মার্কিনের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসই বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতার বিস্তার ঘটিয়েছে-সমকালীন প্রসঙ্গ by বদরুদ্দীন উমর
২০০০ সালে জর্জ ডবি্লউ বুশ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে বিশ্বজুড়ে যেভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এর কাছাকাছি কোনো অবস্থাও আগে ছিল না। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংস এবং ওয়াশিংটনে পেন্টাগনের ট্রেড কোয়াটার্সে বিমান হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে প্রথমে আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল, পরে ইরাক আক্রমণ এবং দখলের অজুহাত ও সুযোগ সৃষ্টি হয়।
৯/১১-এর ঘটনার হোতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট বুশ কোনো তদন্ত বা প্রমাণের অপেক্ষা বা পরোয়া না করে আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে ঘটনার পরমুহূর্ত থেকেই অভিযুক্ত করে তাদের বিশ্বজোড়া প্রচার-প্রচারণা চালান, যা আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। প্রকৃতপক্ষে এই বিশাল প্রচারণার সবটাই দাঁড় করানো হয়েছিল সম্পূর্ণ মিথ্যার ওপর। এ বিষয়ে ওই সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ৯/১১-এর দশম বার্ষিকী উপলক্ষে যা বলেছেন তার মধ্যেই এর সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে তাকে একটু বিস্তারিতভাবে এখানে উদ্ধৃত করা দরকার।
কলিন পাওয়েল বলেন, '২০০১ সালের হামলার পর মার্কিন সরকার প্রথমে আফগানিস্তান ও পরে ইরাকে হামলা চালায়। নিউইয়র্কে হামলার সঙ্গে জড়িত থাকা ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র রাখার মিথ্যা অভিযোগে ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালায় মার্কিন বাহিনী। এ দুটি দেশেই হামলা চালানোর জন্য সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মার্কিন সরকারকে অন্ধ সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইরাকে একটিও গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পেঁৗছানোর মতো সুস্পষ্ট কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বরং আল কায়দা দমনের নামে বিশ্বের কয়েকটি মুসলিম দেশে হামলা চালিয়ে তা দখল করে নিয়েছে এবং এতে লাখ লাখ মুসলমান নিহত হয়েছে। তাছাড়া কথিত আল কায়দার তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেনের কোনো সাধারণ নাগরিক নিহত হচ্ছে না এবং তাদের সরাসরি কোনো আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে না। উল্টো ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো দেশকে প্রতিদিন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে' (এএফপি, দৈনিক সকালের খবর, ১২.৯.২০১১)।
ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণের জন্য যেসব মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য তিনি নিজে ও মার্কিন সরকার ব্যবহার করেছিল তাকে নিজের জীবনের একটা কলঙ্কজনক ঘটনা বলে অভিহিত করে কলিন পাওয়েল দুঃখ প্রকাশ করেন! যে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিবের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করে যুদ্ধ চালানো এবং আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করা হয়েছিল, সেই জেনারেল কলিন পাওয়েলের এহেন স্বীকারোক্তি চোখ খুলে দেওয়ার মতো একটি ব্যাপার। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, পাওয়েলের এই বক্তব্য এএফপি প্রচার করলেও এর প্রচার যেভাবে হওয়া দরকার তা হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রচারমাধ্যম এই বক্তব্য প্রচার না করে মানবতার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অপরাধকে আড়ালে রাখার চেষ্টা চলছে। শুধু তাই নয়, ৯/১১-এর দশম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ সম্পর্কে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণায় সংবাদমাধ্যম এখন যথেষ্ট সরগরম আছে।
শুধু কলিন পাওয়েলই নয়, ৯/১১ উপলক্ষে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ তার ব্যক্তিগত ব্লগে বলেছেন, ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশ মিথ্যা বলেছেন। এ ঘটনা অন্য কোনো গোষ্ঠীর কাজ বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ক্ষুব্ধ আরব মুসলমানরা জীবন দিয়ে বোমা হামলা করতে পারে। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের মতো বিশাল আকারের হামলা চালানোর পরিকল্পনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ধরনের হামলার জন্য অনেক সময় ধরে পরিকল্পনা করতে হয়েছে (দৈনিক সকালের খবর, ১২.৯.২০১১)।
এ বছর ৯/১১ সম্পর্কে খোদ তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ও মাহাথির মোহাম্মদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ অন্য কেউ কেউ এসব কথা বললেও এগুলো কোনো নতুন কথা নয়। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে এই ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন বেসরকারি মার্কিন এবং ইউরোপীয় মহলে একই কথা বলা হয়েছিল। আমি নিজেও এর ওপর বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ তখন সংবাদপত্রে লিখেছিলাম। আসলে ৯/১১-এর ঘটনা ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা সংঘটিত। এই ঘটনা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করে পরিকল্পিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণ ও দখল করেছিল। শুধু তাই নয়, ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়দাকে ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী করে তারা বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস দমনের নামে এমন এক কর্মসূচি চালু করে, সেটাও ছিল তাদের পূর্ব পরিকল্পিত। প্রথমেই বলা হয়েছে যে, ৯/১১-এর ঘটনার পর থেকে সারা দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ও সন্ত্রাসী তৎপরতা দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করেছে। এই তৎপরতা এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। সন্ত্রাস নিয়ে এখন যেভাবে মাতামাতি শুরু হয়েছে তাতে দুনিয়ার অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাই ধামাচাপা পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী চুক্তি করছে, সন্ত্রাসকে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির এক নম্বরে স্থান দিয়ে বিশাল আকারে এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। ৯/১১-এর ঘটনাকে তারা যে শুধু আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণের অজুহাত হিসেবেই ব্যবহার করেছে তাই নয়। নিরাপত্তার প্রয়োজন সৃষ্টি করে তারা যে শুধু বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অধিকতর হারে অস্ত্র কিনতে প্ররোচিত ও বাধ্য করছে তাই নয়, সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটিয়ে রাষ্ট্রের বাইরেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে থাকা বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকেও বিশাল আকারে অস্ত্র কেনার জন্য তারা প্ররোচিত ও বাধ্য করছে। তেলের স্বার্থ যেহেতু এ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার মূল কারণ এবং এই তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো প্রধানত মুসলমান অধ্যুষিত সে কারণে এই দেশগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নানাভাবে জারি আছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় এই দেশগুলোতে মুসলমানরাও নানা ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুলছে। জনগণের পক্ষ থেকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই দেশগুলোতে কমিউনিস্ট বা বামপন্থি কোনো দলের কার্যকর উপস্থিতি না থাকায় ধর্মীয় মৌলবাদীরাই এই বিক্ষোভ ও বিরোধিতাকে ধারণ এবং প্রতিরোধকে পরিচালনা করছে। কোনো গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল নেতৃত্বের অনুপস্থিতি ও অভাবে এই প্রতিরোধ সন্ত্রাসের পক্ষে পরিচালিত হচ্ছে এবং এভাবে এই প্রতিরোধ পরিচালনার ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নানা ধরনের কলকাঠি নাড়ছে। এটা বোঝা দরকার যে, জর্জ ডবি্লউ বুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর, বিশেষত ৯/১১-এর ঘটনার পর থেকেই দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সংখ্যা ও সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ, এই সন্ত্রাসবাদ সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই ফলাফল। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এ পরিস্থিতি তৈরি করে পশ্চাৎপদ ও দুর্বল দেশগুলোর সম্পদ লুণ্ঠন করছে এবং জনগণের ওপর শোষণ-নির্যাতনের মাত্রা অদৃষ্টপূর্বভাবে বৃদ্ধি করছে। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বিশ্বের সব থেকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী চুক্তির পর চুক্তি করে যাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে এসব দেশে অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করলেও নিজেদের শান্তির দূত হিসেবে প্রচার করতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না!
প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন দেশে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো গড়ে ওঠার শর্ত তৈরি করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে এই সংগঠনগুলো গড়ে তোলার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তারা বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিপন্ন করছে। তারা যেভাবে এ কাজ করে এসেছে তাতে এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এখন তাদেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে তাদের নিরাপত্তাকেও বিপন্ন করছে। কোনো দেশেই তারা এখন নিরাপদ নয়। নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এখন তাদের নিজেদেরও পাগলের মতো অবস্থা। প্রকৃতপক্ষে তাদের নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের দ্রুত ধ্বংসের শর্তকেই পরিপকস্ফ করবে এবং তাদের নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা কেড়ে নিয়ে জীবনকে নির্বিঘ্ন করার পরিবর্তে ব্যাপকভাবে বিঘি্নত করবে। তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি তাদের বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ নেবে। এটা এখন আর কোনো জল্পনা-কল্পনার বিষয় নয়। এ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
১২.৯.২০১১
কলিন পাওয়েল বলেন, '২০০১ সালের হামলার পর মার্কিন সরকার প্রথমে আফগানিস্তান ও পরে ইরাকে হামলা চালায়। নিউইয়র্কে হামলার সঙ্গে জড়িত থাকা ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র রাখার মিথ্যা অভিযোগে ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালায় মার্কিন বাহিনী। এ দুটি দেশেই হামলা চালানোর জন্য সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মার্কিন সরকারকে অন্ধ সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইরাকে একটিও গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল সে সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পেঁৗছানোর মতো সুস্পষ্ট কোনো তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। বরং আল কায়দা দমনের নামে বিশ্বের কয়েকটি মুসলিম দেশে হামলা চালিয়ে তা দখল করে নিয়েছে এবং এতে লাখ লাখ মুসলমান নিহত হয়েছে। তাছাড়া কথিত আল কায়দার তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেনের কোনো সাধারণ নাগরিক নিহত হচ্ছে না এবং তাদের সরাসরি কোনো আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে না। উল্টো ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো দেশকে প্রতিদিন ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে' (এএফপি, দৈনিক সকালের খবর, ১২.৯.২০১১)।
ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণের জন্য যেসব মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্য তিনি নিজে ও মার্কিন সরকার ব্যবহার করেছিল তাকে নিজের জীবনের একটা কলঙ্কজনক ঘটনা বলে অভিহিত করে কলিন পাওয়েল দুঃখ প্রকাশ করেন! যে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিবের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করে যুদ্ধ চালানো এবং আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করা হয়েছিল, সেই জেনারেল কলিন পাওয়েলের এহেন স্বীকারোক্তি চোখ খুলে দেওয়ার মতো একটি ব্যাপার। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, পাওয়েলের এই বক্তব্য এএফপি প্রচার করলেও এর প্রচার যেভাবে হওয়া দরকার তা হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রচারমাধ্যম এই বক্তব্য প্রচার না করে মানবতার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অপরাধকে আড়ালে রাখার চেষ্টা চলছে। শুধু তাই নয়, ৯/১১-এর দশম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ সম্পর্কে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণায় সংবাদমাধ্যম এখন যথেষ্ট সরগরম আছে।
শুধু কলিন পাওয়েলই নয়, ৯/১১ উপলক্ষে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ তার ব্যক্তিগত ব্লগে বলেছেন, ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশ মিথ্যা বলেছেন। এ ঘটনা অন্য কোনো গোষ্ঠীর কাজ বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ক্ষুব্ধ আরব মুসলমানরা জীবন দিয়ে বোমা হামলা করতে পারে। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের মতো বিশাল আকারের হামলা চালানোর পরিকল্পনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ধরনের হামলার জন্য অনেক সময় ধরে পরিকল্পনা করতে হয়েছে (দৈনিক সকালের খবর, ১২.৯.২০১১)।
এ বছর ৯/১১ সম্পর্কে খোদ তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ও মাহাথির মোহাম্মদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ অন্য কেউ কেউ এসব কথা বললেও এগুলো কোনো নতুন কথা নয়। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে এই ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন বেসরকারি মার্কিন এবং ইউরোপীয় মহলে একই কথা বলা হয়েছিল। আমি নিজেও এর ওপর বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ তখন সংবাদপত্রে লিখেছিলাম। আসলে ৯/১১-এর ঘটনা ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা সংঘটিত। এই ঘটনা অজুহাত হিসেবে দাঁড় করে পরিকল্পিতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণ ও দখল করেছিল। শুধু তাই নয়, ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়দাকে ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলার জন্য দায়ী করে তারা বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস দমনের নামে এমন এক কর্মসূচি চালু করে, সেটাও ছিল তাদের পূর্ব পরিকল্পিত। প্রথমেই বলা হয়েছে যে, ৯/১১-এর ঘটনার পর থেকে সারা দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ও সন্ত্রাসী তৎপরতা দ্রুত বৃদ্ধি লাভ করেছে। এই তৎপরতা এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তাও হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। সন্ত্রাস নিয়ে এখন যেভাবে মাতামাতি শুরু হয়েছে তাতে দুনিয়ার অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাই ধামাচাপা পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী চুক্তি করছে, সন্ত্রাসকে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির এক নম্বরে স্থান দিয়ে বিশাল আকারে এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। ৯/১১-এর ঘটনাকে তারা যে শুধু আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণের অজুহাত হিসেবেই ব্যবহার করেছে তাই নয়। নিরাপত্তার প্রয়োজন সৃষ্টি করে তারা যে শুধু বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অধিকতর হারে অস্ত্র কিনতে প্ররোচিত ও বাধ্য করছে তাই নয়, সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটিয়ে রাষ্ট্রের বাইরেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠতে থাকা বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকেও বিশাল আকারে অস্ত্র কেনার জন্য তারা প্ররোচিত ও বাধ্য করছে। তেলের স্বার্থ যেহেতু এ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতার মূল কারণ এবং এই তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো প্রধানত মুসলমান অধ্যুষিত সে কারণে এই দেশগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নানাভাবে জারি আছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় এই দেশগুলোতে মুসলমানরাও নানা ধরনের সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুলছে। জনগণের পক্ষ থেকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই দেশগুলোতে কমিউনিস্ট বা বামপন্থি কোনো দলের কার্যকর উপস্থিতি না থাকায় ধর্মীয় মৌলবাদীরাই এই বিক্ষোভ ও বিরোধিতাকে ধারণ এবং প্রতিরোধকে পরিচালনা করছে। কোনো গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল নেতৃত্বের অনুপস্থিতি ও অভাবে এই প্রতিরোধ সন্ত্রাসের পক্ষে পরিচালিত হচ্ছে এবং এভাবে এই প্রতিরোধ পরিচালনার ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নানা ধরনের কলকাঠি নাড়ছে। এটা বোঝা দরকার যে, জর্জ ডবি্লউ বুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর, বিশেষত ৯/১১-এর ঘটনার পর থেকেই দুনিয়ায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সংখ্যা ও সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ, এই সন্ত্রাসবাদ সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই ফলাফল। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে এ পরিস্থিতি তৈরি করে পশ্চাৎপদ ও দুর্বল দেশগুলোর সম্পদ লুণ্ঠন করছে এবং জনগণের ওপর শোষণ-নির্যাতনের মাত্রা অদৃষ্টপূর্বভাবে বৃদ্ধি করছে। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বিশ্বের সব থেকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী চুক্তির পর চুক্তি করে যাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে এসব দেশে অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি করলেও নিজেদের শান্তির দূত হিসেবে প্রচার করতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না!
প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন দেশে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো গড়ে ওঠার শর্ত তৈরি করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে এই সংগঠনগুলো গড়ে তোলার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে তারা বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিপন্ন করছে। তারা যেভাবে এ কাজ করে এসেছে তাতে এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো এখন তাদেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে তাদের নিরাপত্তাকেও বিপন্ন করছে। কোনো দেশেই তারা এখন নিরাপদ নয়। নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এখন তাদের নিজেদেরও পাগলের মতো অবস্থা। প্রকৃতপক্ষে তাদের নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যা শেষ পর্যন্ত তাদের দ্রুত ধ্বংসের শর্তকেই পরিপকস্ফ করবে এবং তাদের নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা কেড়ে নিয়ে জীবনকে নির্বিঘ্ন করার পরিবর্তে ব্যাপকভাবে বিঘি্নত করবে। তাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি তাদের বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ নেবে। এটা এখন আর কোনো জল্পনা-কল্পনার বিষয় নয়। এ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
১২.৯.২০১১
No comments