সরকার আলুচাষির স্বার্থ দেখবে না?-কৃষি by শরিফুজ্জামান শরিফ

আলুচাষিদের তালিকা কৃষি মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষণ করতে হবে এবং চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিকে আলু চাষের আওতাভুক্ত করতে হবে। হিমাগার নির্মাণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাতে হবে। সব ধরনের ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে এবং হিমাগারে ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ ও ডিজেল সরবরাহ করতে হবে আলু আমাদের খাদ্য তালিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। আলু উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ঢাকার পার্শ্ববর্তী মুন্সীগঞ্জ ও উত্তরাঞ্চলের রংপুর ও দিনাজপুর জেলা।


এর বাইরেও উত্তরের কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও বগুড়া জেলায় কমবেশি আলু উৎপাদিত হয়। গত বছর উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে তিন লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছিল। সে তুলনায় এবার আলুর আবাদ কম। তারপরও যারা পরিশ্রম করে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে লাভের আশায় আলু চাষ করেছেন তাদের স্বপ্ন এবারও যে পূরণ হবে না, গণমাধ্যম তার খবর দিচ্ছে। কয়েক বছর ধরে আলু চাষ, সংরক্ষণ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা বলা হলেও সমস্যাটির যে সমাধান হয়নি, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। মনে রাখা দরকার, আলু উৎপাদনের মতো সংরক্ষণ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি উন্নয়নের উপকরণে ভর্তুকি প্রদানই যথেষ্ট নয়। পূর্বাপর আরও কতগুলো পদক্ষেপ অপরিহার্য। কেননা, উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি উৎপাদক ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি এবং এর জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার দরকার। যদিও অনেক সময় শুধু উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অন্যান্য সমস্যা চিহ্নিত হয় না; সমাধানের চেষ্টাও হয় না। যতটুকু জানা যায়, দেশে প্রায় ৩৫০টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু চাহিদার তুলনায় হিমাগারের সংখ্যা অপ্রতুল। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে চাষিদের অভিযোগ রয়েছে। তবে কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি, এই অভিযোগগুলো কতটা সত্য; সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া তো পরের বিষয়। তা ছাড়া যারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এই হিমাগার গড়ে তুলেছেন, তারাও নানা বিড়ম্বনার শিকার। বিদ্যুৎ ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ, ভ্যাট, বস্তার মূল্য বৃদ্ধিসহ নানা কারণে হিমাগার পরিচালনার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিভিত্তিক এই শিল্পটি যারা গড়ে তুলছেন, তাদের জন্য কোনো সহায়তা নেই। আমাদের দেশের সরকারি প্রণোদনা কেবল তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের জন্য! আলুবীজ নিয়েও প্রতি বছরের সংকটের কথা আমরা শুনি। বিএডিসির মাধ্যমে উন্নতমানের বীজ সরবরাহের দাবিটি বারবার উচ্চারিত হওয়ার অর্থ হলো, সমস্যাটি এখনও বহাল। একই সঙ্গে হিমাগারগুলোতে চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ না করার কারণে আলু সংরক্ষণে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন কবে হবে, তা কেউ বলতে পারে না। এসব সমস্যা নিরসনে নানা মহল থেকে কতগুলো সুপারিশ উচ্চারিত হয়েছে। যেমন, সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নির্ধারিত মূল্যে যেভাবে ধান-চাল ক্রয় ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে, আলুর ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। যদিও ধান ও গমের পরে আলু আমাদের প্রধান খাদ্য। তাই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায় কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে। আমরা জানি, সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি 'আলু উপদেষ্টা বোর্ড' রয়েছে, যা আসলে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই বোর্ডকে সক্রিয় করা এবং জরুরি ভিক্তিতে কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আলুচাষি, হিমাগার মালিকদের প্রতিনিধি নিয়ে অর্থবহ এবং সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে আলু সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারকে আগামী বাজেটের মধ্য দিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে এখনি পরিকল্পনা নিতে হবে। আলুচাষি ও ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ ও সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে বর্তমান কৃষি উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য জরুরিভাবে সামগ্রিক কৃষি সংস্কার কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
জানতে পেরেছি, আলুচাষিরা গত বছরের আলু নিয়ে এখনও বিপাকে। পরিচালনা ব্যয় বাড়ার কারণে হিমাগারের ভাড়া বেড়েছে। ফলে অনেক চাষি হিমাগার থেকে আলু বের করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এদিকে, গত বছর আলুর ন্যায্যমূল্য না পেয়ে আলুচাষিরা লাভের আশায় এবার আগাম আলুর চাষ করেন। ইতিমধ্যে বাজারে এসেছে নতুন আলু। তাই পুরনো আলুর চাহিদা কম। তারপরও নাটোর, রংপুর, বগুড়ায় যে আলু কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৪ টাকা, রাজধানীতে সে আলু ক্রেতাকে কিনে খেতে হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়। আর নতুন আলু যেখানে বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে ৭ টাকা, রাজধানীতে তা বিক্রি হচ্ছে ১৫-১৬ টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে , মূল্যে এত ফারাক কেন? মাঝের টাকাটা যাচ্ছে কোথায়? সরকারের বাজারের মনিটরিং সংস্থা করছেটা কী? সরকার আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। সঙ্গত কারণেই হিমাগারের মালিকরা ভাড়া বাড়াবেন। ফলে নতুন আলুর ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে বা হিমাগারে আলু সংরক্ষণে যে ভাড়া বাড়বে, তা অনুমেয়। এ অবস্থায় আলুচাষিদের সমস্যা সমাধানে সরকারের করণীয় : উৎপাদন খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলুর মূল্য নির্ধারণ করতে হবে এবং এর মূল্যে যেন ধস না নামে সে জন্য সরকারকে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। অধিক পরিমাণে হিমাগার স্থাপন করে দীর্ঘ মেয়াদে আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; হিমাগারের ভাড়া কমাতে হবে এবং সংরক্ষণ করা আলু নষ্ট হয়ে গেলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
যেসব দেশে আলুর চাহিদা ও ঘাটতি আছে সেসব দেশে আলু রফতানির বাজার খুঁজতে হবে এবং রফতানির ওপর জোর দিতে হবে।
আলুচাষিদের তালিকা কৃষি মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষণ করতে হবে এবং চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিকে আলু চাষের আওতাভুক্ত করতে হবে।
হিমাগার নির্মাণে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাতে হবে। সব ধরনের ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে এবং হিমাগারে ভর্তুকি মূল্যে বিদ্যুৎ ও ডিজেল সরবরাহ করতে হবে।
হিমাগারের প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে।

শরিফুজ্জামান শরিফ :সাধারণ সম্পাদক
নাগরিক সংহতি ও কলাম লেখক
citizen.solidarity@gamil.com

No comments

Powered by Blogger.