যুদ্ধাপরাধের বিচার-কটাক্ষ করা ধৃষ্টতার শামিল

যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবি স্বাধীন-সার্বভৌম রক্তস্নাত বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিক কারণেই গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অভ্যুদয়ের লড়াই-সংগ্রাম, তথা জাতির মুক্তির যুদ্ধে যে নিধনযজ্ঞ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এ দেশের বিরুদ্ধবাদীদের সহায়তায় চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে।


এমন পৈশাচিক, বর্বর নিধনযজ্ঞের বিচার স্বাধীনতা-উত্তর চার দশকেও সম্পন্ন হয়নি। এটি পরিতাপের বিষয় হলেও আশার কথা এই যে বর্তমান সরকার বিলম্বে হলেও গণদাবি আমলে নিয়ে এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে। মহাজোট সরকারের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল এটি। মানুষ যেহেতু ভোটের মাধ্যমে তাদের পক্ষে রায় দিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে, সেহেতু নিঃসন্দেহে বলা যায়, তাদের প্রতিশ্রুত অঙ্গীকার ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার বিকল্প নেই।
যাঁরা একদিন রণাঙ্গনে লড়েছেন এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব তথা সামগ্রিক মুক্তির লক্ষ্যে, তাঁরা যদি সেই অধ্যায় মূল্যবোধ ও চেতনাকে এখনো ধারণ করে থাকেন বলে দাবি করেন তাহলে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করা তাঁদের পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এ প্রক্রিয়াকে প্রহসন বলারও। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ৬ আগস্ট দুপুরে দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত শেষে বলেছেন, এ বিচার প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন মন্তব্য বিদ্যমান বাস্তবতায় এবং তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে অনভিপ্রেত না হলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে তাঁর এই উক্তি স্পষ্টতই ধৃষ্টতার শামিল। শৃঙ্খলমুক্তির লক্ষ্যে এ দেশের লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে, অগণিত মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে আজও সেই দুর্বিষহ অবস্থার ক্ষতচিহ্ন বহন করে চলেছেন। তাঁর এই মন্তব্য জাতির ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতি রীতিমতো কটাক্ষ বললে অত্যুক্তি হবে না। একাত্তর বাঙালি জাতির কাছে দূর অতীত নয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একাত্তর-উত্তর অনেক মুক্তিযোদ্ধার অদল-বদল ঘটলেও বেশির ভাগ মানুষ পরম যত্নে ও মমতায় মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও চেতনা লালন করে চলেছেন। জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তা অপরিহার্যও বটে। এ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা, যাঁদের বেশির ভাগই বয়সের কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, কিংবা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, তাঁদের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে বারবার উপস্থাপন করা হলেও তাঁরা অত্যন্ত সচেতনভাবেই সে বিকৃত বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর এ জন্যই যুদ্ধাপরাধের বিচার গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।
যারা একদিন দেশ-জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শুধু স্বাধীন-সার্বভৌম এই ভূখণ্ড অর্জনেরই বিরোধিতা করেনি, অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই জাতির মেধা-মননসহ সব কিছু ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে, তাদের রাজনৈতিক মিত্র বানিয়ে যে বিপুল ক্ষতি করা হয়েছে, তা পুষিয়ে নেওয়া সহজ নয়। এই প্রেক্ষাপটে তো বটেই, সামগ্রিকতার নিরিখেও যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করা অত্যন্ত জরুরি। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে যাঁরা প্রহসন বলে কটাক্ষ করার ধৃষ্টতা দেখান, তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শ ও দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। সরকার স্বচ্ছতা, গ্রহণযোগ্যতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করে জাতীয় দাবির পূর্ণতা দেবে_এটিই প্রত্যাশিত। যুদ্ধাপরাধের প্রশ্নাতীত বিচার সময়ের গুরুত্বপূর্ণ জনদাবি।

No comments

Powered by Blogger.