ভিন্নমত-যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশাল ঋণ এবং বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা by আবু আহমেদ
গত কয়েক দিনে আমাকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রশাসনের যে বিশাল ঋণের সেলিং প্রস্তাব তাদের কংগ্রেস ও সিনেটে পাস হয়েছে তাতে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির কী লাভ-ক্ষতি হবে? আমি তাঁদের বলেছি, বাংলাদেশের ক্ষতির চেয়েও তাদের ওই বিশাল ঘাটতি বাজেট বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থা, বিশেষ করে উদারনির্ভর সম্পদ ধারণ, ডলারে বৈদেশিক মুদ্রার ধারণ এবং আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন হবে।
বিশ্বকে অনেকটা নিরুপায় হয়ে আজও ডলারনির্ভর আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ওদের ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের সরকারি ঋণ বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থাকে বড় রকমের ঝাঁকুনি দেবে এবং ডলারের ওপর আস্থাহীনতাকে শুধুই ত্বরান্বিত করবে। তবে বিশ্বের সামনে বিকল্প এখনো সামান্যই। এক ইউরোপের ইউরো হতে পারত ডলারের প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু সেই আশাও এখন অনেক দূরে চলে গেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কতিপয় সদস্য দেশ বিশাল ঘাটতি বাজেট করে তাদের সরকারি ব্যয় মিটাচ্ছে। গ্রিস ও পর্তুগালের প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। জার্মানি ও ফ্রান্স তাদের উদ্ধার করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই। গ্রিস ও পর্তুগালে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সব শর্ত ভঙ্গ করে ইচ্ছামতো সরকারি ঋণ বাড়িয়েছে। এখন তারা ঋণের কিস্তির সুদ ও আসল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই অবস্থা এখনো হয়নি। তবে ক্রেডিট রেটিং কম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণকে এ গ্রেড থেকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এর অর্থ হবে যুক্তরাষ্ট্রও ভবিষ্যতে তার ঋণ ফেরৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে পারে। ওইসব আলামত লক্ষ করে চীন-ভারত-কোরিয়ার মতো অর্থনীতিগুলোর নাভিশ্বাস উঠেছে। তারা অতি দ্রুত তাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সম্পদ ধারণকে অন্য মুদ্রায় বা অন্য রকমের সম্পদ ধারণের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। বিশ্বে যে স্বর্ণের এখন অগি্নমূল্য, এক আউন্স স্বর্ণ এক হাজার ৫০০ ডলারের ওপরে, তারও মূল কারণ ডলারের ওপর মানুষের আস্থা হারানো। চীন-ভারত-কোরিয়া ইতিমধ্যে হয় প্রকৃত সম্পদ ধারণের দিকে অনেক এগিয়ে গেছে, নতুবা ডলার দিয়ে স্বর্ণ কিনে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হিসাবে রেখে দিয়েছে। এক কথায়, বাড়তি ডলার রিজার্ভ এখন কোনো দেশই রাখতে চাইছে না। এর মূল কারণ হলো, অর্থনীতিশাস্ত্র বলে সরকারের ঘাটতি বাজেট অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করে। আর মূল্যস্ফীতি মানে ডলারের মূল্য কমে যাওয়া। সেই অর্থে বিশ্বের যেসব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যক্তি ডলারে বৈদেশিক মুদ্রা ধারণ করছে বা ডলারে উলি্লখিত মূল্যে অন্য সম্পদ ধারণ করছে ওইসব সম্পদের মূল্য কমে যাচ্ছে।
তবে ব্যক্তিরাও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য স্বর্ণের দিকে যাচ্ছে। এই যে বিশ্বব্যাপী বড় স্টক এঙ্চেঞ্জগুলোর মূল্যসূচক বেড়ে গেল তারও মূল কারণ ডলারের মূল্য হারানোর ভীতি। বাংলাদেশ কিভাবে উপকৃত হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এর উত্তরে বলা যায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজাভের পুরোটাই যদি ডলারে থাকে তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ইউরোপের দিকে গিয়েও আসলে লাভ নেই। স্বর্ণ বা বিদেশে যদি প্রকৃত সম্পদ ধারণ করতে পারে তাহলে রিজার্ভ প্রকৃত মূল্য হারানো থেকে বেঁচে যেতে পারে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। যে ১০-১১ বিলিয়ন ডলার আছে সেটা আমাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতেই চলে যাবে। সুতরাং বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অত হারবে না। অন্য প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশের লাভ হবে কি না। সেই প্রশ্নের উত্তরে এটা বলা যায়, লাভ হতে পারে যদি বাংলাদেশ স্থির মূল্যে রপ্তানি বাড়াতে পারে। তবে সেই সুবিধা বাংলাদেশ পাবে বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশে ইতিমধ্যে টাকার বিপরীতে ইউএস ডলারের মূল্য বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যগুলোর উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাবে। অন্য আর একটি উপকার হতে পারে আমাদের বৈদেশিক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ তো প্রতিবছর প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের দায় বাবদ ফেরত দিচ্ছে। ওই দায়ের প্রকৃত ভার কমে যেতে পারে যদি ডলার মূল্য হারায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ডলার বিশ্বের অন্যান্য বড় মুদ্রাবাজারে মূল্য হারালেও বাংলাদেশে কিন্তু হারাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ সরকারের এই ক্ষেত্রেও তেমন সুবিধা হবে না।
আসল ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সমস্যা হলো গরিব মানুষের সমস্যা। ঋণ না করলে ভালো চলা যাচ্ছে না। আবার ঋণ না করলে ফেরত দেওয়ায় মুশকিল। ডলারনির্ভর বিশ্ব আর্থিক প্রথার উদ্ভব হয় সেই ১৯৪৬ সালে; যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিশ্ব ১৯৭১-এর পর থেকে ডলারের ওপর আস্থা হারাতে বসেছে। আর বর্তমানে এসে ডলারব্যবস্থা শুধু ভেঙে পড়েনি এই জন্যই যে বিশ্বের সামনে অন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেই। ডলারের ওপর আস্থা হারানোর মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ। রিপাবলিকানরা বারাক ওবামাকে দিয়ে ওয়াল স্ট্রিটের ভেঙে পড়া আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শত শত বিলিয়নস ডলার দিয়ে উদ্ধার করতে উৎসাহ জুগিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বেশি করে ট্যাঙ্ দিয়ে সেই ঘাটতি কমিয়ে আনার ঘোর বিরোধিতা করছে। তারাই এখন চাইছে ঋণের সীমা আরো বাড়ানো হোক। তাতে ওই দেশের ধনীরা লাভবান হবে। অন্যদিকে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ রিপাবলিকানদের নীতি অনুসরণ করে ডলার ছেপে সরকারি ঋণের জোগান দিচ্ছে। ১৯৯০-২০০৯ পর্যন্ত একটানা যুক্তরাষ্ট্র সঞ্চয় থেকে বেশি ব্যয় করেছে। সেই ঋণের জোগানদাতা হলো বিদেশিরা। আর সেই জন্য রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে পরজীবী অর্থনীতি বলেছেন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কতিপয় সদস্য দেশ বিশাল ঘাটতি বাজেট করে তাদের সরকারি ব্যয় মিটাচ্ছে। গ্রিস ও পর্তুগালের প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম। জার্মানি ও ফ্রান্স তাদের উদ্ধার করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই। গ্রিস ও পর্তুগালে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সব শর্ত ভঙ্গ করে ইচ্ছামতো সরকারি ঋণ বাড়িয়েছে। এখন তারা ঋণের কিস্তির সুদ ও আসল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেই অবস্থা এখনো হয়নি। তবে ক্রেডিট রেটিং কম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ঋণকে এ গ্রেড থেকে নিচে নামিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। এর অর্থ হবে যুক্তরাষ্ট্রও ভবিষ্যতে তার ঋণ ফেরৎ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হতে পারে। ওইসব আলামত লক্ষ করে চীন-ভারত-কোরিয়ার মতো অর্থনীতিগুলোর নাভিশ্বাস উঠেছে। তারা অতি দ্রুত তাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সম্পদ ধারণকে অন্য মুদ্রায় বা অন্য রকমের সম্পদ ধারণের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে। বিশ্বে যে স্বর্ণের এখন অগি্নমূল্য, এক আউন্স স্বর্ণ এক হাজার ৫০০ ডলারের ওপরে, তারও মূল কারণ ডলারের ওপর মানুষের আস্থা হারানো। চীন-ভারত-কোরিয়া ইতিমধ্যে হয় প্রকৃত সম্পদ ধারণের দিকে অনেক এগিয়ে গেছে, নতুবা ডলার দিয়ে স্বর্ণ কিনে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হিসাবে রেখে দিয়েছে। এক কথায়, বাড়তি ডলার রিজার্ভ এখন কোনো দেশই রাখতে চাইছে না। এর মূল কারণ হলো, অর্থনীতিশাস্ত্র বলে সরকারের ঘাটতি বাজেট অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করে। আর মূল্যস্ফীতি মানে ডলারের মূল্য কমে যাওয়া। সেই অর্থে বিশ্বের যেসব কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ব্যক্তি ডলারে বৈদেশিক মুদ্রা ধারণ করছে বা ডলারে উলি্লখিত মূল্যে অন্য সম্পদ ধারণ করছে ওইসব সম্পদের মূল্য কমে যাচ্ছে।
তবে ব্যক্তিরাও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য স্বর্ণের দিকে যাচ্ছে। এই যে বিশ্বব্যাপী বড় স্টক এঙ্চেঞ্জগুলোর মূল্যসূচক বেড়ে গেল তারও মূল কারণ ডলারের মূল্য হারানোর ভীতি। বাংলাদেশ কিভাবে উপকৃত হবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এর উত্তরে বলা যায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজাভের পুরোটাই যদি ডলারে থাকে তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে ইউরোপের দিকে গিয়েও আসলে লাভ নেই। স্বর্ণ বা বিদেশে যদি প্রকৃত সম্পদ ধারণ করতে পারে তাহলে রিজার্ভ প্রকৃত মূল্য হারানো থেকে বেঁচে যেতে পারে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। যে ১০-১১ বিলিয়ন ডলার আছে সেটা আমাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতেই চলে যাবে। সুতরাং বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অত হারবে না। অন্য প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশের লাভ হবে কি না। সেই প্রশ্নের উত্তরে এটা বলা যায়, লাভ হতে পারে যদি বাংলাদেশ স্থির মূল্যে রপ্তানি বাড়াতে পারে। তবে সেই সুবিধা বাংলাদেশ পাবে বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশে ইতিমধ্যে টাকার বিপরীতে ইউএস ডলারের মূল্য বাড়ছে। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যগুলোর উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাবে। অন্য আর একটি উপকার হতে পারে আমাদের বৈদেশিক ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ তো প্রতিবছর প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের দায় বাবদ ফেরত দিচ্ছে। ওই দায়ের প্রকৃত ভার কমে যেতে পারে যদি ডলার মূল্য হারায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ডলার বিশ্বের অন্যান্য বড় মুদ্রাবাজারে মূল্য হারালেও বাংলাদেশে কিন্তু হারাচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ সরকারের এই ক্ষেত্রেও তেমন সুবিধা হবে না।
আসল ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের সমস্যা হলো গরিব মানুষের সমস্যা। ঋণ না করলে ভালো চলা যাচ্ছে না। আবার ঋণ না করলে ফেরত দেওয়ায় মুশকিল। ডলারনির্ভর বিশ্ব আর্থিক প্রথার উদ্ভব হয় সেই ১৯৪৬ সালে; যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিশ্ব ১৯৭১-এর পর থেকে ডলারের ওপর আস্থা হারাতে বসেছে। আর বর্তমানে এসে ডলারব্যবস্থা শুধু ভেঙে পড়েনি এই জন্যই যে বিশ্বের সামনে অন্য বিকল্প ব্যবস্থা নেই। ডলারের ওপর আস্থা হারানোর মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণ। রিপাবলিকানরা বারাক ওবামাকে দিয়ে ওয়াল স্ট্রিটের ভেঙে পড়া আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শত শত বিলিয়নস ডলার দিয়ে উদ্ধার করতে উৎসাহ জুগিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বেশি করে ট্যাঙ্ দিয়ে সেই ঘাটতি কমিয়ে আনার ঘোর বিরোধিতা করছে। তারাই এখন চাইছে ঋণের সীমা আরো বাড়ানো হোক। তাতে ওই দেশের ধনীরা লাভবান হবে। অন্যদিকে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ রিপাবলিকানদের নীতি অনুসরণ করে ডলার ছেপে সরকারি ঋণের জোগান দিচ্ছে। ১৯৯০-২০০৯ পর্যন্ত একটানা যুক্তরাষ্ট্র সঞ্চয় থেকে বেশি ব্যয় করেছে। সেই ঋণের জোগানদাতা হলো বিদেশিরা। আর সেই জন্য রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে পরজীবী অর্থনীতি বলেছেন।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments