লাভ-ক্ষতির অনেক হিসাব-কয়লানীতি by ফ. র. আল-সিদ্দিক
কয়েক বছর আগে সাপ্তাহিক ২০০০-এর উদ্যোগে কয়লানীতির ওপর একটি সেমিনার হয়েছিল। আমি সে সেমিনারে রবাহূত হয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেমিনার শেষে শ্রোতাদের মতামত পর্বে আমি দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, অদ্ভুত আমাদের এ দেশটি। এ দেশের জন্য কয়লানীতি তৈরি করা হচ্ছে, অথচ এ নীতি প্রণয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে এ দেশের পত্রপত্রিকায় প্রায় কোনো আলোচনাই হলো না।
এ কথা বলে গোটা কয়েক বিষয়বস্তু আমি সংক্ষেপে তুলে ধরেছিলাম, সেগুলো নিয়ে এ দেশে প্রায় কোনো আলোচনা হয়নি বললেই চলে। সেদিন ওই সেমিনারের আয়োজকদের কাছে আমার কথাগুলো এতই ভালো লেগেছিল যে, সেমিনার শেষ হওয়ার পর রিফ্রেশমেন্ট বা ভোজনপর্বে, আমার উত্থাপিত বক্তব্যের কিছু অংশ রিওয়াইনড করে, রেকর্ড প্লেয়ারের মাধ্যমে তারা বারবার করে সবাইকে বাজিয়ে শোনাচ্ছিল। অথচ দেখা গেল, স্থানাভাবে কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক, সাপ্তাহিক ২০০০-এর পরবর্তী সংখ্যায়, আমার বক্তব্যের এতগুলো বিষয়বস্তুর মধ্যে মাত্র দুটি বিষয় প্রকাশিত হয়েছিল এবং সে দুটির মধ্য থেকেও মাত্র একটি বিষয় নিয়ে, মানে ভূ-অভ্যন্তরে কয়লাকে জ্বালানি গ্যাসে রূপান্তরের পদ্ধতিটিকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আলোচনা করা হয়েছে। বাকি বিষয়গুলো এখন পর্যন্ত প্রায় অনালোচিতই রয়ে গেছে।
সাপ্তাহিক ২০০০-এর সেই সেমিনারে আমি ভূ-অভ্যন্তরে কয়লা গ্যাসিফিকেশনের কথা বলার আগে দেশে এ বিষয়টি নিয়ে যে তেমন একটা আলোচনা হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন আমরা দেখতে পাই, এর আগে কয়লানীতির যে খসড়াটি তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে ভূ-অভ্যন্তরে থাকতেই কয়লাকে গ্যাসিফিকেশনের কথাটির কোনো উল্লেখই ছিল না। সে সেমিনারের পর প্রস্তুত করা খসড়ায়ই গ্যাসিফিকেশনের কথাটি কয়লানীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বেশ জোরেশোরে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে আমিও এমন অস্বাভাবিক রকমের একটি ভুলো মনের মানুষ যে, পরবর্তী সময়ে আমি সেই বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে তিন-চারটি ছাড়া বাকিগুলো মনেই করতে পারছিলাম না। আমার সেই বক্তব্য দেওয়ার আগে, সেমিনারটি চলার সময়, যে নোটবইয়ে আমি আমার বক্তব্যের পয়েন্টগুলো টুকে নিয়েছিলাম সে নোটবইটি এতদিন পর খুঁজে পাওয়ায় আজ এ বিষয়গুলো জাতির সামনে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে চাই। এখন আসল কথায় আসা যাক। সাপ্তাহিক ২০০০-এর সেই সেমিনারের আগ পর্যন্ত এ দেশের পত্রপত্রিকায় কয়লানীতির ওপর আলোচনাগুলো সাধারণত দুটি উত্তোলন পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে পদ্ধতি দুটির একটি ছিল টানেল অথবা শাফট মাইনিংয়ের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ অবস্থান থেকে কয়লাকে তুলে আনা এবং অন্যটি ওপেন পিট মাইনিং বা কয়লাস্তরের ওপর থেকে মাটি সরিয়ে নিয়ে সেখান থেকে কয়লা তুলে নিয়ে আসা।
ওই সেমিনারের পর থেকে পত্রপত্রিকা এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে ভূগর্ভস্থ অবস্থানে কয়লাকে গ্যাসে রূপান্তরিত করে সেই গ্যাস আহরণ করার পদ্ধতিটি নিয়ে এত আলোচনা হয় যে, সরকারও তাদের খসড়া কয়লানীতিতে এ পদ্ধতিটিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এখন এ পদ্ধতি তিনটির মধ্যে কোনটার কী সুবিধা-অসুবিধা আছে তা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের যে কথাটি বুঝতে হবে তা হলো, আমরা এখন একটা যুগসন্ধিক্ষণে বাস করছি। কারণ এ পৃথিবীর মোট খনিজ জ্বালানি; যথা_ কয়লা, গ্যাস, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি খুব শিগগির শেষ হয়ে যাবে। তাই আগে যেভাবে আমরা, মানে এই বিশ্ববাসী খনিজ জ্বালানি দেদার অপচয় করছি সেভাবে অপচয় করা এখন আমাদের চলবে না। তাই প্রতিটি মুহূর্তেই চিন্তা করতে হবে, যাতে আমরা একদিকে জ্বালানির উত্তোলন বাড়িয়ে এর অপ্রয়োজনীয় ব্যয় রোধ করে এর থেকে আমাদের প্রাপ্তিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে আসতে পারি। অন্যদিকে ভাবতে হবে, যাতে আমরা আমাদের এ জ্বালানির মজুদ যতটা সম্ভব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারি।
উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতির মধ্যে ভূগর্ভ থেকে কয়লা তুলে নিয়ে আসার পদ্ধতিটি থেকেই আমরা সবচেয়ে কম কয়লা পাব। এ পদ্ধতির সাহায্যে খনিতে অবস্থিত কয়লার মোটামুটি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কয়লা আহরণ করা যায়। আর এ পদ্ধতিতে যদি আমরা বিদেশি কোনো কোম্পানিকে দিয়ে কয়লা উত্তোলন করি তাহলে তাদের সঙ্গে আজ পর্যন্ত যেসব চুক্তি হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, তারা আহরিত কয়লার শতকরা মোটামুটি ছয়ভাগ আমাদের বিনামূল্যে দিতে রাজি। তাহলে দেখা যায়, এ পদ্ধতিতে কয়লা তুললে ২০%-এর ০.০৬ ভাগ থেকে ৩০%-এর ০.০৬ ভাগ, মানে খনিতে অবস্থিত মোট কয়লার শতকরা ১.২ ভাগ থেকে ১.৮ ভাগ কয়লা আমরা বিনামূল্যে পাব। বাকি কয়লার ৭০ থেকে ৮০% মাটির নিচেই থেকে যাবে আর ১৮.৮ থেকে ২৮.২% কয়লা বিদেশি কোম্পানিগুলো পাবে। বিদেশি কোম্পানির ভাগে পড়া এ কয়লাকে হয় তাদের বিদেশে রফতানি করতে দিতে হবে, না হয় আন্তর্জাতিক মূল্যে আমরা সে কয়লা তাদের কাছ থেকে কিনে নেব।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা যদি আমাদের দেশের মোট কয়লা সম্পদের শতকরা ১.২ থেকে ১.৮% বিনামূল্যে পাই এবং সে কয়লার ৭০ থেকে ৮০% মাটির নিচেই থেকে যায়, আর ১৮.২ থেকে ২৮.৮%-এর মতো কয়লা যদি আমাদের (সেই মীরজাফরের যুগের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো) মহানুভব বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে আন্তর্জাতিক মূল্যেই কিনে নিতে হয় তাহলে কী দরকার আমাদের সেই কয়লা ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করার? আমরা তো আমাদের চাহিদার পুরো কয়লাই তাহলে বিদেশ থেকে আমদানি করতে পারি। এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা হয়তো বলতে পারি যে, আমাদের কয়লা খনিগুলো বিদেশিদের দিয়ে দিলে যে আমরা ওই ১.২ থেকে ১.৮% কয়লার বাইরে আর কিছুই পাব না তা অবশ্য পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বিদেশ থেকে কয়লা আনতে হলে সবচেয়ে কাছের দেশ ভারত (আসাম) অথবা ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আনতে যত টাকা আমাদের পরিবহন খরচ হিসেবে দিতে হবে তার বদলে নিজের দেশের কয়লা উত্তোলন করতে পারলে রাজশাহী বিভাগের কোনো একটি জেলা থেকে ঢাকা, খুলনা বা চট্টগ্রামে সেই কয়লা বহন করে নিয়ে আসতে তার চেয়ে নিশ্চয়ই কম খরচ পড়বে। তাই দেশের কয়লা তুলতে পারলে কিছু একটা লাভ তো নিশ্চয়ই হবে। তাছাড়া সে কয়লা খনি থেকে প্রাণবাজি রেখে কয়লা উত্তোলন করার জন্য কুলিগিরির চাকরিও তো আমরাই পাব। আমাদের প্রিয় নবাব, সেই ইতিহাস বিখ্যাত সিরাজউদ্দৌলা যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কলকাতায় বন্দর স্থাপন করতে দিয়েছিলেন তখন সেই বন্দরের কুলিগিরির চাকরিগুলো কি আমাদের প্রিয় দেশবাসী পায়নি?
তাছাড়া বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি করে এসব কয়লা খনির মালিকানা দিতে পারলে তাদের কাছ থেকে যে আমরা লাখো-কোটি টাকা ঘুষ পাব, সেটা তো আমাদের দেশেরই কেউ না কেউ পাবে। তারা যখন সেই টাকা দিয়ে কোটি টাকা দামের গাড়ি চালাবে, সে গাড়ির ড্রাইভারের চাকরিও তো আমাদেরই কেউ না কেউ পাবে। আমাদের দেশের রাস্তায় যখন এত সব দামি দামি গাড়ি চলবে তখন গর্বে আমাদের বুক ভরে উঠবে না? তখন তো আমরা বিদেশি পর্যটকদের দিকে আঙুল তুলে বলতে পারব_ দেখ, তোমাদের ওয়াশিংটন, প্যারিস, লন্ডনে যে রকম দামি দামি গাড়ি চলে আমাদের ঢাকার রাস্তায়ও তেমনি দামি দামি গাড়ি চলছে। এসব মহান ঘুষখোর ব্যক্তিত্ব যেহেতু প্রায়ই তাদের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করবে, তাই আমাদের দেশে রেস্তোরাঁর সংখ্যাও বেড়ে যাবে। আমরা তখন সেসব রেস্তোরাঁয় পাচক অথবা বয়-বেয়ারার চাকরি পাব। তারা যখন বিরাট তাজমহলসদৃশ বাড়ি বানাবে, তখন আমরা সেসব বাড়ির মিস্ত্রি হিসেবে এবং নির্মাণসামগ্রী পাহারা দেওয়ার জন্য দারোয়ানের চাকরি পাব। তাই এ যুগের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলোর কাছে আমাদের রত্নগর্ভা খনিগুলোর মালিকানা হস্তান্তর করলে কিছুই লাভ হবে না_ এ কথা মোটেই সত্যি নয়।
ফ. র. আল-সিদ্দিক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
সাপ্তাহিক ২০০০-এর সেই সেমিনারে আমি ভূ-অভ্যন্তরে কয়লা গ্যাসিফিকেশনের কথা বলার আগে দেশে এ বিষয়টি নিয়ে যে তেমন একটা আলোচনা হয়নি তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন আমরা দেখতে পাই, এর আগে কয়লানীতির যে খসড়াটি তৈরি হয়েছিল তার মধ্যে ভূ-অভ্যন্তরে থাকতেই কয়লাকে গ্যাসিফিকেশনের কথাটির কোনো উল্লেখই ছিল না। সে সেমিনারের পর প্রস্তুত করা খসড়ায়ই গ্যাসিফিকেশনের কথাটি কয়লানীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বেশ জোরেশোরে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে আমিও এমন অস্বাভাবিক রকমের একটি ভুলো মনের মানুষ যে, পরবর্তী সময়ে আমি সেই বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে তিন-চারটি ছাড়া বাকিগুলো মনেই করতে পারছিলাম না। আমার সেই বক্তব্য দেওয়ার আগে, সেমিনারটি চলার সময়, যে নোটবইয়ে আমি আমার বক্তব্যের পয়েন্টগুলো টুকে নিয়েছিলাম সে নোটবইটি এতদিন পর খুঁজে পাওয়ায় আজ এ বিষয়গুলো জাতির সামনে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরতে চাই। এখন আসল কথায় আসা যাক। সাপ্তাহিক ২০০০-এর সেই সেমিনারের আগ পর্যন্ত এ দেশের পত্রপত্রিকায় কয়লানীতির ওপর আলোচনাগুলো সাধারণত দুটি উত্তোলন পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে পদ্ধতি দুটির একটি ছিল টানেল অথবা শাফট মাইনিংয়ের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ অবস্থান থেকে কয়লাকে তুলে আনা এবং অন্যটি ওপেন পিট মাইনিং বা কয়লাস্তরের ওপর থেকে মাটি সরিয়ে নিয়ে সেখান থেকে কয়লা তুলে নিয়ে আসা।
ওই সেমিনারের পর থেকে পত্রপত্রিকা এবং সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে ভূগর্ভস্থ অবস্থানে কয়লাকে গ্যাসে রূপান্তরিত করে সেই গ্যাস আহরণ করার পদ্ধতিটি নিয়ে এত আলোচনা হয় যে, সরকারও তাদের খসড়া কয়লানীতিতে এ পদ্ধতিটিকে অন্তর্ভুক্ত করে। এখন এ পদ্ধতি তিনটির মধ্যে কোনটার কী সুবিধা-অসুবিধা আছে তা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের যে কথাটি বুঝতে হবে তা হলো, আমরা এখন একটা যুগসন্ধিক্ষণে বাস করছি। কারণ এ পৃথিবীর মোট খনিজ জ্বালানি; যথা_ কয়লা, গ্যাস, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি খুব শিগগির শেষ হয়ে যাবে। তাই আগে যেভাবে আমরা, মানে এই বিশ্ববাসী খনিজ জ্বালানি দেদার অপচয় করছি সেভাবে অপচয় করা এখন আমাদের চলবে না। তাই প্রতিটি মুহূর্তেই চিন্তা করতে হবে, যাতে আমরা একদিকে জ্বালানির উত্তোলন বাড়িয়ে এর অপ্রয়োজনীয় ব্যয় রোধ করে এর থেকে আমাদের প্রাপ্তিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে আসতে পারি। অন্যদিকে ভাবতে হবে, যাতে আমরা আমাদের এ জ্বালানির মজুদ যতটা সম্ভব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে পারি।
উপরোক্ত তিনটি পদ্ধতির মধ্যে ভূগর্ভ থেকে কয়লা তুলে নিয়ে আসার পদ্ধতিটি থেকেই আমরা সবচেয়ে কম কয়লা পাব। এ পদ্ধতির সাহায্যে খনিতে অবস্থিত কয়লার মোটামুটি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কয়লা আহরণ করা যায়। আর এ পদ্ধতিতে যদি আমরা বিদেশি কোনো কোম্পানিকে দিয়ে কয়লা উত্তোলন করি তাহলে তাদের সঙ্গে আজ পর্যন্ত যেসব চুক্তি হয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, তারা আহরিত কয়লার শতকরা মোটামুটি ছয়ভাগ আমাদের বিনামূল্যে দিতে রাজি। তাহলে দেখা যায়, এ পদ্ধতিতে কয়লা তুললে ২০%-এর ০.০৬ ভাগ থেকে ৩০%-এর ০.০৬ ভাগ, মানে খনিতে অবস্থিত মোট কয়লার শতকরা ১.২ ভাগ থেকে ১.৮ ভাগ কয়লা আমরা বিনামূল্যে পাব। বাকি কয়লার ৭০ থেকে ৮০% মাটির নিচেই থেকে যাবে আর ১৮.৮ থেকে ২৮.২% কয়লা বিদেশি কোম্পানিগুলো পাবে। বিদেশি কোম্পানির ভাগে পড়া এ কয়লাকে হয় তাদের বিদেশে রফতানি করতে দিতে হবে, না হয় আন্তর্জাতিক মূল্যে আমরা সে কয়লা তাদের কাছ থেকে কিনে নেব।
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা যদি আমাদের দেশের মোট কয়লা সম্পদের শতকরা ১.২ থেকে ১.৮% বিনামূল্যে পাই এবং সে কয়লার ৭০ থেকে ৮০% মাটির নিচেই থেকে যায়, আর ১৮.২ থেকে ২৮.৮%-এর মতো কয়লা যদি আমাদের (সেই মীরজাফরের যুগের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো) মহানুভব বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে আন্তর্জাতিক মূল্যেই কিনে নিতে হয় তাহলে কী দরকার আমাদের সেই কয়লা ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করার? আমরা তো আমাদের চাহিদার পুরো কয়লাই তাহলে বিদেশ থেকে আমদানি করতে পারি। এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা হয়তো বলতে পারি যে, আমাদের কয়লা খনিগুলো বিদেশিদের দিয়ে দিলে যে আমরা ওই ১.২ থেকে ১.৮% কয়লার বাইরে আর কিছুই পাব না তা অবশ্য পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ বিদেশ থেকে কয়লা আনতে হলে সবচেয়ে কাছের দেশ ভারত (আসাম) অথবা ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আনতে যত টাকা আমাদের পরিবহন খরচ হিসেবে দিতে হবে তার বদলে নিজের দেশের কয়লা উত্তোলন করতে পারলে রাজশাহী বিভাগের কোনো একটি জেলা থেকে ঢাকা, খুলনা বা চট্টগ্রামে সেই কয়লা বহন করে নিয়ে আসতে তার চেয়ে নিশ্চয়ই কম খরচ পড়বে। তাই দেশের কয়লা তুলতে পারলে কিছু একটা লাভ তো নিশ্চয়ই হবে। তাছাড়া সে কয়লা খনি থেকে প্রাণবাজি রেখে কয়লা উত্তোলন করার জন্য কুলিগিরির চাকরিও তো আমরাই পাব। আমাদের প্রিয় নবাব, সেই ইতিহাস বিখ্যাত সিরাজউদ্দৌলা যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কলকাতায় বন্দর স্থাপন করতে দিয়েছিলেন তখন সেই বন্দরের কুলিগিরির চাকরিগুলো কি আমাদের প্রিয় দেশবাসী পায়নি?
তাছাড়া বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তি করে এসব কয়লা খনির মালিকানা দিতে পারলে তাদের কাছ থেকে যে আমরা লাখো-কোটি টাকা ঘুষ পাব, সেটা তো আমাদের দেশেরই কেউ না কেউ পাবে। তারা যখন সেই টাকা দিয়ে কোটি টাকা দামের গাড়ি চালাবে, সে গাড়ির ড্রাইভারের চাকরিও তো আমাদেরই কেউ না কেউ পাবে। আমাদের দেশের রাস্তায় যখন এত সব দামি দামি গাড়ি চলবে তখন গর্বে আমাদের বুক ভরে উঠবে না? তখন তো আমরা বিদেশি পর্যটকদের দিকে আঙুল তুলে বলতে পারব_ দেখ, তোমাদের ওয়াশিংটন, প্যারিস, লন্ডনে যে রকম দামি দামি গাড়ি চলে আমাদের ঢাকার রাস্তায়ও তেমনি দামি দামি গাড়ি চলছে। এসব মহান ঘুষখোর ব্যক্তিত্ব যেহেতু প্রায়ই তাদের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন নিয়ে দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া করবে, তাই আমাদের দেশে রেস্তোরাঁর সংখ্যাও বেড়ে যাবে। আমরা তখন সেসব রেস্তোরাঁয় পাচক অথবা বয়-বেয়ারার চাকরি পাব। তারা যখন বিরাট তাজমহলসদৃশ বাড়ি বানাবে, তখন আমরা সেসব বাড়ির মিস্ত্রি হিসেবে এবং নির্মাণসামগ্রী পাহারা দেওয়ার জন্য দারোয়ানের চাকরি পাব। তাই এ যুগের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিগুলোর কাছে আমাদের রত্নগর্ভা খনিগুলোর মালিকানা হস্তান্তর করলে কিছুই লাভ হবে না_ এ কথা মোটেই সত্যি নয়।
ফ. র. আল-সিদ্দিক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
No comments