মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার পথ-জনদুর্ভোগ কমানোই মুখ্য হোক
বিশ্বব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানের কাজের নির্দিষ্ট ধারা রয়েছে। তারা জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, রাসায়নিক সার প্রভৃতি পণ্যে ভর্তুকি কমিয়ে ফেলা কিংবা প্রত্যাহার করতে বলে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে সেটা নিয়ন্ত্রণের নির্দিষ্ট ফর্মুলা অনুসরণের সুপারিশ তারা করে থাকে।
মঙ্গলবার আইএমএফের ঢাকায় সফররত প্রতিনিধি দলের এক কর্মকর্তা আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার মতে, এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগান্তি আরও বাড়বে। একই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রস্তাব সাময়িক সময়ের জন্য হলেও নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগের কথাও চিন্তা করতে হবে। লক্ষণীয়, প্রধানমন্ত্রী এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সফররত কর্মকর্তা উভয়েই জনগণের ভোগান্তি কমানোর পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে তাদের ধারণা বলা যায় প্রায় বিপরীত। প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, জ্বালানি তেলের দাম এখনই বাড়ানো হচ্ছে না। কৃষি উপকরণ বিশেষত রাসায়নিক সারের দাম না বাড়ানোর পক্ষেও তিনি দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে এটাও লক্ষণীয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আইএমএফের চিন্তার মিল রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে। তবে এ খাতে চাহিদা ১৬ হাজার কোটি টাকা। আইএমএফ বলছে, জ্বালানি তেলে ভর্তুকির কারণে সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়বে, তা মেটাতে গিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ বাড়বে এবং তার পরিণতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। বলা যায়, উভয় বক্তব্যেই জোরালো যুক্তি রয়েছে। এটাও বাস্তবতা যে, মূল্যস্ফীতির চাপ এমনিতেই প্রবল এবং দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠী তো বটেই, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরাও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। মঙ্গলবার খাদ্য, মানবাধিকার ও রাষ্ট্র শীর্ষক এক আলোচনায় জানানো হয়, যেসব পরিবারের আয়ের ৭০ শতাংশ খাদ্যপণ্য কিনতে ব্যয় হয় তাদের দুর্দশা চরমে। বক্তারা খাদ্য ব্যবস্থাপনাকে সিন্ডিকেটমুক্ত করারও দাবি করেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান অনুষ্ঠানে দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলেছেন, খাদ্য অধিকার কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে আরও বিরূপ প্রভাব পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। এ ধরনের পদক্ষেপের সম্ভাব্য প্রভাব পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থ মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি নিয়ে দ্রুত পর্যালোচনা করবে, এটাই প্রত্যাশিত। একটা সময় ছিল যখন দাতা সংস্থা কোনো পরামর্শ-সুপারিশ রাখলে তা মেনে চলা ছিল রীতিমতো বাধ্যতামূলক। এখন পরিস্থিতি যথেষ্টই ভিন্ন। সরকার ভিন্নমত রাখতে পারছে এবং দাতারাও তাকে একেবারে উপেক্ষা করতে পারছে না। এটা তাদের বুঝতে হবে যে, বিদ্যুৎ-জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো ও না বাড়ানো উভয় পরিস্থিতিতেই যদি মূল্যস্ফীতি বাড়ে তাহলে জনদুর্ভোগ কমাতে ভিন্ন চিন্তা করাই শ্রেয় এবং এ ক্ষেত্রে প্রধান দায় সরকারের ওপরই বর্তায়।
No comments