সরকার পারছে না দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতেঃ এ ব্যর্থতা স্ব-আরোপিত
দ্রব্যমূল্য হ্রাসের প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তাদের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথমবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার করে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আশা জাগাতে না পারলেও সরকার দুটি ক্ষেত্রে বৃদ্ধির সাফল্য দাবি করতে পারে।
ক্ষেত্র দুটি হচ্ছে দ্রব্যমূল্য এবং অপরাধ। দুটিই কমানোর অঙ্গীকার করে আওয়ামী মহাজোট ভোটযুদ্ধে নেমেছিল। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই বাস্তবচিত্র তাদের অঙ্গীকারের এতটা বিপরীত যে, মন্ত্রীরা গলাবাজি করেও জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারছে না; কারণ তারাই পরিস্থিতির সবচেয়ে করুণ শিকার। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দ্রব্যমূল্যের যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা হুবহু তুলে ধরে গতকাল আমার দেশ প্রথম পাতায় একটি খবর ছেপেছে। তাতে দেখা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দামই গত এক বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিন বছর আগের চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিনগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হলে কোনো কোনো পণ্যের দাম শতকরা একশ’ থেকে তিনশ’ ভাগ পর্যন্ত বেড়েছে। এক বছর আগের ৩০ টাকা কেজির চিনির দাম বর্তমান সরকারের আমলে সিন্ডিকেট করে ৭০ টাকা কেজিতে ওঠানো হয়েছিল। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫১ থেকে ৫৪ টাকা কেজি দরে। মসুর ডালের দাম ৩ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে শতকরা ১৬০ ভাগ। আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেয়ার আগের দিন যে রসুনের দাম ছিল ২৪ টাকা কেজি, সেটা এখন ১১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। শতকরা হিসাবে ২১২ ভাগ দাম বেড়েছে রসুনের। বৃহস্পতিবার বাজার দর সম্পর্কে টিসিবির সর্বশেষ রিপোর্টে ৪৯টি পণ্যের উল্লেখ আছে। তার মধ্যে ৩৭টির দাম বেড়েছে গত এক মাসে। মোটা চাল আর আটার দাম কমে যাওয়া বর্তমান সরকারের জন্য একটি গর্বের ব্যাপার ছিল। কিন্তু কয়েক মাস দাম কম থাকার পর এখন উভয় পণ্যের মূল্যই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
টিসিবি একটি সরকারি সংস্থা। আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানটি সব সময় দ্রব্যমূল্য বাস্তবের চেয়ে কিছুটা কম দেখায়। সেই কম দেখানো প্রতিবেদনেই যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে সত্য বলে স্বীকার করে নেয়া হয় তখন আর ব্যাপারটিকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক’, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে নাকচ করার কোনো সুযোগ থাকে না। আর যারা নিয়মিত বাজারে যান তাদের জন্য দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কশাঘাত এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা। দ্রব্যমূল্য বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান আগে প্রায়ই দৃঢ় ব্যবস্থা নেয়ার হুংকার ছাড়তেন। ইদানিং তিনিও নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। দেখে মনে হয়, দ্রব্যমূল্য নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো কোনো লোক সরকারের মধ্যে নেই। ভোক্তাসাধারণ একশ্রেণীর মুনাফাশিকারি ব্যবসায়ীর হাতে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়েছে। আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়ে যাওয়া এবং শীতকালীন শাকসব্জির অঢেল সরবরাহ সত্ত্বেও দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা না যাওয়া প্রমাণ করে, একটি বিশেষ মহলের কারসাজিতে এসব ঘটছে। আসলে ভোক্তারা বেশি দাম দিলেও উত্পাদকরা কিন্তু লাভবান হচ্ছে না। লাভের গুড় মধ্যস্বত্বভোগীদের পেটে চলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকার এসব মধ্যস্বত্বভোগীকে শায়েস্তা করছে না কেন? এই কেনর একমাত্র উত্তর, মুনাফাখোর মধ্যস্বত্বভোগীরা সবাই রাতারাতি ভোল পাল্টে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক’ বনে গেছে। ঘাটে ঘাটে জোর করে চাঁদা তুলে যারা পরিবহন খরচ বাড়াচ্ছে তারাও নিয়েছে একই কৌশল। এর সঙ্গে অরিজিনাল আওয়ামী চাঁদাবাজরা তো আছেই। অনেককে ‘সন্তুষ্ট’ করে ব্যবসা করতে হয় বলে ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম ইচ্ছামত বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যায়। অন্যকে সন্তুষ্ট করা যখন বাধ্যতামূলক, সে অবস্থায় ব্যবসায়ী নিজে ‘সন্তুষ্ট’ হবে না তেমন আশা না করাই ভালো। সব মিলিয়ে চাপটা এসে পড়ছে শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ঘাড়ে। সাধারণ মানুষকে এই চাপ থেকে মুক্ত করার অঙ্গীকার নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। এক বছর শেষ হতে চলল। কিন্তু অঙ্গীকার রক্ষার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তার জন্য বিব্রত ভাবও নেই সরকারের কারও মধ্যে। তাই অবস্থা দেখে মনে হয়, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের এই ব্যর্থতা স্ব-আরোপিত। কারণ এর অন্যথা ঘটলে নিজের ভাগও যে মার যায়!
No comments