সরল গরল-সুষ্ঠু নির্বাচনের পঞ্চসালা প্রকল্প! by মিজানুর রহমান খান
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনরুজ্জীবন কিংবা নির্বাচনী সংস্কারের নামে শুধু আইন বা সংবিধান শোধরানো নয়, একই সঙ্গে গড়তে হবে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু পুরো দেশ যেন হাঁ করে আছে, আসমান থেকে টুপ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পড়বে। সর্বত্র একটা কী হচ্ছে কী হবে অবস্থা। কিন্তু অনেকেই খেয়াল করছেন না, সরকার ত্রয়োদশ সংশোধনী ফিরিয়ে দিলেও সংকট যেই তিমিরে, সেই তিমিরেই থাকবে। প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, তার উত্তর কারও জানা নেই।
বেগম খালেদা জিয়ার রোডমার্চ ঢাকাতেও আসবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে হাজার দুয়েক গাড়ি নিয়ে যাঁরা বগুড়ার রোডমার্চে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের গাড়ি কেনার হিসাব আদায়ের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তা নেওয়া হয়নি, কখনো নেওয়া হবে না। কারণ, তিনি জানেন তাঁর দলও ওইভাবে চলে এবং চলবে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের মচ্ছবটাও আসে এ রকম গাড়িবহরে চড়ে। গাড়িওয়ালা ও টাকাওয়ালারা মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। শেখ হাসিনা এই গাড়ি কেনার উৎস জানার যে আকুতি প্রকাশ করেছিলেন, সেটাই আসলে অমৃত। তাঁর গরলটুকু উগরে অমৃত পান করতে হবে। আর পান-পেয়ালাটা তুলে নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই। কিন্তু এই কমিশনের তো আয়ু শেষ।
ওই গাড়িবহরের ট্রাক ও বাসভর্তি ‘জনতা’ জোগাড় করে ‘ঐতিহাসিক’ সভা করার অপসংস্কৃতিতে আঘাত হানাই হতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চাবিকাঠি। দলীয়, নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন কিংবা জাতিসংঘের তদারকিতেই নির্বাচন হোক, ওই সংস্কৃতিটা না পাল্টালে আমরা নির্বাচিত স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উতরাতে পারব না।
নির্বাচন কমিশনের আসন্ন পুনর্গঠন, মানে তিন-চারটা মাথা যদি দুই বড় দলের মতৈক্যে একত্র করা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা ধেই ধেই করে নাচব। কিন্তু দরকার কমিশনের বর্তমান বাস্তব কার্যক্রমের খোলনলচে বদলে দেওয়া। যেটার মডেল হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইলেকশন কমিশন বা এফইসি।
গাড়িবহর ও মিছিল-সমাবেশ করতে এবং দল চালাতে টাকা লাগে। কালোটাকা শেয়ারবাজারে স্বাগত। দল চালাতেও স্বাগত। কিন্তু তার তথ্যটা জনগণের সামনে স্পষ্ট হতে হবে।
কোন দল কখন কত টাকা কীভাবে ওড়ায়, কে কত দলকে চান্দা দেয়, কারা কীভাবে নির্বাচনের ‘খাই-খরচা’ মেটায়, সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের (এফইসি) কাজ। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে দলের নিবন্ধনসূত্রে ও নির্বাচনী রিটার্ন দাখিলের নামে যেটুকু আয়-ব্যয়ের হিসাব নেওয়া হচ্ছে, তা নিতান্ত কাগুজে। দুই বছর ধরে দুই বড় দল তাদের কমবেশি চার-পাঁচ কোটি টাকার আয়-ব্যয়ের হিসাব গোপনীয়তা বজায় রেখে কমিশনে জমা দিয়েছে। কমিশনও তা গোপন রেখেছে। দুই দলের ব্যাংক হিসাব কোথায় কয়টি আছে, কারা তাতে টাকা দেয়, তা আমরা জানি না। অথচ এটা জানলে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ‘স্বার্থের সংঘাত’ ধরা পড়ে। বড় বড় রুই-কাতলা বড় চান্দা দিয়ে কীভাবে মন্ত্রিত্ব কিংবা বড় ব্যবসায় ডিল বাগিয়ে নিচ্ছে, আমরা তা জানতে পারি না।
ভারত ও পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার সম্পদ বিবরণ ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। ড. মনমোহনের পাঁচ কোটি ও গিলানির সম্পদ দুই লাখ রুপি। বাংলাদেশের এমন অফিশিয়াল ওয়েবসাইট নেই। সম্পদের বিবরণী প্রকাশে সরকারি দল নির্বাচনী অঙ্গীকার করেও কার্যত তা পূরণ করেনি।
গণমাধ্যমে, সভা-সেমিনারে, সুশীল সমাজের স্তোত্র পাঠে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নামের পঞ্চসালা প্রকল্পের কোরাস একটা মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এটা একটা ফাঁদ। আমরা সবাই সেই ফাঁদে পড়ে খাবি-খাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে কতগুলো মিডিয়া কত ঘণ্টা ও কী পরিমাণ বিনিয়োগ করেছিল, সে হিসাব কেউ রাখে না। এক দিনে ৩০০ আসনে নির্বাচন হলে এই মিডিয়া-মনোযোগ ৩০০ ভাগে ভাগ হবে।
আমাদের প্রচলিত রাজনীতি ও নির্বাচনী সংস্কৃতির উন্নতি করতে হলে, ওই ফাঁদ থেকে বেরোতে হলে ১৯৭৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস যে আইন করেছে, সেই আইন করতে হবে। ওই আইন বলেছে, এফইসির দায়িত্ব হবে রাজনৈতিক দলগুলোর খায়-খরচার তদারকি করা। আমরা সোনার হরিণের পেছনে ছুটছি। নির্বাচনে কালোটাকা বন্ধ করতে হবে। এটা যেন একটা মামাবাড়ির আবদার। আমরা এতটাই বাগাড়ম্বরে আসক্ত যে, নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির খেলা বন্ধের জিগির তুলি, কিন্তু তা প্রতিহত করতে কোনো পদ্ধতিগত পথ অবলম্বনের চিন্তাও করি না।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আর ‘ছাড়া গরু’ হিসেবে চলতে দেওয়া যাবে না। এর বার্ষিক আয়-ব্যয় বাংলাদেশের যেকোনো বৃহৎ কোম্পানির চেয়ে কম হবে না। তবে দলীয় চাঁদা ও তহবিল গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেই নির্বাচন কমিশনের কাজে পরিবর্তন আনতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের গত নির্বাচনে দলগুলোর ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে সভা ও পোস্টার ছাপানোর খরচ খাতায় লিখে তা কমিশনের কর্তাদের দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়েছিল। এরকম ব্যবস্থা বছরজুড়ে করতে হবে।
ব্যবসায়ী-শিল্পপতি গোষ্ঠী নিশ্চয় তার স্বার্থসিদ্ধির আশায় পার্টির ফান্ডে চাঁদা দিতে পারে। এবং সেটা দুনিয়ার সব গণতন্ত্রে কমবেশি ঘটে। একে বন্ধ করা যাবে না। যেটা করতে হবে সেটা হলো, এটা প্রকাশ করতে হবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ইতিমধ্যে হুঁশ হয়েছে। তারা দেখেছে, বাক্সভরা ভোট শান্তিতে গুনতে ও ঘোষণা দিতে পারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, স্বচ্ছতা ও সততা একটা সাংবাৎসরিক প্রক্রিয়া। তাই ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি গত ৬ ফেব্রুয়ারি চণ্ডীগড়ে বলেন, দলগুলোকে তাদের সম্পদের বিবরণী দিতে হবে। আর ভারতের মহাহিসাব নিরীক্ষককে দলগুলোর হিসাব নিরীক্ষা করতে হবে। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে অবিলম্বে চালু করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে না। শুধু ১২৮ অনুচ্ছেদের ৩ দফার আওতায় সংসদে একটি আইন পাস করতে হবে।
দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব ইন্ডিয়া ইতিমধ্যে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিরীক্ষা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমাদের এখানে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠানগতভাবে এখনো এ নিয়ে ভাবেনি। তবে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব বাংলাদেশ আইসিএবির সেক্রেটারি জানালেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল। তিনিও জানালেন, কমিশন নয়, এ বিষয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু কথাবার্তা চালিয়েছিলেন। কিন্তু এটা আর এগোয়নি।
নির্বাচন কমিশন যদি স্রেফ এক দিনের ভোট গ্রহণ ও তার ফল প্রকাশ করার দায়িত্ব পালনের ম্যান্ডেটসর্বস্ব সংস্থা হয়, তাহলে এ দেশ কখনোই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের টেকসই ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারবে না। পুরো বছর দলগুলোর কার্যক্রম নিজেদের মতো চলতে দিয়ে, হঠাৎ কয়েক সপ্তাহের জন্য সিনা টান করে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীমুক্ত নির্বাচন পাওয়ার আদিখ্যেতা ও সৎ প্রার্থী আবিষ্কারের উদ্বাহু নৃত্য বন্ধ করতে হবে।
কোনো নির্বাচন কমিশন বা কোনো নির্বাচনকালীন সরকার এতটা শক্তিশালী হতে পারে না, যাতে মনে হতে পারে দুই বড় দলের দ্বারা ধারাবাহিকভাবে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তারা আচানক বন্ধ করতে পারবে। বিদ্যমান আইন সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হলে কালোটাকা ও পেশিশক্তিনির্ভর যে মনোনয়ন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে বিরাট ধস নামারই কথা, কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক কায়েমি নেতৃত্বের কারণে সেটা ঘটছে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গঠনতন্ত্রে নির্বাচন কমিশন নামের শব্দ যে নেই, তা কিন্তু নয়। এখন দলীয় সংবিধান আর রাষ্ট্রের সংবিধানের মধ্যে একটা কার্যকর সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে। দলের সংবিধান এমনভাবে বাস্তবায়িত হতে পারবে না, যা প্রকারান্তরে জাতীয় সংবিধানের চেতনাকে নস্যাৎ কিংবা প্রত্যাখ্যান করে। দলীয় সংবিধানের আওতায় কোনো অবস্থাতেই অ্যাডহক ব্যবস্থা চলতে পারবে না। দুই দলের সংবিধান বর্তমানে যেটি যে অবস্থায় রয়েছে, সেটিকে ভোটাভুটিবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। ভোটাভুটির প্রক্রিয়ায় যাঁরা জিতে আসবেন, তাঁদের মধ্য থেকে আনুগত্য দেখানোর লোকের ঘাটতি পড়বে না। প্রতিটি পর্যায়ের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, নির্বাচন কমিশনের রেজিস্টারে নির্বাচিত জেলা ও উপজেলা কমিটির অস্তিত্ব থাকবে। এই ব্যবস্থা চালু না করা হলে বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন ত্বরান্বিত হবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকুক আর না-ই থাকুক, বাংলাদেশের সমাজের গণতন্ত্রায়ন ছাড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেঙে পড়া রোগ সারানো যাবে না। একটি নির্বাচিত সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদে নির্বাচন কমিশনকে বছরজুড়ে নানা স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হয়। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অপসারণ ঘটিয়ে কোনো বিকল্প রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি জনগণের সামনে উপস্থাপন করছে না। এতে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। আর এই শূন্যতার ফলে জনগণের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হতে পারছে না। অথচ সেটা খুবই প্রয়োজন।
ঢাকা মহানগর বিভক্তকরণে ‘জেরিম্যান্ডারিং’ (১৮১২ সালে বস্টনের গভর্নর সিনেটর জেরির রাজনৈতিক স্বার্থে নির্বাচনী এলাকা ভাগ করা থেকে নামকরণ) দেখছি, কিন্তু তাতে নতুন করে শুরুর একটা বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন নতুন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সাংগঠনিক জেলা গঠন করতে হবে। সুতরাং এখনই সুযোগ নির্বাচন কমিশনকে এই ভাঙচুর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা। এটি একটা পরীক্ষামূলক পাইলট মডেল হতে পারে। দুই দলের উচিত হবে নির্বাচন কমিশনকে নতুন সাংগঠনিক কমিটিগুলোর নির্বাচন করার দায়িত্ব দেওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে, অনাস্থার রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে, সেটা কাটিয়ে উঠতে তার উচিত হবে নির্বাচন কমিশনকে সাংগঠনিক দলীয় জেলা-উপজেলাগুলোর কমিটি নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা। আগামী ১০ বছর গোপন ব্যালটে দলীয় কমিটির নির্বাচনব্যবস্থা জেলা পর্যন্ত সীমিত রাখা যেতে পারে। ভোটার আইডির মতো দলগুলোর কর্মীদের জন্যও আইডি করে দেওয়ার মতো বিষয় ভাবা যায়। আইডি কার্ড ছাড়া দলগুলোকে ‘ছাড়া গরু’ মনে হয়। দুটো দলে খুব সহজেই সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিগ্রস্তরা সহজে মিশে যেতে পারছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ওই গাড়িবহরের ট্রাক ও বাসভর্তি ‘জনতা’ জোগাড় করে ‘ঐতিহাসিক’ সভা করার অপসংস্কৃতিতে আঘাত হানাই হতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের চাবিকাঠি। দলীয়, নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তীকালীন কিংবা জাতিসংঘের তদারকিতেই নির্বাচন হোক, ওই সংস্কৃতিটা না পাল্টালে আমরা নির্বাচিত স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উতরাতে পারব না।
নির্বাচন কমিশনের আসন্ন পুনর্গঠন, মানে তিন-চারটা মাথা যদি দুই বড় দলের মতৈক্যে একত্র করা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা ধেই ধেই করে নাচব। কিন্তু দরকার কমিশনের বর্তমান বাস্তব কার্যক্রমের খোলনলচে বদলে দেওয়া। যেটার মডেল হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইলেকশন কমিশন বা এফইসি।
গাড়িবহর ও মিছিল-সমাবেশ করতে এবং দল চালাতে টাকা লাগে। কালোটাকা শেয়ারবাজারে স্বাগত। দল চালাতেও স্বাগত। কিন্তু তার তথ্যটা জনগণের সামনে স্পষ্ট হতে হবে।
কোন দল কখন কত টাকা কীভাবে ওড়ায়, কে কত দলকে চান্দা দেয়, কারা কীভাবে নির্বাচনের ‘খাই-খরচা’ মেটায়, সেটাই যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচন কমিশনের (এফইসি) কাজ। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে দলের নিবন্ধনসূত্রে ও নির্বাচনী রিটার্ন দাখিলের নামে যেটুকু আয়-ব্যয়ের হিসাব নেওয়া হচ্ছে, তা নিতান্ত কাগুজে। দুই বছর ধরে দুই বড় দল তাদের কমবেশি চার-পাঁচ কোটি টাকার আয়-ব্যয়ের হিসাব গোপনীয়তা বজায় রেখে কমিশনে জমা দিয়েছে। কমিশনও তা গোপন রেখেছে। দুই দলের ব্যাংক হিসাব কোথায় কয়টি আছে, কারা তাতে টাকা দেয়, তা আমরা জানি না। অথচ এটা জানলে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ‘স্বার্থের সংঘাত’ ধরা পড়ে। বড় বড় রুই-কাতলা বড় চান্দা দিয়ে কীভাবে মন্ত্রিত্ব কিংবা বড় ব্যবসায় ডিল বাগিয়ে নিচ্ছে, আমরা তা জানতে পারি না।
ভারত ও পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার সম্পদ বিবরণ ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। ড. মনমোহনের পাঁচ কোটি ও গিলানির সম্পদ দুই লাখ রুপি। বাংলাদেশের এমন অফিশিয়াল ওয়েবসাইট নেই। সম্পদের বিবরণী প্রকাশে সরকারি দল নির্বাচনী অঙ্গীকার করেও কার্যত তা পূরণ করেনি।
গণমাধ্যমে, সভা-সেমিনারে, সুশীল সমাজের স্তোত্র পাঠে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নামের পঞ্চসালা প্রকল্পের কোরাস একটা মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এটা একটা ফাঁদ। আমরা সবাই সেই ফাঁদে পড়ে খাবি-খাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে কতগুলো মিডিয়া কত ঘণ্টা ও কী পরিমাণ বিনিয়োগ করেছিল, সে হিসাব কেউ রাখে না। এক দিনে ৩০০ আসনে নির্বাচন হলে এই মিডিয়া-মনোযোগ ৩০০ ভাগে ভাগ হবে।
আমাদের প্রচলিত রাজনীতি ও নির্বাচনী সংস্কৃতির উন্নতি করতে হলে, ওই ফাঁদ থেকে বেরোতে হলে ১৯৭৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস যে আইন করেছে, সেই আইন করতে হবে। ওই আইন বলেছে, এফইসির দায়িত্ব হবে রাজনৈতিক দলগুলোর খায়-খরচার তদারকি করা। আমরা সোনার হরিণের পেছনে ছুটছি। নির্বাচনে কালোটাকা বন্ধ করতে হবে। এটা যেন একটা মামাবাড়ির আবদার। আমরা এতটাই বাগাড়ম্বরে আসক্ত যে, নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির খেলা বন্ধের জিগির তুলি, কিন্তু তা প্রতিহত করতে কোনো পদ্ধতিগত পথ অবলম্বনের চিন্তাও করি না।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আর ‘ছাড়া গরু’ হিসেবে চলতে দেওয়া যাবে না। এর বার্ষিক আয়-ব্যয় বাংলাদেশের যেকোনো বৃহৎ কোম্পানির চেয়ে কম হবে না। তবে দলীয় চাঁদা ও তহবিল গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেই নির্বাচন কমিশনের কাজে পরিবর্তন আনতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের গত নির্বাচনে দলগুলোর ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে সভা ও পোস্টার ছাপানোর খরচ খাতায় লিখে তা কমিশনের কর্তাদের দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়েছিল। এরকম ব্যবস্থা বছরজুড়ে করতে হবে।
ব্যবসায়ী-শিল্পপতি গোষ্ঠী নিশ্চয় তার স্বার্থসিদ্ধির আশায় পার্টির ফান্ডে চাঁদা দিতে পারে। এবং সেটা দুনিয়ার সব গণতন্ত্রে কমবেশি ঘটে। একে বন্ধ করা যাবে না। যেটা করতে হবে সেটা হলো, এটা প্রকাশ করতে হবে।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ইতিমধ্যে হুঁশ হয়েছে। তারা দেখেছে, বাক্সভরা ভোট শান্তিতে গুনতে ও ঘোষণা দিতে পারাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, স্বচ্ছতা ও সততা একটা সাংবাৎসরিক প্রক্রিয়া। তাই ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি গত ৬ ফেব্রুয়ারি চণ্ডীগড়ে বলেন, দলগুলোকে তাদের সম্পদের বিবরণী দিতে হবে। আর ভারতের মহাহিসাব নিরীক্ষককে দলগুলোর হিসাব নিরীক্ষা করতে হবে। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশে অবিলম্বে চালু করতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে না। শুধু ১২৮ অনুচ্ছেদের ৩ দফার আওতায় সংসদে একটি আইন পাস করতে হবে।
দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব ইন্ডিয়া ইতিমধ্যে ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর নিরীক্ষা বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমাদের এখানে নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠানগতভাবে এখনো এ নিয়ে ভাবেনি। তবে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অব বাংলাদেশ আইসিএবির সেক্রেটারি জানালেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল। তিনিও জানালেন, কমিশন নয়, এ বিষয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু কথাবার্তা চালিয়েছিলেন। কিন্তু এটা আর এগোয়নি।
নির্বাচন কমিশন যদি স্রেফ এক দিনের ভোট গ্রহণ ও তার ফল প্রকাশ করার দায়িত্ব পালনের ম্যান্ডেটসর্বস্ব সংস্থা হয়, তাহলে এ দেশ কখনোই শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের টেকসই ব্যবস্থার জন্ম দিতে পারবে না। পুরো বছর দলগুলোর কার্যক্রম নিজেদের মতো চলতে দিয়ে, হঠাৎ কয়েক সপ্তাহের জন্য সিনা টান করে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীমুক্ত নির্বাচন পাওয়ার আদিখ্যেতা ও সৎ প্রার্থী আবিষ্কারের উদ্বাহু নৃত্য বন্ধ করতে হবে।
কোনো নির্বাচন কমিশন বা কোনো নির্বাচনকালীন সরকার এতটা শক্তিশালী হতে পারে না, যাতে মনে হতে পারে দুই বড় দলের দ্বারা ধারাবাহিকভাবে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি তারা আচানক বন্ধ করতে পারবে। বিদ্যমান আইন সঠিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হলে কালোটাকা ও পেশিশক্তিনির্ভর যে মনোনয়ন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে বিরাট ধস নামারই কথা, কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক কায়েমি নেতৃত্বের কারণে সেটা ঘটছে না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গঠনতন্ত্রে নির্বাচন কমিশন নামের শব্দ যে নেই, তা কিন্তু নয়। এখন দলীয় সংবিধান আর রাষ্ট্রের সংবিধানের মধ্যে একটা কার্যকর সম্পর্ক সৃষ্টি করতে হবে। দলের সংবিধান এমনভাবে বাস্তবায়িত হতে পারবে না, যা প্রকারান্তরে জাতীয় সংবিধানের চেতনাকে নস্যাৎ কিংবা প্রত্যাখ্যান করে। দলীয় সংবিধানের আওতায় কোনো অবস্থাতেই অ্যাডহক ব্যবস্থা চলতে পারবে না। দুই দলের সংবিধান বর্তমানে যেটি যে অবস্থায় রয়েছে, সেটিকে ভোটাভুটিবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। ভোটাভুটির প্রক্রিয়ায় যাঁরা জিতে আসবেন, তাঁদের মধ্য থেকে আনুগত্য দেখানোর লোকের ঘাটতি পড়বে না। প্রতিটি পর্যায়ের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, নির্বাচন কমিশনের রেজিস্টারে নির্বাচিত জেলা ও উপজেলা কমিটির অস্তিত্ব থাকবে। এই ব্যবস্থা চালু না করা হলে বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন ত্বরান্বিত হবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকুক আর না-ই থাকুক, বাংলাদেশের সমাজের গণতন্ত্রায়ন ছাড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেঙে পড়া রোগ সারানো যাবে না। একটি নির্বাচিত সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদে নির্বাচন কমিশনকে বছরজুড়ে নানা স্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হয়। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অপসারণ ঘটিয়ে কোনো বিকল্প রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি জনগণের সামনে উপস্থাপন করছে না। এতে শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। আর এই শূন্যতার ফলে জনগণের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হতে পারছে না। অথচ সেটা খুবই প্রয়োজন।
ঢাকা মহানগর বিভক্তকরণে ‘জেরিম্যান্ডারিং’ (১৮১২ সালে বস্টনের গভর্নর সিনেটর জেরির রাজনৈতিক স্বার্থে নির্বাচনী এলাকা ভাগ করা থেকে নামকরণ) দেখছি, কিন্তু তাতে নতুন করে শুরুর একটা বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এখন নতুন করে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের সাংগঠনিক জেলা গঠন করতে হবে। সুতরাং এখনই সুযোগ নির্বাচন কমিশনকে এই ভাঙচুর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা। এটি একটা পরীক্ষামূলক পাইলট মডেল হতে পারে। দুই দলের উচিত হবে নির্বাচন কমিশনকে নতুন সাংগঠনিক কমিটিগুলোর নির্বাচন করার দায়িত্ব দেওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করে জনগণের মধ্যে আওয়ামী লীগ যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে, অনাস্থার রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করেছে, সেটা কাটিয়ে উঠতে তার উচিত হবে নির্বাচন কমিশনকে সাংগঠনিক দলীয় জেলা-উপজেলাগুলোর কমিটি নির্বাচনে সম্পৃক্ত করা। আগামী ১০ বছর গোপন ব্যালটে দলীয় কমিটির নির্বাচনব্যবস্থা জেলা পর্যন্ত সীমিত রাখা যেতে পারে। ভোটার আইডির মতো দলগুলোর কর্মীদের জন্যও আইডি করে দেওয়ার মতো বিষয় ভাবা যায়। আইডি কার্ড ছাড়া দলগুলোকে ‘ছাড়া গরু’ মনে হয়। দুটো দলে খুব সহজেই সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিগ্রস্তরা সহজে মিশে যেতে পারছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments