গন্তব্য ঢাকা-বাঁচতে চাওয়া কি বিলাসিতা
‘মায়ের ঘরে খু-উ-ব কষ্ট করছি। খুবই কষ্ট করছি। আমার বাবারে কারা জানি মাইরা রাখছে। আমি তহন খুব ছোট। মায় যে কী কষ্ট কইরা পালছে আমাগোরে। ছয় বোন আর দুই ভাই আছিলাম আমরা। সবাইরে লইয়া মা পড়ছে বিপদে। তহন মায় আর কী করব? আমরাই কাজ কইরা নিজেগো খাওন আনতাম। তহন ভাবছিলাম বিয়ার পর অনেক ভালা থাকতে পারমু। খাওনের কষ্টটা হইব না। এহনও আমাকে নিজের খাওন নিজেরেই আনতে হয়।’
বয়স তখন আর কতই বা হবে। এই আট-১০। বাবার মৃত্যুতে মা দিশেহারা। আর ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে তাঁর কপালে অবিরাম চিন্তার রেখা। কী করবেন? কীভাবে সংসার চালাবেন, সে চিন্তার অন্ত নেই। চিন্তাটা প্রবাহিত হয় সব সন্তানের মধ্যেও। তারা নিজেরা একটা কিছু করে দুই বেলা খাবার জোগাড়ে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, এভাবেই শুরু হয় জীবনসংগ্রাম। আর সেই থেকে অবিরাম চলছে সংগ্রাম। কথা হচ্ছিল সংগ্রামী সেই দলেরই একজনের সঙ্গে। নাম তাঁর সাবিহা বেগম। বাড়ি ঝালকাঠির মরুজুন থানায়। বাবার নাম রাসেল উদ্দীন আর মা সালেহা বেগম।
পরিচয়টা এখানেই শেষ। কিন্তু জীবনের গল্পটা অনেক বড়। সেটা শোনার আগ্রহ নিয়েই বসে থাকি। গ্রাম ছেড়ে সাবিহা বেগম ঢাকায় এসেছেন পাঁচ বছর হবে। এসেছিলেন কিছু পরিবর্তনের আশায়। কেমন? মায়ের কষ্ট দেখে নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন প্রত্যেকে। আশায় ছিলেন সে কষ্ট একসময় লাঘব হবে। যে বয়সে তাঁর ছুটে বেড়ানোর কথা পথেঘাটে, যে বয়সে ক্লান্ত দুপুরে দুরন্তপনায় লুকিয়ে চলে যাওয়ার কথা খেলতে, পুতুলের সঙ্গে দিন-রাত খুঁটিনাটি লেগে থাকার কথা অথবা বই কাঁধে যাওয়ার কথা স্কুলে; সে বয়সেই তাঁকে করতে হয়েছে কাজ। অন্নের চিন্তায় অন্য সব আশা পড়েছে ধামাচাপা। কাজ করেই দিনরাত শেষ। যেটুকু অবসর মেলে, সেটুকুতে আর অন্য কেউ নয়, বোন ময়মুরির সঙ্গে চলে অবিরাম খেলা। তবে তখন মনের কোণে সূক্ষ্ম আশা একসময় আসবে যখন জীবন বদলাবে।
‘একদিন কাম কইরা বাড়িত আইছি। তহন মা কইছে তোর লাইগ্যা জামাই ঠিক করছি। তোর বিয়া। আমি তহন কিছু বুঝি না। শুধু বুঝি আমি প্রতিদিন ঠিকমতো খাইতে পামু। আর মায় কইছে হেইডা শুনা লাগে না। বইছি বিয়ায়। আমার জামাইয়ের বাড়ি রাজাপুর জেলার রাজাপুর থানার শাংঘর গ্রামে। হেই তহন গাছ কাটতে আইছিল আমাগো ওহানে। গাছ কাটা লাগে না?—হেই কামে।’ চাওয়াটা বেশি কিছু নয়। কেবল দুবেলা পেটপুরে একটু খাবার। আর এই একটু আশাতেই জীবনের সব রং কেমন ফিকে হয়ে গেছে সাবিহা বেগমের। পেটের চিন্তায় ছোটবেলাটা উপভোগ করা হয়নি। খেলার সময়টুকুও কাজে লাগাতে হয়েছে খাবারের চিন্তায়।
আরশ সরদারের সঙ্গে ঘর বাঁধার পর সাবিহা বেগমের ঘরে এসেছে এক ছেলে ও এক মেয়ে। কিন্তু আরশ সরদারের আগের বউয়ের ছিল পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। সংসারটা বেশ বড়। তাই বিয়ের পরও খাবারের চিন্তায় থাকতে হয়েছে সাবিহা বেগমকে। সব ছেলেমেয়েরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন সাবিহা বেগম। তার পরও চেষ্টা করেন ছেলেদের নিয়ে একসঙ্গে থাকতে। ঢাকায় তিন ছেলে ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে একসঙ্গে থাকেন তিনি। আর তিন ছেলে থাকে গ্রামে। ‘গ্রামই তো ভালা। তয় এহন আর গ্রামে মানুষ নাই। সব আইছে ঢাকায়। আমরাও খাওনের কষ্টে আইসা পড়ছি ঢাকায়। আমার তিন পোলা গ্রামে। ওহানে তো ভালা লাগবই। তয় টাকা ছাড়া কী চলে। ঢাকা ভালা না লাইগ্যা যাইব কই। কাম করতে হইবই। খাইতে হইব না?’
পাঁচ বছর হলো ঢাকায় এসেছেন সাবিহা বেগম। বয়স তাঁর প্রায় ৪৫ ছাড়িয়েছে। ভেবেছিলেন ঢাকা এসে ভালো থাকবেন। তাই এসে পোশাক কারখানায়ও কাজ করেন। কিন্তু না, ভাগ্য বদলায়নি। এখন ঢাকার শ্যামলীতে ২ নম্বর রোডের উল্টো দিকে একটা চায়ের টং দোকান চালান তিনি। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে দোকান। সাবিহা বেগমকে দোকানে পাওয়া যায় সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর দোকানের দায়ভার নেন হয় ছেলে, নয় স্বামী। ছেলেরা কেউ কেউ ভ্যান চালায়। তবুও সংসারের চাকাটার জং ছোটে না। এখন বেশি কিছু নয়, শুধু বলেন, ‘আমার জীবন তো এই করতেই শ্যাষ। আমি আজ আছি কাইল নাই। চাই পোলাগো ভবিষ্যৎ যেন ভালা হয়। অগো যেন খাওনের কষ্টটা না হয়।’
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থেকে কেবল কাজ করে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করা কি খুব বিলাসিতা?
শর্মিলা সিনড্রেলা
পরিচয়টা এখানেই শেষ। কিন্তু জীবনের গল্পটা অনেক বড়। সেটা শোনার আগ্রহ নিয়েই বসে থাকি। গ্রাম ছেড়ে সাবিহা বেগম ঢাকায় এসেছেন পাঁচ বছর হবে। এসেছিলেন কিছু পরিবর্তনের আশায়। কেমন? মায়ের কষ্ট দেখে নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন প্রত্যেকে। আশায় ছিলেন সে কষ্ট একসময় লাঘব হবে। যে বয়সে তাঁর ছুটে বেড়ানোর কথা পথেঘাটে, যে বয়সে ক্লান্ত দুপুরে দুরন্তপনায় লুকিয়ে চলে যাওয়ার কথা খেলতে, পুতুলের সঙ্গে দিন-রাত খুঁটিনাটি লেগে থাকার কথা অথবা বই কাঁধে যাওয়ার কথা স্কুলে; সে বয়সেই তাঁকে করতে হয়েছে কাজ। অন্নের চিন্তায় অন্য সব আশা পড়েছে ধামাচাপা। কাজ করেই দিনরাত শেষ। যেটুকু অবসর মেলে, সেটুকুতে আর অন্য কেউ নয়, বোন ময়মুরির সঙ্গে চলে অবিরাম খেলা। তবে তখন মনের কোণে সূক্ষ্ম আশা একসময় আসবে যখন জীবন বদলাবে।
‘একদিন কাম কইরা বাড়িত আইছি। তহন মা কইছে তোর লাইগ্যা জামাই ঠিক করছি। তোর বিয়া। আমি তহন কিছু বুঝি না। শুধু বুঝি আমি প্রতিদিন ঠিকমতো খাইতে পামু। আর মায় কইছে হেইডা শুনা লাগে না। বইছি বিয়ায়। আমার জামাইয়ের বাড়ি রাজাপুর জেলার রাজাপুর থানার শাংঘর গ্রামে। হেই তহন গাছ কাটতে আইছিল আমাগো ওহানে। গাছ কাটা লাগে না?—হেই কামে।’ চাওয়াটা বেশি কিছু নয়। কেবল দুবেলা পেটপুরে একটু খাবার। আর এই একটু আশাতেই জীবনের সব রং কেমন ফিকে হয়ে গেছে সাবিহা বেগমের। পেটের চিন্তায় ছোটবেলাটা উপভোগ করা হয়নি। খেলার সময়টুকুও কাজে লাগাতে হয়েছে খাবারের চিন্তায়।
আরশ সরদারের সঙ্গে ঘর বাঁধার পর সাবিহা বেগমের ঘরে এসেছে এক ছেলে ও এক মেয়ে। কিন্তু আরশ সরদারের আগের বউয়ের ছিল পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে। সংসারটা বেশ বড়। তাই বিয়ের পরও খাবারের চিন্তায় থাকতে হয়েছে সাবিহা বেগমকে। সব ছেলেমেয়েরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন সাবিহা বেগম। তার পরও চেষ্টা করেন ছেলেদের নিয়ে একসঙ্গে থাকতে। ঢাকায় তিন ছেলে ও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে একসঙ্গে থাকেন তিনি। আর তিন ছেলে থাকে গ্রামে। ‘গ্রামই তো ভালা। তয় এহন আর গ্রামে মানুষ নাই। সব আইছে ঢাকায়। আমরাও খাওনের কষ্টে আইসা পড়ছি ঢাকায়। আমার তিন পোলা গ্রামে। ওহানে তো ভালা লাগবই। তয় টাকা ছাড়া কী চলে। ঢাকা ভালা না লাইগ্যা যাইব কই। কাম করতে হইবই। খাইতে হইব না?’
পাঁচ বছর হলো ঢাকায় এসেছেন সাবিহা বেগম। বয়স তাঁর প্রায় ৪৫ ছাড়িয়েছে। ভেবেছিলেন ঢাকা এসে ভালো থাকবেন। তাই এসে পোশাক কারখানায়ও কাজ করেন। কিন্তু না, ভাগ্য বদলায়নি। এখন ঢাকার শ্যামলীতে ২ নম্বর রোডের উল্টো দিকে একটা চায়ের টং দোকান চালান তিনি। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে দোকান। সাবিহা বেগমকে দোকানে পাওয়া যায় সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর দোকানের দায়ভার নেন হয় ছেলে, নয় স্বামী। ছেলেরা কেউ কেউ ভ্যান চালায়। তবুও সংসারের চাকাটার জং ছোটে না। এখন বেশি কিছু নয়, শুধু বলেন, ‘আমার জীবন তো এই করতেই শ্যাষ। আমি আজ আছি কাইল নাই। চাই পোলাগো ভবিষ্যৎ যেন ভালা হয়। অগো যেন খাওনের কষ্টটা না হয়।’
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থেকে কেবল কাজ করে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার প্রত্যাশা করা কি খুব বিলাসিতা?
শর্মিলা সিনড্রেলা
No comments