সঙ্কটে অপরাজেয় মানব সন্তান by আতাউর রহমান
পৃথিবীর শারীরিক ভবিষ্যত্ নিয়ে এ গ্রহের মানুষ উদ্গ্রীব হয়ে আছে। সমপ্রতি কোপেনহেগেনে সমাপ্ত বিশ্ব সম্মেলনই তার প্রমাণবহ। সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে অনেক সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। রোমের নগর পম্পেইর ধ্বংসপ্রাপ্তি আমরা উদাহরণ হিসেবে উদ্ধৃত করতে পারি। অতি মনোমুগ্ধকর নগরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাতের ফলে।
এই নগরটি লাভার আস্তরণে মাটির নিচে তলিয়ে যায়। এভাবে মায়া, সিন্ধু, হরপ্পা, বেবিললিয়ান, এসিরিয়ানসহ বহু সভ্যতা কালের দীর্ঘ পথযাত্রায় বিলীন হয়ে গেছে। আমি ক্রিট নগরীতে চার হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার নিদর্শন মাটির নিচে থেকে খুঁড়ে বের করতে দেখেছি। আমি যখন এথেন্স থেকে ক্রিটে বেড়াতে গেছি তখন রাজপ্রাসাদের খনন কাজ চলছিল। আমাদের দেশে খনন কাজ করে ময়নামতি ও পাহাড়পুরে আদি সভ্যতার নিদর্শন বের করা সম্ভব হয়েছে। এখন খনন কাজ চলছে নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বরে, পুরনো সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে বের করার জন্য। সভ্যতার উত্থান ও পতন বিশ্বচরাচরের নিয়ম বহির্ভূত কোনো বিষয় নয়। পৃথিবীর বৃহত্তম ও দীর্ঘতম হিমালয় পর্বতমালাও একসময় সমুদ্রগর্ভ থেকে ওঠে এসেছিল। আমাদের প্রিয় দেশও একদিন সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। আমার কৈশোরকালে জন্মস্থান পুরনো নোয়াখালী শহরকে সমুদ্র বিলীন হয়ে যেতে দেখেছি। এখন নোয়াখালী নামে কোনো শহর নেই। মাইজদীকোর্ট হলো বর্তমান নোয়াখালীর প্রধান প্রাণকেন্দ্র। পুরনো দিনের নোয়াখালী শহর এখন চর হিসেবে আবার গজিয়ে উঠেছে। অনেকেই নিজেদের পুরনো জায়গা চিহ্নিত করতে পেরেছেন। এই ভাঙা-গড়ার খেলা আমাদের এ গ্রহের জন্মলগ্ন থেকে চলে আসছে। নদীর এক কূল ভাঙে এবং আরেক কূল গড়ে—এই তো জগত্ ও জীবনের খেলা। আমরা কেয়ামত ও রোজ হাসরে বিশ্বাস করি, কারণ এটা আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের অন্তর্গত। আমাদের এ গ্রহ কক্ষচ্যুত হলেই তো কেয়ামত ঘটে যাবে অথবা মহাশূন্যে আরেক গ্রহের সঙ্গে সংঘর্ষেও আমাদের গ্রহ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কোপেনহেগেনে বিশ্বের বিধ্বংসী ভবিষ্যত্ নিয়ে যে বৈঠক বসেছে তাকে কেন্দ্র করে আমি এসব ভাবনায় আক্রান্ত হয়েছি। আমাদের ঘরের কাছে বিপত্তি ঘটতে যাচ্ছে, এ নিয়ে আমাদের ব্যথা না হয়ে উপায় নেই। আমার আয়ুষ্কালের সীমারেখা নিয়ে আমি শঙ্কিত নই, আমি ভাবছি আমার দৌহিত্র-দৌহিত্রীদের ভবিষ্যত্ কী হবে! বিজ্ঞানীরা হিমালয়ের হিমবাহরাজিকে বলে তৃতীয় মেরু প্রদেশ। হিমালয়কে ঘিরে রয়েছে একাধিক দেশ এবং প্রতিটি দেশ হিমালয়ের পিঠে দ্রুত গলা হিমবাহের বিপুল জলরাশিতে প্রচণ্ডভাবে আহত হবে, এমনকি নিহতও হতে পারে। এসব হিমবাহ থেকেই আমাদের অঞ্চলে শক্তিমত্ত নদীগুলোর জন্ম হয়েছে। গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, ইয়েলো নদী এবং ইয়াংজি নদীর দিকে আমরা তাকালেই তা দেখতে পারব। ৩০০ কোটি মানব সন্তান, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানবকুল হিমালয়ের উপরে জমা বরফখণ্ডের পরিষেবা পেয়ে আসছে। এ বিস্তৃত বরফখণ্ড কমবেশি সব সময় গলে আসছে, কিন্তু এখন অতি দ্রুত গলছে। এসব হিমবাহের আয়তন ১ লাখ স্কয়ার মিটার। ভারতীয় হিমবাহ বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী হাসনাইন মনে করেন, বরফ না থাকলে মানুষ মারা যাবে। বিরাট একটা জনগোষ্ঠী হিমালয়ের পাদদেশে বসবাস করে এবং বরফ-গলা পানির ওপর নির্ভর করে। হিমালয়কে ঘিরে যেসব দেশের বসতি গড়ে উঠেছে সেসব স্থানে পানির জন্য হাহাকার পড়ে যেতে পারে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধিকে রোধ করা আজকের বিশ্বের পরিবেশ রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত হিমালয়ের এক-পঞ্চমাংশ হিমবাহ গলে গেছে। বিশ্ব-উষ্ণতার কারণে এই গলা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ উষ্ণতা বৃদ্ধি যদি রোধ করা না যায় তাহলে হিমালয়ের প্রতিবেশী দেশগুলো ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হবে, এমনকি দেশগুলোর অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে। চাইনিজ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলছেন, ২০৭০ সাল নাগাদ হিমালয়স্থিত হিমবাহ শতকরা ৪৩ ভাগ গলে যাবে। হিমালয় গলা জল যদি হ্রাস পায় তাহলে ভয়াবহভাবে ওইসব স্থানে জলের সঙ্কট দেখা দেবে। হিমালয়ের পাশের দেশ নেপাল ও ভুটান ঝপটা জলপ্রবাহে ভেসে যেতে পারে। মেরু অঞ্চলের অবস্থা এখনও এতটা ভয়াবয় নয়। এমনিতেই আণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশ চায়না, ভারত ও পাকিস্তান গত পঞ্চাশ বছরে একাধিকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। হিমালয় থেকে উত্পন্ন নদীগুলো এ দেশগুলোকে জল সরবরাহ করে সচল রেখেছে। জলের টানাটানি নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে আবার বড়সড় রকমের যুদ্ধ বেধে যাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি সম্রাট নিরুর মতো বাঁশি বাজাব, যখন রোম পুড়ে যাচ্ছে? নির্লিপ্ত হয়ে পৃথিবীর ধ্বংসপ্রাপ্তি দেখাটা এক ধরনের দর্শন বৈকি যাকে বলা যায় —স্টইসিজম অথবা ঔদাসীন্য দর্শনবাদ। আমরা যদি কার্বন গ্যাস নির্গমন রোধ করে পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে না পারি, জ্বালানি তেলের সঙ্কট নিরসন করে রাজনৈতিক টানাপোড়ন বন্ধ করতে না পারি, ক্রমাগত বর্ধিত পৃথিবীর থার্মোমিটারের পারা নিচে নামাতে না পারি তা হলে নিশ্চিতভাবে আমাদের গ্রহের অস্তিত্ব সঙ্কট দেখা দেবে। পৃথিবীর মানুষদের এ সঙ্কট মোকাবিলার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কোপেনহেগেনে বিশ্ব নেতাদের বৈঠকের ফলাফল আমাদের হতাশ করেছে। বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিস্থিতি আমরা যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তা হলে আত্মহত্যারই শামিল হবে। মানুষের শুভবুদ্ধির প্রতি বিশ্বাস হারানো কোনো কাজের কথা নয়। বিশ্বের নেতাদের প্রতিও আমরা বিশ্বাস হারাতে চাই না। আমি অথবা আমরা হয়ত সঙ্কটে পড়ব, কিন্তু আমি আশা করি, আগামীদিনের প্রতিটি শিশুর জন্য আমরা নিরাপদ ও বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়ার প্রয়াসে সর্বশক্তি নিয়োগ করব।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments