রাজবাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি! by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

রাজশাহীর পুঠিয়ার সাবেক এক তহশিলদারের বিরুদ্ধে সরকারের অধীনে থাকা তৎকালীন রাজা-জমিদারদের সম্পত্তি দখলের চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চারটি রাজবাড়ি ও জমিদারবাড়ির সম্পত্তি নিজের দাবি করে তিনি দীর্ঘদিন ধরে মামলা ও আদালতে রিট করে আসছেন। সব মামলায় তিনি হেরেছেন। রিটগুলোও খারিজ হয়ে গেছে।


ভুয়া দলিল তৈরির দায়ে আদালত তাঁকে ভর্ৎসনা করেছেন। ‘দেশের শীর্ষ জালিয়াত’ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে তাঁকে। তবু তিনি ক্ষান্ত হননি।
তাঁর নাম খলিলুর রহমান (৭৯)। বাড়ি রাজশাহী নগরের হড়গ্রাম এলাকায়। সর্বশেষ পুঠিয়ার রাজবাড়ির সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করে করা রিট আবেদনটিও গত ৯ জানুয়ারি খারিজ করে দেন আদালত। এর বিরুদ্ধে খলিল উচ্চ আদালতে আপিল করতে যাচ্ছেন বলে তাঁর জামাতা জানিয়েছেন।
এসব বিষয়ে খলিলুর রহমান প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
হড়গ্রাম মহল্লার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খলিল ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে থাকেন। অথচ, পাশেই তাঁর চারতলা একটি বাড়ি রয়েছে। কুঁড়েঘরের জমি নিয়েও মামলা আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেটি দখলে রাখতেই তিনি সেই কুঁড়েতে থাকেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, পুঠিয়ার রাজবাড়িসহ রাজ এস্টেটে ৩৬ একর জমি রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বাড়িটির সংস্কারকাজ শুরু করেছে। রাজবাড়ি, মন্দির ও মাঠ উন্নয়নে আরও তিন কোটি ৮০ লাখ টাকার বরাদ্দ মিলেছে।
জানা যায়, ১৯৩৩ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার হুরলি থানার (বর্তমানে রানীনগর) ঝাড়ুপাড়া গ্রামে খলিলের জন্ম। বাবা সামসুদ্দিনের সঙ্গে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার কানাইডাঙ্গা গ্রামে এসে বসত গড়েন। সেখানে থেকে একসময় রাজশাহী নগরের হড়গ্রাম মহল্লায় বসবাস শুরু করেন। সহকারী তহশিলদার হিসেবে পুঠিয়ায় চাকরি নেন তিনি।
আদালতে দাখিল করা খলিলের নথিপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৩৮ সালে পুঠিয়া রাজ এস্টেটের সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব পান মহারানি হেমন্ত কুমারীর নাতি অমিয় সান্যাল, সঞ্জয় সান্যাল ও সাবিত্রী সান্যাল। দেশ ভাগের আগেই তাঁরা ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর পরিত্যক্ত এসব সম্পত্তি সরকারের অধীনে আসে। চাকরির সুবাদে পুঠিয়ার তহশিলদার হিসেবে খলিল রাজ এস্টেটের সব সম্পত্তি নিবিড় পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান।
আদালতে দাখিল করা নথিপত্রে খলিল দাবি করেন, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে তাঁর ও পুঠিয়া রাজ এস্টেটের উত্তরাধিকারদের মধ্যে বিনিময় দলিল হয়। এর মাধ্যমে ভারতের মুর্শিদাবাদের হুররিপাড়ায় তাঁর ১১৯ একর জমির সঙ্গে পুঠিয়া রাজ এস্টেটের ৩৬ দশমিক শূন্য ৩ একর জমির বিনিময় হয়। ১৯৭৫ সালের ২ অক্টোবর তৎকালীন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক বিনিময় দলিলমূলে পুঠিয়ার রাজবাড়ির সম্পত্তি খলিলের নামে নিবন্ধন করে দেন।
একপর্যায়ে বিনিময় দলিলে জালিয়াতির বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালের ২০ জুন ওই বিনিময় দলিল বাতিল করেন জেলা প্রশাসক। এরপর খলিল হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত খলিলের পক্ষে রায় দেন এবং ১৫ দিনের মধ্যে তাঁকে সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু জমি বুঝিয়ে না দেওয়ায় খলিল জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন। পরে আদালতের আদেশে প্রশাসন তাঁকে সম্পত্তির দখল বুঝিয়ে দেয়। এরপর খলিল পুঠিয়ার রাজবাড়িতে কিছুদিন বসবাসও করেন। ১৯৮৩ সালে সামরিক শাসনামলে প্রাচীন ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণের জন্য ৩ নম্বর সামরিক রেগুলেশন (এমএলও-৩-১৯৮৩) মূলে ওই সম্পত্তির ওপর দখলদারি ও সব কাগজপত্র বাতিল করা হয়। এর মাধ্যমে রাজ এস্টেটের সব সম্পত্তি থেকে খলিলকে উচ্ছেদ করা হয় এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়।
গত বছরের ২৬ আগস্ট হাইকোর্ট এরশাদের শাসনকাল অবৈধ ঘোষণা করলে আবারও সক্রিয় হন খলিল। হাইকোর্টে তিনি রিট আবেদন করেন। এরশাদের শাসনকাল যেহেতু অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, তাই সামরিক শাসকের জারি করা এমএলও-৩-১৯৮৩ বা ৩ নম্বর সামরিক রেগুলেশন কেন অকার্যকর হবে না—এই মর্মে ঘোষণা চেয়ে রিট করেন তিনি। ওই রিটে এমএলও-৩-এর যেহেতু কোনো কার্যকারিতা নেই, তাই সম্পত্তির দখল তাঁকে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। গত ৯ জানুয়ারি আদালত তাঁর সেই রিট আবেদনও খারিজ করে দেন।
আমমোক্তারনামাবলে (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) খলিল গাজীপুরের ভাওয়াল রাজার সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করেন। সেই সম্পত্তি ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে রিটও করেন তিনি। ওই রিটে ভাওয়াল এস্টেটের অধীনে থাকা জয়দেবপুর রাজবাড়ী, বাগান, পুকুর, দিঘি, দোকান, টঙ্গী বাজার, ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীন নলগোলা কুঠিসহ জমি, ঢাকার তেজকুনিপাড়ার ভাওয়াল বাজার, হাতিরঝিল, সেগুনবাগিচার জমি, আশুলিয়া মডেল টাউনের জমি, নোয়াপাড়ার বাগান, সাবেক কেরানীগঞ্জ থানার বিলখাল এবং সাবেক জমিদারের রক্ষিত টাকাপয়সা ও সম্পত্তি দাবি করেন খলিল। ২০০৬ সালের ২৩ জানুয়ারি করা ওই রিট আবেদনটিও খারিজ করে দেন আদালত।
এর আগে পত্তনি দাখিলামূলে পুঠিয়ার চারআনা স্টেটের জমিদার নরেশ নারায়ণ রায়ের সম্পত্তি দখলে নিতে জেলা সাব-জজ আদালতে মামলা করা হয়। ওই মামলায় নরেশ নারায়ণের কথিত স্ত্রী কমর বেগম ও সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসককে বিবাদী করা হয়। ১৯৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নিজের পক্ষে রায় পান খলিল। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন কমর বেগম। এ মামলায় ভুয়া দলিল ও জাল কাগজপত্র তৈরির জন্য খলিলকে আদালত ভর্ৎসনা করেন বলে মামলার নথি থেকে জানা গেছে। সে সময় কমর বেগমের পক্ষে হাইকোর্টের আইনজীবী ছিলেন গোলাম রব্বানি। তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসর নেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই মামলায় আমরা জিতেছিলাম, এতটুকু মনে আছে।’
এ ছাড়া খলিলের বিরুদ্ধে পুঠিয়ার কৃষ্ণপুর এলাকার জমিদার শিবদা রঞ্জন লাহিড়ীর জমি দখল করে বিক্রির মাধ্যমে আত্মসাৎ চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। পুঠিয়ার কান্দ্রা মৌজার প্রায় ২৫ একর সরকারি সম্পত্তি দখলে নিতে ভুয়া নিলাম-মামলা দেখান খলিল। পরে তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহারের নামে তা নিলামে ক্রয় করান। কিন্তু সেই নিলাম-মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন আপত্তি জানালে সরকার রিভিশন মামলা করে সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণে আনে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহীর এক আইনজীবী বলেন, রাজশাহী বিশেষ জেলা জজ আদালত-২-এর বিচারক এক মামলার (সিআর ৮৩/২০০৭) আদেশে খলিলুর রহমানকে ‘দেশের শীর্ষ জালিয়াত’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।
গত ২১ জানুয়ারি নগরের হড়গ্রাম মহল্লায় গিয়ে দেখা যায়, কুঁড়েঘরের সামনে খলিলুর রহমান একটি টুলের ওপর বসে আছেন। তাঁর কাছে গেলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। একপর্যায়ে তিনি বাড়িতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। ভেতর থেকে বলেন, ‘মাফ চাই। আমি অসুস্থ মানুষ। কোনো বিষয়েই কথা বলব না।’
খলিলের মামলা-মোকদ্দমার বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন তাঁর জামাতা রফিকুল ইসলাম। চারতলা বাড়িটিতে রফিকুল পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সব কাগজপত্র বৈধ বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘উনি (তাঁর শ্বশুর) এসব ব্যাপারে কারও সঙ্গে কথা বলেন না, যা বলার আদালতেই বলেন।’ তবে সর্বশেষ রিটটি খারিজ হওয়ার পর তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানান রফিকুল। কুঁড়েঘর ও এর আঙিনা নিয়ে শ্বশুরের সঙ্গে শরিকদের মামলা থাকার সত্যতা স্বীকার করলেও চারতলা বাড়িটি তাঁর বলে দাবি করেছেন রফিকুল।

No comments

Powered by Blogger.