ঢাকায় উড়াল সড়কের যৌক্তিকতা কতটুকু
ঢাকার জন্য উড়াল সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত যে আত্মঘাতী সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। 'ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ এ বছর জুলাইতে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও জমি হস্তান্তর ও টাকা জোগাড়ে ঝামেলা হওয়ায় কাজ আপাতত আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে।
এর মাঝে নীতিনির্ধারকরা যদি এর ক্ষতি বুঝে উঠে ব্যবস্থা নিতে পারেন তবেই মঙ্গল সরকার মহানগরী ঢাকার যানজট নিরসনের লক্ষ্যে 'ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে' নামক বৃহৎ একটি উড়াল সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিতব্য ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ (র্যাম্প ও অন্যান্য অবকাঠামো মিলিয়ে দৈর্ঘ্য প্রায় ৪২ কিলোমিটার) এই উড়াল সড়ক ঢাকার উত্তরে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে গুলশান, মহাখালী, তেজগাঁও, মতিঝিলসহ মহানগরীর বিভিন্ন ব্যস্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্রের পাশ দিয়ে দক্ষিণে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। উড়াল সড়কটি নির্মাণে সরকার গত ১৯ জানুয়ারি ইতালি ও থাইল্যান্ডের যৌথ মালিকানাধীন ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু ঢাকার মতো জনবহুল শহরে এ ধরনের বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে যে ধরনের সমীক্ষা বা ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রয়োজন তা না করেই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে (ডেইলি স্টার, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১০), যা নাগরিক হিসেবে সবার জন্য উদ্বেগজনক। সরকার ঢাকার জন্য গৃহীত 'স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট পল্গ্যান' বা এসটিপির ভিত্তিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বললেও সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রস্তাবমতে প্রকল্পটি এসটিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল মাত্র (প্রাথমিক পর্যায়ে যদিও বাদ দেওয়া হয়েছিল); কিন্তু এর ওপর কোনো বিশদ গবেষণা বা সমীক্ষা করা হয়নি। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ঢাকার যানজট নিরসনে এই প্রকল্পের সাফল্যের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে; অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকেও এটি ঢাকার জন্য হতে পারে আত্মঘাতী।
ঢাকায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উড়াল সড়ক নির্মাণ করার পেছনে মূল যুক্তি দেওয়া হচ্ছে এর অসহনীয় যানজট সমস্যা নিরসন। কিন্তু যানজট নিরসনে এই উড়াল সড়ক আসলে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে? উড়াল সড়কের প্রধান কাজ দূরপাল্লার যাত্রাকে সহজ করা। একটি শহরের অভ্যন্তরীণ যানজট নিরসনে এর তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকাই নেই। বরং উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে উড়াল সড়ক রাস্তায় গাড়ি চলাচল ও গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দেওয়া। উড়াল সড়ক নির্মাণের ফলে রাস্তার ধারণক্ষমতা আপাতদৃষ্টিতে বাড়লেও কার্যত স্থানীয় পরিবহন ব্যবস্থার ওপর এর বিপরীত প্রভাব পড়ছে। ঢাকায় ইতিমধ্যে নির্মিত মহাখালী ও খিলগাঁও উড়াল সেতু যানজট কমানোর বিপরীতে জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে চলেছে। সম্প্রতি এসব উড়াল সেতুতে ভারী যানবাহন, যাত্রীবাহী বাস ইত্যাদি চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যে কোনো শহর, বিশেষ করে ঢাকার মতো জনবহুল শহরের ক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মাণ এবং যাতায়াতের চাহিদার মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। উড়াল সড়ক নির্মাণ একটি গাড়িকেন্দ্রিক সমাধান, যা অল্পসংখ্যক মানুষের যাতায়াত চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রাস্তায় আরও বেশি গাড়ির চাহিদার সৃষ্টি করবে। এর বিপরীতে রয়েছে গণপরিবহনভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণ যা বেশি মানুষের যাতায়াত চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম এবং গণতান্ত্রিক-সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের অধিকতর নিশ্চয়তা প্রদান করে। যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে নির্মাণ ও চাহিদার সমন্বয় তাই জরুরি। বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় অধিকাংশ পরিবহন পরিকল্পনাবিদ গণপরিবহনভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই উত্তম সমাধান বলে মনে করেন, যা বেশি মানুষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গাড়ির ব্যবহারকেও নিরুৎসাহিত করে। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (২০০৫) একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ব্যক্তিগত গাড়ি ঢাকার মোট ট্রাফিকের মাত্র ৩ শতাংশের (যান্ত্রিক বাহনের হিসেবে প্রায় ৯ শতাংশের) প্রতিনিধিত্ব করে; কিন্তু এরা মোট রাস্তার ৪০ শতাংশ দখল করে রাখে। ঢাকা মহানগরীতে যানজটের মূল উৎস এসব গাড়িই এবং এদের নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা না করে উড়াল সড়ক, উড়াল সেতু ইত্যাদি নির্মাণ করে রাস্তায় এদের আরও জায়গা দেওয়া হলে দীর্ঘমেয়াদে আরও বেশি মাত্রায় যানজট সৃষ্টি হবে। এছাড়াও সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকায় উলেল্গখযোগ্যসংখ্যক ট্রিপ হয় ছোট দূরত্বের। যানজট নিরসনের কথা বলা হলেও শুধু টোল প্রদানের ভিত্তিতে ঢাকা উড়াল সড়ক ব্যবহার করা যাবে। টোল আদায় করার কারণে এসব ট্রিপে উড়াল সড়ক খুব কমই ব্যবহৃত হওয়ার কথা। বরং উড়াল সড়কের কারণে ঢাকার বাইরে থেকে আরও বেশি পরিমাণে দূরপাল্লার যানবাহন শহরে ভিড় করে যানজট আরও দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।
নগর যোগাযোগ ব্যবস্থায় উড়াল সড়ক নির্মাণ অনেক পুরনো ধারণা (এবং বর্তমান টেকসই উন্নয়নের যুগে অনেকটা প্রত্যাখ্যাতও বটে)। বিখ্যাত স্থপতি লা কর্বুসিয়ের ১৯২২ সালে প্রথম গ্রেড সেপারেটেড হাইওয়ের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমেরিকানদের মাঝে এই ধারণা জনপ্রিয় করে তুলেছিল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরস করপোরেশন। ১৯৩৯ সালে নিউইয়কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড ফেয়ারে তারা 'ফিউচারামা' নামে গাড়ি ও এক্সপ্রেসওয়ে-নির্ভর ভবিষ্যতের শহর (Cities of Tomorrow) কেমন হবে তার এক প্রদর্শনী করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ফিউচারামায় এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে আমেরিকানরা সুন্দর ও বাসযোগ্য নগরের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু বাস্তবে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে আমেরিকার শহরগুলো কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হওয়া ছাড়া তার ধারে-কাছেও কিছু হতে পারেনি।
পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে এখন উড়াল সড়কগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে বা এগুলোকে ভেঙে বুলেভার্ডে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কানাডার টরন্টোতে ১৯৯০-এর দশকে একটি উড়াল সড়ক ভেঙে সেখানে বুলেভার্ড ও সাইকেল-পাথ নির্মাণ করা হয়। পুরনো সেই সড়কের কিছু স্তম্ভ এখনও সেখানে রেখে দেওয়া হয়েছে অতীতে করা একটি ভুলের স্মারক হিসেবে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি নিজে উদ্যোগ নিয়ে রাজধানীর একটি বৃহৎ উড়াল সড়ক ভেঙে দেন। সারা পৃথিবী যখন এখন একদিকে হাঁটছে টেকসই উন্নয়ন ও 'মানুষের জন্য শহর' নির্মাণের কথা বলছে, আমরা তখন এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে উল্টো দিকে অর্থাৎ সেই ১৯৫০-৬০ দশকের দিকে হাঁটা শুরু করেছি।
ঢাকা শহরে ইদানীং প্রায়শই হালকা থেকে মাঝারি ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। যে কোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্পও হতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৯৮৯ এবং ১৯৯৪ সালের ভূমিকম্পে অনেক উড়াল সড়ক ধসে পড়েছিল। সানফ্রান্সিসকোতে শুধু একটি উড়াল সড়ক ভেঙে পড়লে ৪২ জন নিহত হয়েছিল। উড়াল সড়কের নির্মাণ খরচ যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি এর পুনর্নিমাণ আরও বেশি খরুচে। এ ছাড়া নির্মাণগত ত্রুটির কারণেও উড়াল সড়ক ভেঙে পড়ার নজির রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে ঢাকা শহর এমনিতেই একটি কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে, যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা, আবাসন, পরিবেশ সবকিছু ভূমিকম্প ছাড়াই প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। বড় আকারের ভূমিকম্প হলে এখানে ক্ষয়ক্ষতি হবে অকল্পনীয়। এ অবস্থায় যোগাযোগ দুর্বিষহ করতে সক্ষম আর কংক্রিটের দৈত্য এ শহরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কফিনে অনেকটা শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতোই।
আসলে আমাদের প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে মূল সমস্যাটা কোথায়, তারপর খুঁজতে হবে এর যথার্থ সমাধান। কিন্তু ব্যাপারটা যদি উল্টো হয়, মানে একটি বহু বিজ্ঞাপিত সমাধান (!) দেখেই তা কোনো বিবেচনা না করে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়, তাহলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতোই অবস্থা হবে। অন্য যে কোনো বড় শহরের মতো আমাদের সমস্যা নাগরিকের যাতায়াত, তাদের বাহকের যাতায়াত নয়। আর প্রায় অর্ধেক পায়ে চলা মানুষের এই শহরে যান্ত্রিক গতির ব্যাপার যদি এসেই পড়ে সেটা গুটিকতক ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য নাকি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কর্তৃক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত যানের কথা চিন্তা করে করা হবে সে প্রশ্ন করা জরুরি বৈকি। উড়াল সড়ক হলে যানজটে আটকেপড়া ব্যক্তিগত বাহনের গতি সাময়িকভাবে খানিকটা বাড়তে পারে, কিন্তু প্রাথমিক বাড়তি গতি রাস্তায় আরও ব্যক্তিগত বাহন বা গাড়ি নামানোর প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনবে। বাসযাত্রী বা পায়ে চলা নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ কিংবা অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে সিএনজি অটোরিকশায় উঠতে না পেরে রাস্তায় অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ভাগ্যকে দুষতে থাকা মধ্যবিত্ত মানুষের দৈনন্দিন যাত্রায় এই বিনিয়োগ কোনো গতি, স্বাছন্দ্য বা সাশ্রয় আনবে না। কিন্তু উড়াল সড়কের বিকল্প সমাধান কী হতে পারে? ঢাকার জন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণই হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরী সমাধান। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা শহরের সিংহভাগ মানুষই ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করেন না। এই বাস্তবতায় গণপরিবহনভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থাই হতে পারে এই শহরের জন্য বাস্তব সমাধান। সরকার মেট্রো এবং উড়াল সড়ক নির্মাণে জোর দিলেও এসটিপিতে প্রথম পছন্দ হিসেবে বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কথা বলা হয়েছিল, গণপরিবহন হিসেবে যানজট নিরসনে যার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং কম খরচে, বর্তমান রাস্তার ধারণক্ষমতাতেই যা অবিলম্বে চালু করা সম্ভব। মেট্রো চালু হওয়া যদিও সময়সাপেক্ষ, কিন্তু উড়াল সড়কের পরিবর্তে বিআরটি চালু করে কম সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা যায়। কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে, ঢাকায় বিআরটির প্রকল্প চলছে সন্দেহজনকভাবে খুবই ধীরগতিতে এবং ভবিষ্যতে এটিকে মেট্রো রেল বা উড়াল সড়কের সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করা হবে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
ঢাকার জন্য উড়াল সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত যে আত্মঘাতী সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। 'ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ এ বছর জুলাইতে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও জমি হস্তান্তর ও টাকা জোগাড়ে ঝামেলা হওয়ায় কাজ আপাতত আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে। এর মাঝে নীতিনির্ধারকরা যদি এর ক্ষতি বুঝে উঠে ব্যবস্থা নিতে পারেন তবেই মঙ্গল। আর এ বোঝানোর দায়িত্ব অনেকটা দেশের জনগণ, ঢাকাবাসী, এ শহরকে যারা ভালোবাসেন_ সবার ওপরই বর্তায়।
লেখকবৃন্দ : বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের স্নাতক এবং বর্তমানে বুয়েট ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত
ঢাকায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উড়াল সড়ক নির্মাণ করার পেছনে মূল যুক্তি দেওয়া হচ্ছে এর অসহনীয় যানজট সমস্যা নিরসন। কিন্তু যানজট নিরসনে এই উড়াল সড়ক আসলে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে? উড়াল সড়কের প্রধান কাজ দূরপাল্লার যাত্রাকে সহজ করা। একটি শহরের অভ্যন্তরীণ যানজট নিরসনে এর তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকাই নেই। বরং উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে উড়াল সড়ক রাস্তায় গাড়ি চলাচল ও গাড়ির সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দেওয়া। উড়াল সড়ক নির্মাণের ফলে রাস্তার ধারণক্ষমতা আপাতদৃষ্টিতে বাড়লেও কার্যত স্থানীয় পরিবহন ব্যবস্থার ওপর এর বিপরীত প্রভাব পড়ছে। ঢাকায় ইতিমধ্যে নির্মিত মহাখালী ও খিলগাঁও উড়াল সেতু যানজট কমানোর বিপরীতে জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে চলেছে। সম্প্রতি এসব উড়াল সেতুতে ভারী যানবাহন, যাত্রীবাহী বাস ইত্যাদি চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যে কোনো শহর, বিশেষ করে ঢাকার মতো জনবহুল শহরের ক্ষেত্রে অবকাঠামো নির্মাণ এবং যাতায়াতের চাহিদার মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। উড়াল সড়ক নির্মাণ একটি গাড়িকেন্দ্রিক সমাধান, যা অল্পসংখ্যক মানুষের যাতায়াত চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রাস্তায় আরও বেশি গাড়ির চাহিদার সৃষ্টি করবে। এর বিপরীতে রয়েছে গণপরিবহনভিত্তিক অবকাঠামো নির্মাণ যা বেশি মানুষের যাতায়াত চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম এবং গণতান্ত্রিক-সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের অধিকতর নিশ্চয়তা প্রদান করে। যানজট নিরসনের ক্ষেত্রে নির্মাণ ও চাহিদার সমন্বয় তাই জরুরি। বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক বিবেচনায় অধিকাংশ পরিবহন পরিকল্পনাবিদ গণপরিবহনভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থাকেই উত্তম সমাধান বলে মনে করেন, যা বেশি মানুষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গাড়ির ব্যবহারকেও নিরুৎসাহিত করে। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের (২০০৫) একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ব্যক্তিগত গাড়ি ঢাকার মোট ট্রাফিকের মাত্র ৩ শতাংশের (যান্ত্রিক বাহনের হিসেবে প্রায় ৯ শতাংশের) প্রতিনিধিত্ব করে; কিন্তু এরা মোট রাস্তার ৪০ শতাংশ দখল করে রাখে। ঢাকা মহানগরীতে যানজটের মূল উৎস এসব গাড়িই এবং এদের নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা না করে উড়াল সড়ক, উড়াল সেতু ইত্যাদি নির্মাণ করে রাস্তায় এদের আরও জায়গা দেওয়া হলে দীর্ঘমেয়াদে আরও বেশি মাত্রায় যানজট সৃষ্টি হবে। এছাড়াও সমীক্ষা অনুযায়ী ঢাকায় উলেল্গখযোগ্যসংখ্যক ট্রিপ হয় ছোট দূরত্বের। যানজট নিরসনের কথা বলা হলেও শুধু টোল প্রদানের ভিত্তিতে ঢাকা উড়াল সড়ক ব্যবহার করা যাবে। টোল আদায় করার কারণে এসব ট্রিপে উড়াল সড়ক খুব কমই ব্যবহৃত হওয়ার কথা। বরং উড়াল সড়কের কারণে ঢাকার বাইরে থেকে আরও বেশি পরিমাণে দূরপাল্লার যানবাহন শহরে ভিড় করে যানজট আরও দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।
নগর যোগাযোগ ব্যবস্থায় উড়াল সড়ক নির্মাণ অনেক পুরনো ধারণা (এবং বর্তমান টেকসই উন্নয়নের যুগে অনেকটা প্রত্যাখ্যাতও বটে)। বিখ্যাত স্থপতি লা কর্বুসিয়ের ১৯২২ সালে প্রথম গ্রেড সেপারেটেড হাইওয়ের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আমেরিকানদের মাঝে এই ধারণা জনপ্রিয় করে তুলেছিল গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরস করপোরেশন। ১৯৩৯ সালে নিউইয়কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড ফেয়ারে তারা 'ফিউচারামা' নামে গাড়ি ও এক্সপ্রেসওয়ে-নির্ভর ভবিষ্যতের শহর (Cities of Tomorrow) কেমন হবে তার এক প্রদর্শনী করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ফিউচারামায় এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে আমেরিকানরা সুন্দর ও বাসযোগ্য নগরের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু বাস্তবে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে আমেরিকার শহরগুলো কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হওয়া ছাড়া তার ধারে-কাছেও কিছু হতে পারেনি।
পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে এখন উড়াল সড়কগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে বা এগুলোকে ভেঙে বুলেভার্ডে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কানাডার টরন্টোতে ১৯৯০-এর দশকে একটি উড়াল সড়ক ভেঙে সেখানে বুলেভার্ড ও সাইকেল-পাথ নির্মাণ করা হয়। পুরনো সেই সড়কের কিছু স্তম্ভ এখনও সেখানে রেখে দেওয়া হয়েছে অতীতে করা একটি ভুলের স্মারক হিসেবে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি নিজে উদ্যোগ নিয়ে রাজধানীর একটি বৃহৎ উড়াল সড়ক ভেঙে দেন। সারা পৃথিবী যখন এখন একদিকে হাঁটছে টেকসই উন্নয়ন ও 'মানুষের জন্য শহর' নির্মাণের কথা বলছে, আমরা তখন এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে উল্টো দিকে অর্থাৎ সেই ১৯৫০-৬০ দশকের দিকে হাঁটা শুরু করেছি।
ঢাকা শহরে ইদানীং প্রায়শই হালকা থেকে মাঝারি ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। যে কোনো সময় বড় আকারের ভূমিকম্পও হতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ১৯৮৯ এবং ১৯৯৪ সালের ভূমিকম্পে অনেক উড়াল সড়ক ধসে পড়েছিল। সানফ্রান্সিসকোতে শুধু একটি উড়াল সড়ক ভেঙে পড়লে ৪২ জন নিহত হয়েছিল। উড়াল সড়কের নির্মাণ খরচ যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি এর পুনর্নিমাণ আরও বেশি খরুচে। এ ছাড়া নির্মাণগত ত্রুটির কারণেও উড়াল সড়ক ভেঙে পড়ার নজির রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে ঢাকা শহর এমনিতেই একটি কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে, যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা, আবাসন, পরিবেশ সবকিছু ভূমিকম্প ছাড়াই প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। বড় আকারের ভূমিকম্প হলে এখানে ক্ষয়ক্ষতি হবে অকল্পনীয়। এ অবস্থায় যোগাযোগ দুর্বিষহ করতে সক্ষম আর কংক্রিটের দৈত্য এ শহরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কফিনে অনেকটা শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতোই।
আসলে আমাদের প্রথমে চিহ্নিত করতে হবে মূল সমস্যাটা কোথায়, তারপর খুঁজতে হবে এর যথার্থ সমাধান। কিন্তু ব্যাপারটা যদি উল্টো হয়, মানে একটি বহু বিজ্ঞাপিত সমাধান (!) দেখেই তা কোনো বিবেচনা না করে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়, তাহলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতোই অবস্থা হবে। অন্য যে কোনো বড় শহরের মতো আমাদের সমস্যা নাগরিকের যাতায়াত, তাদের বাহকের যাতায়াত নয়। আর প্রায় অর্ধেক পায়ে চলা মানুষের এই শহরে যান্ত্রিক গতির ব্যাপার যদি এসেই পড়ে সেটা গুটিকতক ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য নাকি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কর্তৃক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত যানের কথা চিন্তা করে করা হবে সে প্রশ্ন করা জরুরি বৈকি। উড়াল সড়ক হলে যানজটে আটকেপড়া ব্যক্তিগত বাহনের গতি সাময়িকভাবে খানিকটা বাড়তে পারে, কিন্তু প্রাথমিক বাড়তি গতি রাস্তায় আরও ব্যক্তিগত বাহন বা গাড়ি নামানোর প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনবে। বাসযাত্রী বা পায়ে চলা নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ কিংবা অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে সিএনজি অটোরিকশায় উঠতে না পেরে রাস্তায় অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ভাগ্যকে দুষতে থাকা মধ্যবিত্ত মানুষের দৈনন্দিন যাত্রায় এই বিনিয়োগ কোনো গতি, স্বাছন্দ্য বা সাশ্রয় আনবে না। কিন্তু উড়াল সড়কের বিকল্প সমাধান কী হতে পারে? ঢাকার জন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণই হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকরী সমাধান। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা শহরের সিংহভাগ মানুষই ব্যক্তিগত গাড়িতে চলাচল করেন না। এই বাস্তবতায় গণপরিবহনভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থাই হতে পারে এই শহরের জন্য বাস্তব সমাধান। সরকার মেট্রো এবং উড়াল সড়ক নির্মাণে জোর দিলেও এসটিপিতে প্রথম পছন্দ হিসেবে বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কথা বলা হয়েছিল, গণপরিবহন হিসেবে যানজট নিরসনে যার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ এবং কম খরচে, বর্তমান রাস্তার ধারণক্ষমতাতেই যা অবিলম্বে চালু করা সম্ভব। মেট্রো চালু হওয়া যদিও সময়সাপেক্ষ, কিন্তু উড়াল সড়কের পরিবর্তে বিআরটি চালু করে কম সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা যায়। কিন্তু হতাশার কথা হচ্ছে, ঢাকায় বিআরটির প্রকল্প চলছে সন্দেহজনকভাবে খুবই ধীরগতিতে এবং ভবিষ্যতে এটিকে মেট্রো রেল বা উড়াল সড়কের সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করা হবে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
ঢাকার জন্য উড়াল সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত যে আত্মঘাতী সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। 'ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ এ বছর জুলাইতে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও জমি হস্তান্তর ও টাকা জোগাড়ে ঝামেলা হওয়ায় কাজ আপাতত আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে। এর মাঝে নীতিনির্ধারকরা যদি এর ক্ষতি বুঝে উঠে ব্যবস্থা নিতে পারেন তবেই মঙ্গল। আর এ বোঝানোর দায়িত্ব অনেকটা দেশের জনগণ, ঢাকাবাসী, এ শহরকে যারা ভালোবাসেন_ সবার ওপরই বর্তায়।
লেখকবৃন্দ : বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের স্নাতক এবং বর্তমানে বুয়েট ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত
No comments