এসো নীপবনে-সুড়ঙ্গের শেষে কী? by আবুল হায়াত

‘সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আলো দেখা যাচ্ছে।’ এই কথাটি আমাদের দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রায়ই শোনা যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আলোটি আর আলো থাকে না, হয়ে যায় মরীচিকা। আমার লেখার বিষয় কিন্তু এটা নয়। কদিন আগে বেগম সাহেবাকে নিয়ে মরু শহর দুবাই গিয়েছিলাম বেড়াতে। প্রথম দিনই ‘সিটি ট্যুর’-এ ঘুরে দেখলাম দুবাই শহরের নানা স্থান।


গাইডের কথাগুলো ঘুরেফিরে কানে বাজছে: ‘এখানে একটা খাল ছিল, আমরা সেটা বড় করে ক্রিক (ছোট নদী) তৈরি করেছি।.. আর ওটাও ছিল ছোট নদীর মতো, ওটাকে চওড়া করা হয়েছে।’ ইত্যাদি।
তখনই বারবার মনে পড়ছিল ঢাকা শহরের মরণদশার কথা, অসংখ্য খালের শহর ঢাকাকে কীভাবে আমরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবর্জনাময় নগরে পরিণত করেছি। ওরা খালকে নদী বানায় আর আমরা নদীকে নর্দমায় করি পরিণত। আর ক্রমে সেটাও বেদখল হয়ে যায়।
এগুলোও কিন্তু আমার আজকের বলার বিষয় নয়। বলতে চাইছিলাম দুবাই শহরের শিনদাঘা সুড়ঙ্গের কথা। দুবাই ক্রিকের তলদেশ দিয়ে চার লেনের একটি সড়কসুড়ঙ্গ এই শিনদাঘা টানেল। দায়রা এবং আল শিনদাঘা এই দুই এলাকাকে যুক্ত করেছে ১৯৭৫-এ নির্মিত এই সুড়ঙ্গ। সেটার যেভাবে বর্ণনা দিচ্ছিলেন গাইড, তাতে যেকোনো পর্যটকেরই মনে হবে বিশাল কিছু একটা এই সুড়ঙ্গ। এটাই বোধ করি পর্যটনব্যবসার ক্যারিশমা।
তো, এর দৈর্ঘ্য কতখানি সেটা জানতে পারিনি গাইডের কাছ থেকে। কত হবে? দুই, চার কিংবা পাঁচ শ মিটার? আমরা জানি বিশ্বের দীর্ঘতম টানেল ১৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। সে তুলনায় এ অতি তুচ্ছ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে কঠিন শিলা ছেদ করে ‘ডেলাওয়ার একুইডাকট’ তৈরি হয়েছে। এবং সবচেয়ে দীর্ঘ সড়কসুড়ঙ্গ (২৪.৫ কিলোমিটার) নির্মাণ করেছে নরওয়ে।
তাহলে দেখছি ওই শিনদাঘা সুড়ঙ্গ এমন আহামরি কিছুই নয়, কিন্তু গাইডের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থাপন আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। আর আমাদের অনেক কিছু থেকেও নেই পর্যটকদের চোখে সেগুলোকে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা। এমনকি সেই যোগ্যতাও আছে কি না সন্দেহ জাগে মনে।
সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখার আশাতেই দিন কাটে আমাদের, অন্য কিছু চিন্তাভাবনার সময় কই। সুড়ঙ্গেই আমাদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
সুড়ঙ্গের কথাতেই ফিরে আসি আবার। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সুড়ঙ্গ নির্মাণ শুরু করে মানুষ। প্রথমে নিরাপদ বাসস্থান নির্মাণে তৈরি হয় গুহা। পরে তাকে বড় করার প্রয়োজনে হয় সুড়ঙ্গ। তবে সবচেয়ে উন্নত ধরনের সুড়ঙ্গ প্রথম তৈরি করে ব্যাবিলনীয়রা। সেচকাজের জন্য। খ্রিষ্টপূর্ব ২১৮০ থেকে ২১৬০ সন পর্যন্ত ইটের তৈরি হাঁটাপথও তৈরি করে মানুষ সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে। অবাক লাগে ভাবতে যে, সেই যুগে কীভাবে এত কঠিন কাজ সমাধা হতো।
রাজপ্রাসাদের সঙ্গে অপর পারের মন্দিরের সংযোগ স্থাপনের জন্য ইরাকিরা ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদীর তলদেশে শুকনো মৌসুমে উন্মুক্ত খননের মাধ্যমে তৈরি করেছিল সুড়ঙ্গপথ। কিন্তু মিসরীয়রা সবচেয়ে দক্ষ। তারা পিরামিড বানিয়ে যেমন অবাক করেছে পৃথিবীকে, দক্ষতা আর মেধায় সুড়ঙ্গ নির্মাণেও অগ্রগামীর ভূমিকা পালন করেছে তারা। তারা কঠিন মৃত্তিকা খননে ব্যবহার করেছে তামার করাত ও এক ধরনের ঘূর্ণায়মান হাতিয়ার। অবাক কাণ্ডই বটে।
প্রয়োজন মানুষকে সবকিছু করতে বাধ্য করে। সড়কপথে যান-চলাচলের জন্য যেমন সুড়ঙ্গ নির্মাণ হয়, তেমনি রেল যোগাযোগের জন্যও হচ্ছে। জাপান সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে ৫৪ কিলোমিটার রেলপথ তৈরি করেছে, যার নাম শেইকান রেলসুড়ঙ্গ।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে ১৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ১৯৭০-এ শুধু বন্যার সময় পানি সরানোর জন্য। ২০১৯ সালে এর কাজ শেষ হওয়ার কথা।
সুড়ঙ্গের অন্য রকম ব্যবহারও লক্ষ করা যাচ্ছে ইদানীংকালে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পশুদের অবাধ যাতায়াতের জন্য সুড়ঙ্গ ব্যবহার করা হচ্ছে, ব্যবহার করা হচ্ছে সামরিক বাহিনীর চলাচলের জন্যও। রাসায়নিক অস্ত্রভান্ডার হিসেবে সুড়ঙ্গকে অত্যন্ত নিরাপদ স্থান বলে বিবেচনা করা হচ্ছে বর্তমান যুগে।
আর হ্যাঁ, ভারতের কেরালার পুণ্যার্জন গুহা দিয়ে একবার যাতায়াত করলে নাকি মনুষ্যজন্মের সব পাপ মোচন হতে বাধ্য। এই সুড়ঙ্গ মনুষ্যসৃষ্ট নয়। প্রকৃতিদত্ত। এমন একটি সুড়ঙ্গ তো আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও রয়েছে।
পাঠক নিশ্চয় সুড়ঙ্গের শেষে আলোর খোঁজে আছেন। চলুন তবে আলোতে। ব্রিটিশরা নিজেদের সুড়ঙ্গ বিশেষজ্ঞ ভাবে। ইংলিশ চ্যানেলের তলদেশ দিয়ে ৫০.৫ কিলোমিটার রেলসুড়ঙ্গকে অনেকে পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম মনে করেন। এটি ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে ১৯৯৪ সালে যুক্ত করেছে রেলপথে।
ইংরেজ ও ফরাসিদের একটা জাতিগত বিদ্বেষ আছে বলে মানেন সবাই। সেই সূত্রেই ব্রিটিশরা বলে ফ্রেঞ্চ প্রকৌশলীরা নিম্নমানের কারিগর, বিশেষ করে সুড়ঙ্গ নির্মাণে একেবারেই নবিশ। ব্রিটিশরা আরো বলে: ‘আমরা একটি সুড়ঙ্গ নির্মাণে দুদিক থেকে কাজ শুরু করে মাঝখানটাতে ঠিক বিন্দুতে মিলিত হয়ে কাজ শেষ করি। আর ফরাসিরা দুদিক থেকে কাজ শুরু করে মিলিত না হয়ে দুটো সুড়ঙ্গ বানিয়ে ফেলে।’
এ দোষ কিন্তু বাহাদুরির সাথে মেনে নেয় ফরাসিরা। তারা বলে, ‘ব্রিটিশরা গর্ভে ধারণ করে একটি এবং প্রসব করে একটি আর আমরা গর্ভে ধারণ করি একটি কিন্তু প্রসব করি দুটি। তাহলে কে বেশি দক্ষ!’
আমারও সেই কথা। কে বেশি দক্ষ?
আমরা গর্ভে ধারণ করি একটি পদ্মাসেতু। শুনছি প্রসব হবে দুটি সেতু। আমরা গর্ভে ধারণ করেছি একটি ঢাকা সিটি করপোরেশন, এখন প্রসব করছি দুটি।
আমরাই বা কম কিসে?
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.