ব্রাভো by সুভাষ সাহা

মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসার জবাব কি বিজ্ঞান দিতে পারে? আমার প্রাণে এক্ষণে যে সুরটি বাজছে তা আনন্দ কি বেদনার একদিন তারও হয়তো আক্ষরিক একটা জবাব খাড়া করতে সমর্থ হতে পারে বিজ্ঞান। তবে অনন্ত জীবন-জিজ্ঞাসার পরিপূর্ণ জবাব খুঁজতে আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় দার্শনিক, তাত্তি্বকের কাছে। বিজ্ঞান ওই দার্শনিক মতবাদকে নব নব আবিষ্কারের মাধ্যমে পরিশীলিত করে, সংশোধন করার তাগিদ সৃষ্টি করে।


এভাবে চলা নিরন্তর প্রক্রিয়ায় অনেক তত্ত্বকে অসারও প্রমাণ করে। আবার নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার জীবন সম্পর্কে ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। আসলে আমার-আপনার চারপাশ বা আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটার নানাবিধ রূপান্তর অথবা নতুন গ্রহের সন্ধান ইত্যাদি বিষয়গুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে বিজ্ঞান। আমাদের নাড়ি থেকে নক্ষত্র, ছায়াপথ, ব্রহ্মাণ্ড, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা কোনো কিছুই বিজ্ঞানের কাছে অচ্ছুত নয়। এই আমি কোথা থেকে এসেছি, এরপর কী অর্থাৎ সৃষ্টির রহস্যকে ভেদ করার চেষ্টা বিজ্ঞানের সাধনারই টুকরো টুকরো অংশ। এভাবেই সৃষ্টির রহস্যভেদের তত্ত্ব ও বিজ্ঞান হাত ধরাধরি করে চলেছে। পৃথিবীটা নদীপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কোনো মজে যাওয়া বিল নয়। এটা অনন্তে ছুটে চলা সৃষ্টি চিত্রনাট্যের প্রসারিত হয়ে চলা বর্ণিল আলোর রেখা যেন।
ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী মানুষ কেউই সৃষ্টির এই অপার সৌন্দর্যকে অস্বীকার করেন না। শুধু তার মহিমা কীর্তনে পাত্র হয় ভিন্নমাত্রা। যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে সে ঈশ্বরের মন বুঝতে চায়। সেটাই তার সিদ্ধির লক্ষ্য। সে উপাসনা বা ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরে লীন হওয়ার চেষ্টা করে, মহাশূন্য তার কাছে ঊর্ধ্বলোক। সেখানে সে ডুব দিতে চায়। আর যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন, তিনি সবকিছুর মধ্যে একটি জৈবিক-বস্তুগত শৃঙ্খলার পরস্পরাকে অধিত জ্ঞান দিতে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। আস্তিক ও নাস্তিক_ এই উভয় মতের অনুসারীরাই আবার নিজেদের উপলব্ধিকে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নিক্তিতে বিচার করে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হতে চান। আস্তিকরাও অতীতের মতো এখন আর বিজ্ঞানের প্রতি মুখ ঘুরিয়ে রাখেন না। মানবের বিজ্ঞান সম্পর্কে এই নতুন উপলব্ধি সভ্যতা বিকাশেরই লক্ষণ। কিন্তু ঈশ্বরের মন বুঝতে গিয়ে শয়তানের কাছে নিজের আত্মাকে বিক্রি করে দেওয়া বা মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই এই সমাজ-সংসারে। তাই বলে জীবন সম্পর্কে দর্শনের উপলব্ধি ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে তার উত্তর খোঁজা বা কঠিনেরে ধরার চেষ্টার এতে কোনো ক্ষান্তি হয় না।
তবে যখন পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার সন-তারিখ উল্লেখ করে কোনো মিথ উল্লেখ করা হয়, তখন তার ওপর তাবৎ দুনিয়ার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন। যেমন_ মায়া সভ্যতার একটি মিথ উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, ২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর এই পৃথিবীতে মহাপ্রলয় ঘটবে। এ পর্যন্ত পৃথিবী ধ্বংসের যতগুলো বার্তা প্রচার হয়েছে তার কোনোটি কি ঠিক হয়েছে! নিজের শরীরে চিমটি কাটলেই বোঝা যাবে এর অসারতা কতখানি। জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থ বিজ্ঞানীসহ তাবৎ বিজ্ঞানী এ কথা শুনে নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকাবেন। তারা বলবেন, পৃথিবীর পানে তো অন্য কোনো গ্রহ সহসা আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা নেই। তাই পৃথিবীতে মহাপ্রলয় ঘটারও সমূহ বিপদ নেই। সবার বিশ্বাস, বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে বলেই এ ধরনের প্রলয়ের সংবাদে মানুষের মধ্যে তেমন চাঞ্চল্য এখন আর লক্ষ্য করা যায় না।
আসলে বিজ্ঞানই হলো মানুষের জীবন থেকে অন্ধকার দূর করার হাতিয়ার। মানুষকে সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য উপভোগের বস্তুগত আধার গড়ে দেয় বিজ্ঞান। আর জীবনের মানে জিজ্ঞাসার উত্তর দেন দার্শনিক। সেটাও আবার বিজ্ঞান পরিশীলিত করে চলে তার নব নব আবিষ্কারে।
এদিক থেকে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে সমকালের বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজন তুলনাহীন। বিজ্ঞান আমাদের বলছে, মানুষ চলছে, থেমে যাওয়া তার ধর্ম নয়।

No comments

Powered by Blogger.