সপ্তাহের হালচাল-পুঁজিবাদ কি তাহলে বিকল হয়ে যাচ্ছে by আব্দুল কাইয়ুম
নাটকীয়ভাবে প্রসঙ্গটা উঠলো। সুইড ব্যাংকের করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি প্রধান স্ট্যাফান ডাহলবেক আলোচনা করছিলেন। স্টকহোমের ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সেন্টারে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) বিভিন্ন দিক তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন মাল্টিমিডিয়া পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে।
পর্দায় ভেসে উঠল একটা কম্পিউটারের ছবি। তার মনিটারে লেখা, ‘ক্যাপিটালিজম ক্র্যাশড, ইনস্টল নিউ সিস্টেম?’ (পুঁজিবাদ বিকল, নতুন ব্যবস্থা প্রতিস্থাপন করবে?)। তার নিচে ‘ওকে’ লেখা ঘরে তীর চিহ্নিত কার্সার স্থাপন করা আছে। সেখানে ক্লিক করলেই নতুন ব্যবস্থায় উত্তরণ। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি মনে করো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা আর কাজ করছে না? তিনি বললেন, সমস্যা তো আছেই। বিশ্বের ২০ শতাংশ মানুষ নিয়ন্ত্রণ করছে ৮০ ভাগ মানুষকে, এটা কি ন্যায্য? জটিল প্রশ্ন।
সে দিন সকালেই সারা বিশ্ব জেনে গেছে যে নিউইয়র্কে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্টকহোমে তখনো একটা পার্কে কিছু লোকজন ছোট ছোট তাঁবু খাটিয়ে ‘অকুপাই সুইডেন’ আন্দোলন করছে। কেউ বাধা দিচ্ছে না। অনেকটা প্রতীকী আন্দোলন। স্টকহোমের সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে খুব আলোড়িত নয়। কারণ, সুইডেনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভালোই ন্যায়নীতি রয়েছে।
প্রথমদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য ছিল শুধু মুনাফা করা। এরপর কল্যাণমূলক সামাজিক কাজে মুনাফার অংশ বিশেষ ব্যয়ের প্রচলন হলো। এরপর প্রশ্ন উঠল টেকসই ব্যবসার জন্য শ্রমিক-কর্মীদের মানবাধিকার ও কাজের উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এখন প্রশ্ন এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মনে রাখতে হবে। কারখানাকে হতে হবে পরিবেশবান্ধব। ওই খাতে ব্যয় করতে হবে। সমন্বিতভাবে করতে না পারলে সবকিছু ভেঙে পড়বে। এভাবে ‘করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’ ক্রমান্বয়ে নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। সুইডেন এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসমৃদ্ধ ধারণার একটি মডেল হয়ে উঠছে। ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল’ আন্দোলনের মুখে এসব প্রচেষ্টা আরও গতি অর্জন করেছে।
সুইডেনের মানুষ খুব সুশৃঙ্খল, মানবিক। মানবাধিকারের প্রতি সংবেদনশীল। সুইডেনের রাজা কার্ল ষষ্ঠ গুস্তাফ প্রতিদিন তাঁদের বাসভবন থেকে ২০ কিলোমিটার পথ নিজে গাড়ি চালিয়ে রাজপ্রাসাদে আসেন অফিস করতে। তিনি ৬৫ বছরের ‘তরুণ’। তাঁর গাড়ির আগে-পিছে সাইরেন বাজিয়ে কাউকে যেতে হয় না। সিগন্যালে লালবাতি জ্বললে তিনি গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করেন। সিটবেল্ট বেঁধে গাড়ি চালান!
জুলিয়ান আসাঞ্জ কি চক্রান্তের শিকার?
জানার ইচ্ছা ছিল খোদ স্টকহোমের মানুষ জুলিয়ান আসাঞ্জের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল। তারা কি মনে করে আসাঞ্জ সত্যিই সেই নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনিরাপদ মিলনে লিপ্ত হয়েছিল, যেটা সুইডেনের আইনে অপরাধ, যাকে বলা যায় ধর্ষণ? নাকি উইকিলিকসের তথ্যবোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য এটা একটা চক্রান্ত? গত তিন দিনে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার কাছে সরাসরি প্রশ্নটা রাখি। তাঁদের জিজ্ঞেস করি, বলুন, হ্যাঁ নাকি না? তাঁরা নির্দ্বিধায় বলেন, না, চক্রান্ত নয়। আসাঞ্জ বিশেষভাবে মার্কিন গোপন দলিলপত্র ফাঁস করে যে প্রশংসার কাজ করেছেন, সেটা তাঁরা অকপটে স্বীকার করেন। কিন্তু মামলার ব্যাপারটা তো ভিন্ন। এটা এখন আদালতের এখতিয়ার।
সুইডেনের পার্লামেন্টারি কমিশন ফর ফ্রিডম অব স্পিচের সচিব নিলস ফুংকের সঙ্গে দেখা হয় আমার হোটেলকক্ষে। ঝানু সাংবাদিক। একসময় সাপ্তাহিক রিকসড্যাগ অ্যান্ড ডিপার্টমেন্ট (সংসদ ও সরকার)-এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন। তিনি তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি যেটা ভাবছেন ব্যাপারটা তা নয়। এটা সিআইয়ের ষড়যন্ত্র নয়। কেউ এ রকম ভাবলে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, সিআইয়ের কাণ্ডকারখানা সবাই জানে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা আদালতে গেছে। সত্য জানা যাবে। আমি বললাম, ধরুন হোটেল থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে, দোকানপাটে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ১০ জনকে এই প্রশ্নটা করলাম, তারা কী উত্তর দেবে বলে আপনি মনে করেন? তিনি কোনো রকম ইতস্তত না করেই বলেন, ধরে রাখুন নয়জনই বলবে, এতে কোনো চক্রান্ত নেই। এক নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনিরাপদ পদ্ধতিতে ভোগ যদি করে থাকে, তার বিচার হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। তবে উইকিলিকস আলাদা ব্যাপার, তার জন্য আসাঞ্জকে সবাই কৃতজ্ঞতা জানাবে।
জিজ্ঞেস করলাম সেই নারী কোথায়? তাঁকে কি কেউ জিজ্ঞেস করে সত্য জানতে চেয়েছে? অভিযোগটা কি তাঁর নিজের, নাকি তাঁর নামে সাজানো হয়েছে? ফুংকে বলেন, আমাদের পত্রিকাগুলো নিশ্চয়ই তা করেছে। অভিযোগকারীর আইনজীবীদের তো অবশ্যই জেরা করা হয়েছে। এখানে কোনো ফাঁক নেই।
ফুংকে বলেন, সুইডেনে বাকস্বাধীনতা আইন খুব শক্তিশালী। ১৭৬৬ সালে এ আইন চালু করা হয়। তখন পুরোদস্তুর রাজতন্ত্র। তার মধ্যেই পরিষদ আইনটি করে। এরপর বিভিন্ন সময় সংস্কারের মাধ্যমে একে যুগোপযোগী করা হয়েছে। এ আইন নিয়ে সবসময় চিন্তাভাবনা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কাজ করে সংসদীয় কমিশন। এ রকম শক্তিশালী আইন রয়েছে বলেই আসাঞ্জের পক্ষে সুইডেনে থেকে উইকিলিকসের তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়েছে। তাঁর কম্পিউটার সার্ভারগুলো যে সুইডেনে কাজ করছে, সেটা গোপন কোনো ব্যাপার ছিল না। সবই খোলামেলা, আইনসম্মত। এতে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই।
নিলস ফুংকে বলেন, মামলার কারণে আসাঞ্জের সূচিত গোপন তথ্য উদ্ঘাটন তৎপরতা বন্ধ হবে না। বরং এই উদ্যোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন নতুন ওয়েবসাইট চালু হয়ে গেছে। স্টকহোমে পাবলিক সার্ভিস রেডিও চালু করেছে ‘রেডিওলিকস’। হুইসেলব্লোয়াররা (ভেতর থেকে গোপন তথ্য ফাঁসকারী) খবর দেয় আর রেডিওর অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা সেসব তথ্য যাচাই করে প্রচার করেন। এটা এখন বেশ জনপ্রিয়।
বড়লোকের দেশ অথচ শানশওকত নেই
সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সার্ভিস বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ানের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী চেইনশপ আইকিয়া সম্পর্কে তুমি কতটা জানো? জানতাম যে এটা আধুনিক রুচিসম্মত আসবাবপত্র, রান্নার জিনিসপত্র, গ্লাস-প্লেটের জন্য বিখ্যাত। বললাম, এটা তো সুইডিশ কোম্পানি। বাংলাদেশেও এর কারখানা আছে, যদিও বিক্রির দোকান চোখে পড়েনি। এর বৈশিষ্ট্য হলো, সব জিনিসপত্রের ডিজাইন মনোমুগ্ধকর, দামেও দারুণ সস্তা।
ইয়ান বলেন, আসল কথাটাই তুমি জানো না। আইকিয়ার মালিক যখন স্টকহোমে আসেন, তিনি গাড়িতে চলাফেরা করেন না, হয় বাস, নয় তো মেট্রোতে চড়েন। তাঁর যুক্তি, অন্তত একটু কার্বন দূষণ কমাই! প্লেনে ইকোনমিক ক্লাসে ভ্রমণ করেন, বলেন, সাধারণের সঙ্গে থাকতে চাই! (অবশ্য সুইডেনের কেউ কেউ মনে করেন এটা তাঁর বদান্যতা নয়)। মাত্র ৫০ বছর আগে তাঁর কোম্পানির শুরু। তার নাম ইঙ্গভার কামপ্রাড। নামের আদ্যক্ষর দিয়ে আইকিয়ার নাম (IKEA-Ingvar Kamprad Elmtaryd Agunnaryd)। শুরুতে তিনি চেয়ার বানাতেন আর নিজে সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি পণ্য বিক্রি করতেন। আজ তিনি সুইডেনের সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তি। বিশ্বের অন্যতম সেরা কোম্পানি আইকিয়ার মালিক। সুইডেন বেশ বড় দেশ কিন্তু লোক সংখ্যা এক কোটিরও কম। মাথাপিছু আয় প্রায় সাড়ে ৩৮ হাজার ডলার। অথচ রাস্তায় গাড়ির ভিড় নেই। লোকে হাঁটতে ও বাসে চড়তে ভালোবাসেন। দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য সুইডেন বিখ্যাত। বিগত ষাটের দশকে স্টকহোম নগরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া স্ট্রিমনেন নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়ে। মিষ্টি পানির লেক ম্যালারেন থেকে গিয়ে এই নদী মিশেছে বাল্টিক সাগরে। দূষণের কারণে নদীতে মাছ ছিল না, কেউ গোসল করতে পারত না, পানি ব্যবহার তো দূরের কথা। তখন মিউনিসিপ্যালিটি আইন করল কোনো কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না। নগরের কোনো বর্জ্য নদীতে মিশবে না। মালিকেরা বলেন, বর্জ্য শোধন করতে গেলে তো কারখানা লোকসানি হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু নগর ব্যবস্থাপকেরা কঠোর হলেন। শেষ পর্যন্ত নদী দূষণমুক্ত হলো। লোকসানের কারণে কোনো কারখানা বন্ধও হলো না। আজ সেই নদীতে সাধারণ মানুষ ছিপ ফেলে মাছ ধরেন, পর্যটকেরা নৌভ্রমণ করে নগরের সৌন্দর্য দেখেন। ঢাকার বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত করতে এ রকম অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যায়।
শহর প্রতিস্থাপন
সুইডেন যেকোনো উন্নয়নকাজে মানবাধিকার, মানবিকতা প্রভৃতিকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়। স্টকহোম থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার উত্তরে কিরুনা শহরে এক এলাহী কর্মযজ্ঞ শুরু হতে যাচ্ছে। বছর দশেক আগে সেখানে বেশ উন্নতমানের আয়রন ওর (লৌহ আকরিক) পাওয়া গেছে। কিন্তু খনি খুঁড়ে সেই লোহা তুলতে হলে শহর থাকে না। এ নিয়ে নগরবাসীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঠিক করা হলো যে পুরো শহরটাই কয়েক কিলোমিটার দূরে সরিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে। লোকসংখ্যা ২৩ হাজার। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ খুশি। ক্ষতিপূরণ দেবে সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান খনি কোম্পানি এলকুয়াবে। তারাই নতুন শহরে নতুন ও আধুনিক ডিজাইনের বাড়ি তৈরি করে দেবে সবার জন্য। কিন্তু বাদ সাধল অপেক্ষাকৃত প্রবীণ নাগরিকেরা। তাঁরা পুরোনো স্মৃতিময় বাড়ি ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো মাটি খুঁড়ে তাঁদের বাড়ি পুরোটাই তুলে নিয়ে নতুন শহরে অবিকল আগের মতো করে বসিয়ে দেবে। এবার আর কারও আপত্তি রইল না।
বাস-ট্রাক নির্মাণ কারখানা স্ক্যানিয়াতে গিয়ে শুনলাম আরেক কাহিনি। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় তাদের গাড়ি বিক্রির হার একেবারে অর্ধেকে নেমে আসে। উৎপাদন কমাতে হবে। কারখানা বন্ধ করবে, নাকি শ্রমিক ছাঁটাই করবে? ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলো কোনো শ্রমিক ছাঁটাই না করে বরং সপ্তাহে তিন-চার দিন কারখানা বন্ধ রাখা হবে। যেন কোম্পানির লোকসান কম হয়। তাতে শ্রমিকদের আয় কিছুটা কমে গেল, কিন্তু কাউকে চাকরি হারাতে হলো না। এখানে প্রধান বিবেচ্য ছিল মানবিকতা। এখন আবার চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। পুরোদমে কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
সুইডেন থেকে ফিরে
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com
সে দিন সকালেই সারা বিশ্ব জেনে গেছে যে নিউইয়র্কে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্টকহোমে তখনো একটা পার্কে কিছু লোকজন ছোট ছোট তাঁবু খাটিয়ে ‘অকুপাই সুইডেন’ আন্দোলন করছে। কেউ বাধা দিচ্ছে না। অনেকটা প্রতীকী আন্দোলন। স্টকহোমের সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে খুব আলোড়িত নয়। কারণ, সুইডেনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভালোই ন্যায়নীতি রয়েছে।
প্রথমদিকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য ছিল শুধু মুনাফা করা। এরপর কল্যাণমূলক সামাজিক কাজে মুনাফার অংশ বিশেষ ব্যয়ের প্রচলন হলো। এরপর প্রশ্ন উঠল টেকসই ব্যবসার জন্য শ্রমিক-কর্মীদের মানবাধিকার ও কাজের উন্নত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এখন প্রশ্ন এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মনে রাখতে হবে। কারখানাকে হতে হবে পরিবেশবান্ধব। ওই খাতে ব্যয় করতে হবে। সমন্বিতভাবে করতে না পারলে সবকিছু ভেঙে পড়বে। এভাবে ‘করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’ ক্রমান্বয়ে নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। সুইডেন এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসমৃদ্ধ ধারণার একটি মডেল হয়ে উঠছে। ‘ওয়াল স্ট্রিট দখল’ আন্দোলনের মুখে এসব প্রচেষ্টা আরও গতি অর্জন করেছে।
সুইডেনের মানুষ খুব সুশৃঙ্খল, মানবিক। মানবাধিকারের প্রতি সংবেদনশীল। সুইডেনের রাজা কার্ল ষষ্ঠ গুস্তাফ প্রতিদিন তাঁদের বাসভবন থেকে ২০ কিলোমিটার পথ নিজে গাড়ি চালিয়ে রাজপ্রাসাদে আসেন অফিস করতে। তিনি ৬৫ বছরের ‘তরুণ’। তাঁর গাড়ির আগে-পিছে সাইরেন বাজিয়ে কাউকে যেতে হয় না। সিগন্যালে লালবাতি জ্বললে তিনি গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করেন। সিটবেল্ট বেঁধে গাড়ি চালান!
জুলিয়ান আসাঞ্জ কি চক্রান্তের শিকার?
জানার ইচ্ছা ছিল খোদ স্টকহোমের মানুষ জুলিয়ান আসাঞ্জের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল। তারা কি মনে করে আসাঞ্জ সত্যিই সেই নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনিরাপদ মিলনে লিপ্ত হয়েছিল, যেটা সুইডেনের আইনে অপরাধ, যাকে বলা যায় ধর্ষণ? নাকি উইকিলিকসের তথ্যবোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য এটা একটা চক্রান্ত? গত তিন দিনে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার কাছে সরাসরি প্রশ্নটা রাখি। তাঁদের জিজ্ঞেস করি, বলুন, হ্যাঁ নাকি না? তাঁরা নির্দ্বিধায় বলেন, না, চক্রান্ত নয়। আসাঞ্জ বিশেষভাবে মার্কিন গোপন দলিলপত্র ফাঁস করে যে প্রশংসার কাজ করেছেন, সেটা তাঁরা অকপটে স্বীকার করেন। কিন্তু মামলার ব্যাপারটা তো ভিন্ন। এটা এখন আদালতের এখতিয়ার।
সুইডেনের পার্লামেন্টারি কমিশন ফর ফ্রিডম অব স্পিচের সচিব নিলস ফুংকের সঙ্গে দেখা হয় আমার হোটেলকক্ষে। ঝানু সাংবাদিক। একসময় সাপ্তাহিক রিকসড্যাগ অ্যান্ড ডিপার্টমেন্ট (সংসদ ও সরকার)-এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন। তিনি তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি যেটা ভাবছেন ব্যাপারটা তা নয়। এটা সিআইয়ের ষড়যন্ত্র নয়। কেউ এ রকম ভাবলে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, সিআইয়ের কাণ্ডকারখানা সবাই জানে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা আদালতে গেছে। সত্য জানা যাবে। আমি বললাম, ধরুন হোটেল থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে, দোকানপাটে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ১০ জনকে এই প্রশ্নটা করলাম, তারা কী উত্তর দেবে বলে আপনি মনে করেন? তিনি কোনো রকম ইতস্তত না করেই বলেন, ধরে রাখুন নয়জনই বলবে, এতে কোনো চক্রান্ত নেই। এক নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনিরাপদ পদ্ধতিতে ভোগ যদি করে থাকে, তার বিচার হওয়াটা বাঞ্ছনীয়। তবে উইকিলিকস আলাদা ব্যাপার, তার জন্য আসাঞ্জকে সবাই কৃতজ্ঞতা জানাবে।
জিজ্ঞেস করলাম সেই নারী কোথায়? তাঁকে কি কেউ জিজ্ঞেস করে সত্য জানতে চেয়েছে? অভিযোগটা কি তাঁর নিজের, নাকি তাঁর নামে সাজানো হয়েছে? ফুংকে বলেন, আমাদের পত্রিকাগুলো নিশ্চয়ই তা করেছে। অভিযোগকারীর আইনজীবীদের তো অবশ্যই জেরা করা হয়েছে। এখানে কোনো ফাঁক নেই।
ফুংকে বলেন, সুইডেনে বাকস্বাধীনতা আইন খুব শক্তিশালী। ১৭৬৬ সালে এ আইন চালু করা হয়। তখন পুরোদস্তুর রাজতন্ত্র। তার মধ্যেই পরিষদ আইনটি করে। এরপর বিভিন্ন সময় সংস্কারের মাধ্যমে একে যুগোপযোগী করা হয়েছে। এ আইন নিয়ে সবসময় চিন্তাভাবনা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কাজ করে সংসদীয় কমিশন। এ রকম শক্তিশালী আইন রয়েছে বলেই আসাঞ্জের পক্ষে সুইডেনে থেকে উইকিলিকসের তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়েছে। তাঁর কম্পিউটার সার্ভারগুলো যে সুইডেনে কাজ করছে, সেটা গোপন কোনো ব্যাপার ছিল না। সবই খোলামেলা, আইনসম্মত। এতে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই।
নিলস ফুংকে বলেন, মামলার কারণে আসাঞ্জের সূচিত গোপন তথ্য উদ্ঘাটন তৎপরতা বন্ধ হবে না। বরং এই উদ্যোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে। নতুন নতুন ওয়েবসাইট চালু হয়ে গেছে। স্টকহোমে পাবলিক সার্ভিস রেডিও চালু করেছে ‘রেডিওলিকস’। হুইসেলব্লোয়াররা (ভেতর থেকে গোপন তথ্য ফাঁসকারী) খবর দেয় আর রেডিওর অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা সেসব তথ্য যাচাই করে প্রচার করেন। এটা এখন বেশ জনপ্রিয়।
বড়লোকের দেশ অথচ শানশওকত নেই
সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের মিডিয়া সার্ভিস বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ানের সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী চেইনশপ আইকিয়া সম্পর্কে তুমি কতটা জানো? জানতাম যে এটা আধুনিক রুচিসম্মত আসবাবপত্র, রান্নার জিনিসপত্র, গ্লাস-প্লেটের জন্য বিখ্যাত। বললাম, এটা তো সুইডিশ কোম্পানি। বাংলাদেশেও এর কারখানা আছে, যদিও বিক্রির দোকান চোখে পড়েনি। এর বৈশিষ্ট্য হলো, সব জিনিসপত্রের ডিজাইন মনোমুগ্ধকর, দামেও দারুণ সস্তা।
ইয়ান বলেন, আসল কথাটাই তুমি জানো না। আইকিয়ার মালিক যখন স্টকহোমে আসেন, তিনি গাড়িতে চলাফেরা করেন না, হয় বাস, নয় তো মেট্রোতে চড়েন। তাঁর যুক্তি, অন্তত একটু কার্বন দূষণ কমাই! প্লেনে ইকোনমিক ক্লাসে ভ্রমণ করেন, বলেন, সাধারণের সঙ্গে থাকতে চাই! (অবশ্য সুইডেনের কেউ কেউ মনে করেন এটা তাঁর বদান্যতা নয়)। মাত্র ৫০ বছর আগে তাঁর কোম্পানির শুরু। তার নাম ইঙ্গভার কামপ্রাড। নামের আদ্যক্ষর দিয়ে আইকিয়ার নাম (IKEA-Ingvar Kamprad Elmtaryd Agunnaryd)। শুরুতে তিনি চেয়ার বানাতেন আর নিজে সাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি পণ্য বিক্রি করতেন। আজ তিনি সুইডেনের সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তি। বিশ্বের অন্যতম সেরা কোম্পানি আইকিয়ার মালিক। সুইডেন বেশ বড় দেশ কিন্তু লোক সংখ্যা এক কোটিরও কম। মাথাপিছু আয় প্রায় সাড়ে ৩৮ হাজার ডলার। অথচ রাস্তায় গাড়ির ভিড় নেই। লোকে হাঁটতে ও বাসে চড়তে ভালোবাসেন। দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য সুইডেন বিখ্যাত। বিগত ষাটের দশকে স্টকহোম নগরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া স্ট্রিমনেন নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়ে। মিষ্টি পানির লেক ম্যালারেন থেকে গিয়ে এই নদী মিশেছে বাল্টিক সাগরে। দূষণের কারণে নদীতে মাছ ছিল না, কেউ গোসল করতে পারত না, পানি ব্যবহার তো দূরের কথা। তখন মিউনিসিপ্যালিটি আইন করল কোনো কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলা যাবে না। নগরের কোনো বর্জ্য নদীতে মিশবে না। মালিকেরা বলেন, বর্জ্য শোধন করতে গেলে তো কারখানা লোকসানি হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু নগর ব্যবস্থাপকেরা কঠোর হলেন। শেষ পর্যন্ত নদী দূষণমুক্ত হলো। লোকসানের কারণে কোনো কারখানা বন্ধও হলো না। আজ সেই নদীতে সাধারণ মানুষ ছিপ ফেলে মাছ ধরেন, পর্যটকেরা নৌভ্রমণ করে নগরের সৌন্দর্য দেখেন। ঢাকার বুড়িগঙ্গা দূষণমুক্ত করতে এ রকম অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যায়।
শহর প্রতিস্থাপন
সুইডেন যেকোনো উন্নয়নকাজে মানবাধিকার, মানবিকতা প্রভৃতিকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়। স্টকহোম থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার উত্তরে কিরুনা শহরে এক এলাহী কর্মযজ্ঞ শুরু হতে যাচ্ছে। বছর দশেক আগে সেখানে বেশ উন্নতমানের আয়রন ওর (লৌহ আকরিক) পাওয়া গেছে। কিন্তু খনি খুঁড়ে সেই লোহা তুলতে হলে শহর থাকে না। এ নিয়ে নগরবাসীর সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঠিক করা হলো যে পুরো শহরটাই কয়েক কিলোমিটার দূরে সরিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে। লোকসংখ্যা ২৩ হাজার। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ খুশি। ক্ষতিপূরণ দেবে সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান খনি কোম্পানি এলকুয়াবে। তারাই নতুন শহরে নতুন ও আধুনিক ডিজাইনের বাড়ি তৈরি করে দেবে সবার জন্য। কিন্তু বাদ সাধল অপেক্ষাকৃত প্রবীণ নাগরিকেরা। তাঁরা পুরোনো স্মৃতিময় বাড়ি ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো মাটি খুঁড়ে তাঁদের বাড়ি পুরোটাই তুলে নিয়ে নতুন শহরে অবিকল আগের মতো করে বসিয়ে দেবে। এবার আর কারও আপত্তি রইল না।
বাস-ট্রাক নির্মাণ কারখানা স্ক্যানিয়াতে গিয়ে শুনলাম আরেক কাহিনি। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় তাদের গাড়ি বিক্রির হার একেবারে অর্ধেকে নেমে আসে। উৎপাদন কমাতে হবে। কারখানা বন্ধ করবে, নাকি শ্রমিক ছাঁটাই করবে? ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলো কোনো শ্রমিক ছাঁটাই না করে বরং সপ্তাহে তিন-চার দিন কারখানা বন্ধ রাখা হবে। যেন কোম্পানির লোকসান কম হয়। তাতে শ্রমিকদের আয় কিছুটা কমে গেল, কিন্তু কাউকে চাকরি হারাতে হলো না। এখানে প্রধান বিবেচ্য ছিল মানবিকতা। এখন আবার চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। পুরোদমে কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
সুইডেন থেকে ফিরে
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
quayum@gmail.com
No comments