চারদিক-হেমন্তে ব্রহ্মপুত্রের তীরে

জার্মান কবি হোল্ডার্লিন ঈশ্বরের কাছে একটি ‘প্রকৃত হেমন্ত’ ঋতু চেয়েছিলেন, যার বদলে তিনি ৪০ বছর পাগলা গারদে কাটাতে রাজি ছিলেন। বাংলা আধুনিক কবিতার প্রকৃত কায়া নির্মাণ যাঁর হাতে হয়েছে, সেই জীবনানন্দ দাশ ঋতু সমগ্রের মাঝে মুখ্যত হেমন্তেরই উপাসক ছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ‘কুহেলী বিলীন ভূষণ বিহীন’ হেমন্তকে নিয়ে গান রচনা করেছেন। এমনই ‘কুহেলী বিলীন’ হেমন্তের শুরুতে সম্প্রতি যাওয়া হয়েছিল ময়মনসিংহে।


তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো নদী দক্ষিণ তিব্বত থেকে হিমালয় হয়ে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে দিহাং নাম ধারণ করে আসাম হয়ে বাংলাদেশে আসতে আসতে ব্রহ্মপুত্র নদ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ, তবে ক্ষীণকায় এই নদ কিন্তু চোখ জুড়াল প্রথম দর্শনেই। নদের তীরে প্রচুর গাছ আর সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ। আর এসবের চেয়েও বড় পাওয়া হলো নদের তীরেই ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা’ ঘুরে দেখা।
১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল তেলচিত্র ও রেখাচিত্রসহ শিল্পীর মোট ৭০টি চিত্রকর্ম নিয়ে এই সংগ্রহশালা যাত্রা শুরু করে। তদানীন্তন অবিভক্ত ভারত তথা বাংলার বৃহত্তর ময়মনসিংহেই ১৯১৪ সালে শিল্পীর জন্ম। ব্রহ্মপুত্র ছিল তাঁর প্রিয় নদ। যে নদের তীরে বসে তিনি প্রচুর ছবি এঁকেছেন। ১৯৩৩ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া, ১৯৪৩-এ মন্বন্তরের ছবি এঁকে বিখ্যাত হওয়া, দেশভাগের পর ঢাকায় ফিরে এসে চিত্রশিল্পীর অনুধ্যানী জীবনের পাশাপাশি ঢাকায় আর্ট বা চারুকলা স্কুল (বর্তমানে যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ নামে পরিচিত) গড়ে তোলা এবং ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’ নামে একটি শিল্পী সংস্থা গড়ে তোলা, দেশে-বিদেশে নিরন্তর ভ্রমণ তথা জীবনের বহু স্তর প্রব্রজ্যার মধ্যেও ব্রহ্মপুত্র নদ ও নদ-তীরবর্তী জন্ম শহরকে ভোলেননি তিনি। তাই ময়মনসিংহ শহরের পুরোনো ব্রিটিশ বাসিন্দা জনৈক মি. বার্ডেনের ছেড়ে যাওয়া বাড়িটিকেই একটি চিত্র সংগ্রহশালায় পরিণত করার কাজে মন দিলেন শিল্পী তাঁর জীবনের শেষভাগে এসে। ১৯৮২ সালে অত্যন্ত পরিতাপজনকভাবে হলেও এই সংগ্রহশালার ৭৭টি চিত্রকর্মের মধ্যে ১৭টি চিত্রকর্ম চুরি হয়ে যায়। ১৯৯৪ সাল নাগাদ হারিয়ে যাওয়া ছবিগুলোর ১০টি পুনরুদ্ধার করা হয়। ১৯৯৯ সালে ঢাকার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘর এই সংগ্রহশালার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। বর্তমানে এই আর্কাইভে ৫৩টি তেলচিত্র রয়েছে। মূল চিত্রকর্মের পাশাপাশি ১৬টি অনুকৃতি, শিল্পীর জীবন ও কর্মের ওপর ৭৫টি আলোকচিত্র এবং শিল্পীর ব্যবহূত তুলি, তুলিদানি, রঙের ইজেল, চশমা, কালির দোয়াতসহ প্রায় ৬৯টি স্মারকদ্রব্যও রয়েছে। দোতলা গ্যালারির ভেতর কাচের বাক্সে এই স্মারক চিহ্নগুলো সংরক্ষিত।
১৯৩৩ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে জয়নুল আবেদিন যখন ভর্তি হলেন, তখন ইতিমধ্যেই সেখানে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু ও যামিনী রায়ের মতো শিল্পীরা পাশ্চাত্য শিল্পরীতির পাশাপাশি প্রাচ্যদেশীয় শিল্পরীতি নিয়ে বিস্তর নিরীক্ষা করেছেন ও করছেন। চীনা ও জাপানি চিত্রকলার বৌদ্ধ অভিব্যঞ্জনা সফলভাবে ব্যবহার করেন অবনীন্দ্রনাথ ও যামিনী রায়। নন্দলাল বসু ও যামিনী রায়ের সময়ের তরুণ শিল্পী জয়নুল আবেদিন ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের সময়ে সাদাকালো রেখাঙ্কনের মাধ্যমে শিহরণ জাগানো দুর্ভিক্ষের ছবিগুলো আঁকলেন। এই একই ধরনের রেখাঙ্কন প্রচেষ্টা আবেদিন আবার করেছিলেন ১৯৪৫ সালে, যখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের দুমকা এলাকায় সাঁওতালদের জীবনযাত্রা দেখতে গিয়েছিলেন। নন্দলাল বসুর বিখ্যাত ‘নবান্ন উৎসব’ বা ‘নব মেঘভার’ ছবির অনন্য-চঞ্চল তরঙ্গিত লয় শিল্পী হিসেবে জয়নুল আবেদিনকেও প্রভাবিত করেছে। ১৯৫১ সালে লন্ডনের স্লেইড স্কুলে পাশ্চাত্য শিল্পকলা পাঠের সময় মার্ক শাগাল, মাতিস, ভ্যানগঘ এবং পিকাসোর মতো শিল্পীদের হাতে রঙের মনোমুগ্ধকর উল্লাস রেখাঙ্কনের পাশাপাশি চিত্রকর্মে রঙের উজ্জ্বল ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও আবেদিনকে অনুপ্রাণিত করে। শিল্পীর আঁকা ‘বাঙালি রমণী’ এমন একটি চিত্রকৃতি। স্বদেশের লোকশিল্পকে পৃথিবীর মানুষের সামনে তুলে ধরার উদ্দেশে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ভ্রমণ করেছেন তিনি এবং লোকশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ করেছেন। ১৯৭০ সালে মনপুরায় স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস সঙ্ঘটিত হলে তিনি একটি বিশালকায় স্ক্রোল চিত্র আঁকেন। ‘নবান্ন’ তাঁর অপর বিখ্যাত একটি স্ক্রোল চিত্র। শিল্পীর আঁকা রঙিন ছবিগুলোয় কালবৈশাখী ঝড়, জড় জীবন, বাঙালি নারী, বেদে নৌকা, নবান্ন, মাঝির গুণ টানা, বংশীবাদক, কলসিসহ রমণী, মই চাষ, মাছ ধরা প্রভৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। ইতিহাস বিখ্যাত মন্বন্তর সিরিজ ছাড়াও ‘সাঁওতাল,’ ‘দুই সাপুড়ে,’ ‘দুইটি হরিণ,’ ‘ঝড়ে গরু,’ ‘বিশ্রামরত কৃষকগণ’ ‘দুমকা,’ ‘বেদেনী’সহ নানামাত্রিক ছবিতে চিরায়ত বাংলার নিসর্গ ও জীবনের প্রতি শিল্পীর প্রেম পরস্ফুিট। কলকাতা বেতারে ‘অবলোকিত্বেশর’ বিষয়ে একটি বেতার কথিকায় প্রাচীন শিল্পীদের ভূয়সী প্রশংসা করেও শিল্পী বলেছিলেন, ‘...কিন্তু আমার কাছে এ মূর্তিগুলো অনেক দূরের মনে হয়। আমি আমার চারদিকে যে সমস্ত মানুষকে দেখি তাদের আকৃতি অন্য রকম। শীতকালে রোদে বসে উবু হয়ে একজন বুড়ো মানুষ হুঁকো টানছে, একজন মানুষ মোষ নিয়ে ক্ষেতে মই দিচ্ছে, দু’জন মানুষ গুণ টেনে পাট বোঝাই নৌকা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অথবা একটি গ্রাম্য মেয়ে নীল শাড়ি পরে রৌদ্রে চুল মেলে দিয়ে বসেছে এসব চিত্র আমার কাছে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মনে হয়। এগুলোর মধ্যেই আমি আমাকে খুঁজে পাই।’
ঠিক যেমনটি হেমন্তদিনে ব্রহ্মপুত্রের তীরে জয়নুল আবেদিন শিল্প সংগ্রহশালায় প্রয়াত শিল্পীর জীবনোচ্ছ্বাস আমরা খুঁজে পেতে পারি।
অদিতি ফাল্গুনী

No comments

Powered by Blogger.