিচ্ছি। তাতে যে ক্ষমতাবান সে অন্যদের পেছনে ফেলে, দাবিয়ে রেখে, বঞ্চিত করে নিজেই সবটা পেতে চায় ও তা করতে পারে। এভাবে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার এক অসুস্থ ভয়ংকর প্রক্রিয়া এ সমাজে চালু হয়েছে। এরই ফলে জমি দখল, টেন্ডার দখল, পদ দখলকে কেন্দ্র করে খুনাখুনি, বংশপরম্পরায় শত্রুতাসহ প্রতিশোধের এক ভয়ংকর কালচার দেশে তৈরি হতে দেখছি।
এই মানসিকতা যখন সমাজে জাঁকিয়ে চলে তখন ধর্মেরও মূল শিক্ষা ও প্রেরণাকে পাশে সরিয়ে রেখে লোকদেখানো আচার পালন ও জাঁকজমকে নিজ নিজ অবস্থান, ক্ষমতা-বৈভব দেখানোর দিকেই ঝোঁক বাড়ছে। আমি জানি সব মানুষই এ রকম নন। অনেকেই ধর্মের মূল শিক্ষা ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। কিন্তু ক্রমেই সমাজের অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে বোঝা যায় তাঁরা এ সমাজে এ কালে মুষ্টিমেয় সংখ্যালঘু। টুকরো টুকরো চিত্র থেকে এটা বোঝা যায়। শিক্ষা তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে, কারণ, ক্ষমতাবান-বিত্তবানদের দৌরাত্ম্যে দিনে দিনে কোচিং ব্যবসা বা নোট ব্যবসা কেবল বেড়েই চলেছে।
আবার আমরা যেন বুঝেই অস্বাস্থ্যকর খাবার খাই। এ দেশে বিয়ের অনুষ্ঠান এখন মুখ্যত খাওয়ার অনুষ্ঠান, খাবারটি যত সুস্বাদুই হোক অভ্যাগতদের শতকরা আশিজনের জন্য শুধু অস্বাস্থ্যকর নয়, তাদের প্রাণের জন্যও হুমকিস্বরূপ। বলতেই হবে অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে, নয়তো এ ধরনের বিশাল আয়োজন, বিপুল খাওয়ার ব্যবস্থা দিনে দিনে বাড়ছে কেন।
মনে হয় জাতিটা কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবে না, গা ভাসিয়ে চলছে। নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনছে। এই যে প্রকাশ্যে খোলা জায়গায়—শহরে প্রায়ই রাজপথে—একটা আস্ত গরু জবাই করা হয় তা কি নাগরিক জীবনের জন্য ঠিক হচ্ছে? অনেকেই সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক ঘুরে এসে আফসোস করে বলেন তাদের রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতার কথা, প্রকাশ্যে রাস্তাঘাটে থু থু কফ ফেলে না কেউ, ফেললে জরিমানা গুনতে হয় ইত্যাদি। কিন্তু সেই সব মানুষই অবলীলায় রাস্তায় বা উন্মুক্ত স্থানে দিব্যি কোরবানির গরুটি জবাই করেন।
যারা আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে তারা এ রকম কাণ্ড ভাবতে পারবে? খোদ সৌদি আরবে কি এমনটা হয়? হজের সময় তো কম করে ২৫ লাখ পশু কোরবানি দেন হাজিরা। সেগুলো কি তাঁরা এভাবে যত্রতত্র জবাই করতে পারেন? না, সবই সুষ্ঠুভাবে শৃঙ্খলার মাধ্যমে করার ব্যবস্থা তারা করেছে। অব্যবস্থার মধ্যে ২৫ লাখ পশু কোরবানি হলে কী হতো ভাবা যায়? আপনি নির্দিষ্ট টাকা, নাম জমা দেবেন, মাংস চাইলে পরিমাণমতো তাও পাবেন, বাকি কাজ নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট স্থানে করবেন। নিজ হাতে কোরবানি দিতে চাইলে সম্ভবত তার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু অব্যবস্থার মধ্যে কোনো কাজ হচ্ছে না।
আমরা কেবল করপোরেশনকে বলি তিন দিনের মধ্যে ময়লা সাফ করতে হবে, আর কোনো চাহিদা আমাদের নেই। আমরা কি রাস্তাজুড়ে গরু জবাই করা, রক্তে রাস্তা নালা ভেসে যাওয়া, বাসি রক্তের গন্ধে কদিন ধরে বাতাস ভারি হওয়া অনুমোদন করব? যদি তা-ই করি তাহলে পরিচ্ছন্ন ও শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা চালু করা কঠিন হবে।
আগে মানুষ ছিল কম। বছরে একবার যেটুকু জবাইয়ের কাজ হতো তা চোখে পড়ার মতো ছিল না। কিন্তু আজ মানুষ বেড়েছে। প্রত্যেকের নিজস্ব উঠান নেই যে নিজের মতো করে আড়ালে কোরবানি করে ফেলব। তা ছাড়া নানা কারণে সারা বিশ্বে সহিংসতা বাড়ছে। আমাদের দেশে জবাই করে হত্যা, চাপাতি-চায়নিজ কুড়ালের কোপে হত্যা, পিটিয়ে হত্যা, এমনকি—ভিডিও ফুটেজে দেখেছি—প্রতিপক্ষের একজনকে অন্য পক্ষ তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করছে নিষ্ঠুরভাবে। কোনো দেশ, সৌদি আরবও নয়, তার নাগরিকদের, বিশেষত শিশু-কিশোরদের এভাবে প্রাণী জবাইয়ের দৃশ্য দেখতে দেয় না। তাদের অংশগ্রহণ করানো দূরের কথা।
মানুষ কোরবানি দেবে, বিষয়টি ধর্মীয়। আমি যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইছি তা হচ্ছে, কোরবানি কীভাবে আমরা সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করব তা নিয়ে। জনজীবনকে ব্যাহত না করে এবং শিশু-কিশোর ও সাধারণ নাগরিককে এ প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রেখে কীভাবে কাজটা সুসম্পন্ন করব তা ভাবতে বলব। সৌদি আরব এ ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমরা সৌদি আরবের প্রকাশ্যে অপরাধীর শিরশ্ছেদের মতো বর্বর প্রথার সমালোচনা অবশ্যই করব, আবার সেই সঙ্গে বিপুল কোরবানি ব্যবস্থাপনার দক্ষতার প্রশংসাও করব।
মনে রাখতে হবে কোরবানির মূল চেতনা কিন্তু ত্যাগের। আমরা মুখেই একথা বলে কার্যত ভোগেই তা সম্পন্ন করছি কি না ভাবতে হবে। একথাটা বলছি এ কারণে যে কোরবানির পশুটি কীভাবে বিতরণ ও ভোজন করা হবে তা নিয়ে ভাবনা-পরিকল্পনা কিছু থাকলেও সেটি কীভাবে জবাই, কাটাকুটি হবে তা নিয়ে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা আমাদের নেই।
মনে রাখবেন পঞ্চাশের দশকেও সৌদি মানুষ এ দেশে মিসকিন হিসেবে আসত, এখন উল্টো তারাই আমাদের মিসকিন ডাকে। এর সবটাই তেলের তেলেসমাতি নয়। এলেমেরও কিছু জোর আছে, যা তারা হজ-কোরবানির ব্যবস্থাপনায় দেখাচ্ছে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
এর সঙ্গে গরু-ছাগলের খামারি ও ব্যবসায়ীসহ যাঁরা কোরবানি-সংশ্লিষ্ট নানা ব্যবসায় জড়িত ছিলেন তাঁদের আলাদা করে ধরছি না, কারণ তাঁদের হিসাব কোরবানিদাতাদের মধ্যেই আছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
এর বাইরে দেশের হিন্দু সম্প্রদায় দুর্গাপূজার নবমীর দিনে, কালীপূজায় ছাগল বলি দিয়ে থাকে। অনেক অঞ্চলে পাঁঠাবলিসহ মনসাপূজা উদ্যাপনের রেওয়াজ বেশ জনপ্রিয়। আজকালকার বাজারে ছাগলও অত্যন্ত দামি প্রাণী। ফলে জনসংখ্যার সংখ্যালঘু অংশেও মানুষের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে—এমনটা বলা যায়।
অর্থনৈতিক অবস্থার কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত আমরা আরও নানা ক্ষেত্র থেকে পেয়ে থাকি। একসময় দেখেছি ছোট দোকানদার ও মিস্ত্রি-মজুরেরা নামাজের পরই দোকান খুলে বসতেন বা কাজে যোগ দিতেন। ইদানীং দোকানপাট বেশ কদিন বন্ধ থাকে। মিস্ত্রি-মজুরেরা ঈদের পরে কবে ফিরবে সেটা নিয়ে ভুক্তভোগীদের পেরেশানির কথা সবাই জানি। এর অর্থ তারা ব্যবসা ও কাজ কদিন বন্ধ রাখার মতো সামর্থ্য অর্জন করেছেন।
অর্থনীতির এই সরল সমীকরণটি সত্যিই ধোপে টিকবে কি না সেটা হয়তো ঝানু অর্থনীতিবিদেরা ভালোই বলতে পারবেন। এ কথা আমরা সবাই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকেই জানি যে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ইদানীং ভয়ানক আকার নিচ্ছে, দেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনক হারেই বেশি এবং তা ছাড়া দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা (৩১.৫ শতাংশ) এখনো দারিদ্র্যরেখার নিচে, যা হতাশাব্যঞ্জক।
কোরবানির প্রসঙ্গে অন্য আরেকটি কথা সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনার জন্য তোলার আগে একটু ভণিতা করে নিতে চাই। আমরা সবাই বলি এবং জানি যে অনেক দেশ অনেক পেছন থেকে এসে উন্নয়নের ধারায় আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। মাস খানেক আগে এই কলামেই আমি লিখেছিলাম, এককালের পশ্চা ৎ পদ থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো কীভাবে আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। মোদ্দাকথা, এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে কোনো আলাদিনের চেরাগের ভূমিকা নেই। তারা যে আকস্মিকভাবে ধনদৌলত পেয়ে গেছে তাও নয়। তারা একভাবে সুশাসন, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও কার্যকর শাসনব্যবস্থা চালু করতে ও রাখতে পেরেছে। এটা পারার পেছনে একটি কারণ হলো তারা ব্যক্তিগত লক্ষ্য পূরণের বিচ্ছিন্ন একক কোনো এজেন্ডাকে অগ্রাধিকার দেয়নি। একটি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও পদ্ধতির ভেতরে থেকে কাজ করে নিজের উন্নতি করার অর্থ হলো অন্য দশজনের তথা দেশেরও উন্নতি করা।
কিন্তু আমরা কী করছি? আমরা সবকিছুর আগে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলকে গুরুত্ব দিচ্ছি। তাতে যে ক্ষমতাবান সে অন্যদের পেছনে ফেলে, দাবিয়ে রেখে, বঞ্চিত করে নিজেই সবটা পেতে চায় ও তা করতে পারে। এভাবে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার এক অসুস্থ ভয়ংকর প্রক্রিয়া এ সমাজে চালু হয়েছে। এরই ফলে জমি দখল, টেন্ডার দখল, পদ দখলকে কেন্দ্র করে খুনাখুনি, বংশপরম্পরায় শত্রুতাসহ প্রতিশোধের এক ভয়ংকর কালচার দেশে তৈরি হতে দেখছি।
এই মানসিকতা যখন সমাজে জাঁকিয়ে চলে তখন ধর্মেরও মূল শিক্ষা ও প্রেরণাকে পাশে সরিয়ে রেখে লোকদেখানো আচার পালন ও জাঁকজমকে নিজ নিজ অবস্থান, ক্ষমতা-বৈভব দেখানোর দিকেই ঝোঁক বাড়ছে। আমি জানি সব মানুষই এ রকম নন। অনেকেই ধর্মের মূল শিক্ষা ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। কিন্তু ক্রমেই সমাজের অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে বোঝা যায় তাঁরা এ সমাজে এ কালে মুষ্টিমেয় সংখ্যালঘু। টুকরো টুকরো চিত্র থেকে এটা বোঝা যায়। শিক্ষা তার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়েছে, কারণ, ক্ষমতাবান-বিত্তবানদের দৌরাত্ম্যে দিনে দিনে কোচিং ব্যবসা বা নোট ব্যবসা কেবল বেড়েই চলেছে।
আবার আমরা যেন বুঝেই অস্বাস্থ্যকর খাবার খাই। এ দেশে বিয়ের অনুষ্ঠান এখন মুখ্যত খাওয়ার অনুষ্ঠান, খাবারটি যত সুস্বাদুই হোক অভ্যাগতদের শতকরা আশিজনের জন্য শুধু অস্বাস্থ্যকর নয়, তাদের প্রাণের জন্যও হুমকিস্বরূপ। বলতেই হবে অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে, নয়তো এ ধরনের বিশাল আয়োজন, বিপুল খাওয়ার ব্যবস্থা দিনে দিনে বাড়ছে কেন।
মনে হয় জাতিটা কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবে না, গা ভাসিয়ে চলছে। নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনছে। এই যে প্রকাশ্যে খোলা জায়গায়—শহরে প্রায়ই রাজপথে—একটা আস্ত গরু জবাই করা হয় তা কি নাগরিক জীবনের জন্য ঠিক হচ্ছে? অনেকেই সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক ঘুরে এসে আফসোস করে বলেন তাদের রাস্তাঘাটের পরিচ্ছন্নতার কথা, প্রকাশ্যে রাস্তাঘাটে থু থু কফ ফেলে না কেউ, ফেললে জরিমানা গুনতে হয় ইত্যাদি। কিন্তু সেই সব মানুষই অবলীলায় রাস্তায় বা উন্মুক্ত স্থানে দিব্যি কোরবানির গরুটি জবাই করেন।
যারা আমাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে তারা এ রকম কাণ্ড ভাবতে পারবে? খোদ সৌদি আরবে কি এমনটা হয়? হজের সময় তো কম করে ২৫ লাখ পশু কোরবানি দেন হাজিরা। সেগুলো কি তাঁরা এভাবে যত্রতত্র জবাই করতে পারেন? না, সবই সুষ্ঠুভাবে শৃঙ্খলার মাধ্যমে করার ব্যবস্থা তারা করেছে। অব্যবস্থার মধ্যে ২৫ লাখ পশু কোরবানি হলে কী হতো ভাবা যায়? আপনি নির্দিষ্ট টাকা, নাম জমা দেবেন, মাংস চাইলে পরিমাণমতো তাও পাবেন, বাকি কাজ নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট স্থানে করবেন। নিজ হাতে কোরবানি দিতে চাইলে সম্ভবত তার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু অব্যবস্থার মধ্যে কোনো কাজ হচ্ছে না।
আমরা কেবল করপোরেশনকে বলি তিন দিনের মধ্যে ময়লা সাফ করতে হবে, আর কোনো চাহিদা আমাদের নেই। আমরা কি রাস্তাজুড়ে গরু জবাই করা, রক্তে রাস্তা নালা ভেসে যাওয়া, বাসি রক্তের গন্ধে কদিন ধরে বাতাস ভারি হওয়া অনুমোদন করব? যদি তা-ই করি তাহলে পরিচ্ছন্ন ও শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা চালু করা কঠিন হবে।
আগে মানুষ ছিল কম। বছরে একবার যেটুকু জবাইয়ের কাজ হতো তা চোখে পড়ার মতো ছিল না। কিন্তু আজ মানুষ বেড়েছে। প্রত্যেকের নিজস্ব উঠান নেই যে নিজের মতো করে আড়ালে কোরবানি করে ফেলব। তা ছাড়া নানা কারণে সারা বিশ্বে সহিংসতা বাড়ছে। আমাদের দেশে জবাই করে হত্যা, চাপাতি-চায়নিজ কুড়ালের কোপে হত্যা, পিটিয়ে হত্যা, এমনকি—ভিডিও ফুটেজে দেখেছি—প্রতিপক্ষের একজনকে অন্য পক্ষ তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করছে নিষ্ঠুরভাবে। কোনো দেশ, সৌদি আরবও নয়, তার নাগরিকদের, বিশেষত শিশু-কিশোরদের এভাবে প্রাণী জবাইয়ের দৃশ্য দেখতে দেয় না। তাদের অংশগ্রহণ করানো দূরের কথা।
মানুষ কোরবানি দেবে, বিষয়টি ধর্মীয়। আমি যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইছি তা হচ্ছে, কোরবানি কীভাবে আমরা সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করব তা নিয়ে। জনজীবনকে ব্যাহত না করে এবং শিশু-কিশোর ও সাধারণ নাগরিককে এ প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রেখে কীভাবে কাজটা সুসম্পন্ন করব তা ভাবতে বলব। সৌদি আরব এ ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আমরা সৌদি আরবের প্রকাশ্যে অপরাধীর শিরশ্ছেদের মতো বর্বর প্রথার সমালোচনা অবশ্যই করব, আবার সেই সঙ্গে বিপুল কোরবানি ব্যবস্থাপনার দক্ষতার প্রশংসাও করব।
মনে রাখতে হবে কোরবানির মূল চেতনা কিন্তু ত্যাগের। আমরা মুখেই একথা বলে কার্যত ভোগেই তা সম্পন্ন করছি কি না ভাবতে হবে। একথাটা বলছি এ কারণে যে কোরবানির পশুটি কীভাবে বিতরণ ও ভোজন করা হবে তা নিয়ে ভাবনা-পরিকল্পনা কিছু থাকলেও সেটি কীভাবে জবাই, কাটাকুটি হবে তা নিয়ে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা আমাদের নেই।
মনে রাখবেন পঞ্চাশের দশকেও সৌদি মানুষ এ দেশে মিসকিন হিসেবে আসত, এখন উল্টো তারাই আমাদের মিসকিন ডাকে। এর সবটাই তেলের তেলেসমাতি নয়। এলেমেরও কিছু জোর আছে, যা তারা হজ-কোরবানির ব্যবস্থাপনায় দেখাচ্ছে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments