সড়ক দুর্ঘটনা-দায়ী চালকদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে by মঞ্জুলী কাজী

আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। তার দায় কেউ নিচ্ছে না। যোগাযোগমন্ত্রীরও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁর চিন্তা, কী করে বাস বা ট্রাকের বেপরোয়া চালকদের বাঁচানো যায়। সড়ক বা মহাসড়ক যে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে, সে ভাবনা করে তিনি সময় নষ্ট করেন না। তার চেয়ে অনেক বড় চিন্তা তাঁর পদ্মা সেতু।


গাজীপুরে ডাক্তার ও প্রকৌশলী দম্পতির গাড়িকে এক ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে দুজনেরই প্রাণ গেল। বেঁচে গেল তাঁদের শিশুসন্তান। এই শিশু একই সঙ্গে বাবা-মাকে হারিয়ে পুরোপুরি এতিম হয়ে গেল। যে ট্রাক তাঁদের গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছিল, সেই ড্রাইভারের কী হলো, সে সংবাদ কিন্তু প্রকাশ হয়নি। হয়তো কোনো মন্ত্রী বা শ্রমিকনেতার ছত্রচ্ছায়ায় সেই ড্রাইভার নিরাপদেই রয়েছেন। একটিবারের জন্যও ওই শিশুর কথা যোগাযোগমন্ত্রীর মনে পড়েছে কি? নৌপরিবহন বা যোগাযোগমন্ত্রী ও বাস শ্রমিকনেতারা এই বেপরোয়া ড্রাইভারদের কার্যক্রমের দায়ভার কি নেবেন না কোনো দিন? হবে না কোনো বেপরোয়া চালকদের বিচার?
বাস শ্রমিকনেতারা সব সময়ই বলেন, তাঁরা শ্রমিক জনগণের বন্ধু, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব পরিবার স্বজন হারায়, তাদের কাছে কেন শ্রমিকনেতারা আসেন না বন্ধু হয়ে? যে শিশু একসঙ্গে বাবা-মাকে হারাল, তার কাছে কী জবাব দেবেন যোগাযোগমন্ত্রী বা শ্রমিকনেতারা? একজন চিকিৎসক, একজন প্রকৌশলী গড়তে বাংলাদেশ সরকারের কী পরিমাণ অর্থ ও সময় ব্যয় হয়, তার খবর বোধ করি এসব নেতা-গোষ্ঠী নেন না বা জানার প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে যান। তাঁরা যদি এতই বাস-ট্রাক শ্রমিকদের নেতা হয়ে থাকেন, তাহলে কেন আজ মহাসড়কগুলোর যে বেহাল অবস্থা, তার প্রতিকারের জন্য কোনো আন্দোলন করেন না? শ্রমিকনেতারা তা করবেন না। নিজেদের আপনজন সড়ক দুর্ঘটনায় চিরতরে হারিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আসলে কেউ বুঝতে পারেন না, ক্ষতটা কত গভীর।
সড়ক দুর্ঘটনায় তদন্তও হয় না। যদিও বা তদন্ত নামক প্রহসন করা হয়, সেই তদন্ত আলোর মুখ কোনো দিনই দেখে না, ঊর্ধ্বতন নেতাদের অঙ্গুলির নির্দেশে এভাবেই চলে আসছে আমাদের জনগণের ভাগ্য। আমরা আজ জিম্মি মন্ত্রী, শ্রমিকনেতা, সরকারপ্রধান ও বিরোধী দলের নেতাদের হাতে। মোট কথা, রাজনৈতিক নেতাদের হাতে। তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর জনগণের ভাগ্য নির্ভর করছে। এত যে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে, কেন বিরোধী দলের কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না এর প্রতিকারের জন্য। বিরোধী দলের নেত্রী এত সব দাবি করে যাচ্ছেন সারা দেশে বিভিন্ন সভায়, কই, একবারও তো কোনো সভায় জোরদার দাবি করে বলেন না, ‘সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে আজ এক ভয়াবহ সমস্যা।’ না, তিনি বলবেন না দেশের এই বর্তমান ভয়াবহ সমস্যার কথা। তিনি তো দেশের জন্য রাজনীতি করেন, দেশের জনসাধারণের জন্য করেন না। এর দায়ও যে তাঁর ঘাড়ে পড়ে, তা কি তিনি বুঝতে চেষ্টা করেন? আমাদের দুঃখ কি, আমাদের দেশে যে সরকারই আসুক না কেন, কোনো সরকারই সড়ক বা নৌদুর্ঘটনার দায় নিতে চায় না; বরং শ্রমিক সংগঠনের নাম করে বেপরোয়া ড্রাইভারদের জামিনে বাঁচিয়ে তাঁদের হাতে আবার তুলে দেয় যানবাহনের চাবি। যাতে করে আরও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে আরও মানুষকে নিয়ে যেতে পারেন মৃত্যুর কাছে।
মিরসরাইয়ে যে ৪৮ জন কিশোর একসঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল, তার যে তদন্ত হলো, সেটার ফলাফল কী? এই কিশোরদের স্বপ্ন, তাদের বাবা-মায়ের আশা যে ধূলিসাৎ হয়ে গেল; সেই হতভাগ্য পিতা-মাতার কাছে কি গিয়েছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী? নিশ্চয়ই সময় হয়নি। সময় কোথায় সময় নষ্ট করার এই হতভাগ্য পরিবারের কাছে গিয়ে! সেই হেলপার নামক ড্রাইভারের হয়েছে কি কোনো বিচার? বিচার বলতে আমি কেপিট্যাল পানিশমেন্টের কথা বলছি না। কিন্তু তাই বলে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য লাইসেন্সবিহীন চালকদের মানুষ হত্যার বিচার হবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। বাংলাদেশে যানবাহনের একটি লাইসেন্স একাধিকবার একাধিক নামে ব্যবহার করা হচ্ছে। তা কী করে সম্ভব হচ্ছে সরকারের নাকের ডগায়? বাংলাদেশে একটি বাঘ মারলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। আর মানুষ মারলে হয় তিন বছর। আবার জামিনও মেলে, কিন্তু বাঘ মারলে মেলে না। তাহলে মানুষ থেকে বাঘের দাম অনেক। মানুষের দাম নেই আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে। কী করে আমাদের আইনমন্ত্রী, যিনি নিজেও একজন আইনজ্ঞ, এ ধরনের একপেশে আইন মেনে নিচ্ছেন? মানুষ হত্যার জন্য ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, যা আগে ছিল তা তিনি পুনরায় বহাল করছেন না? কেন যোগাযোগমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী সড়ক বা মহাসড়কের জন্য ট্রাফিক আইন ‘জিরো টলারেন্স’ করছেন না। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা কমানোর এই নীতি কি তাঁরা নিয়েছেন?
অবাক হই, নৌমন্ত্রী যখন টেলিভিশনের টক শোতে বলেন, সড়ক দুর্ঘটানায় অনেক সময় পুলিশি কেস হয় না। মালিক ও শ্রমিকনেতারা এসে সে হতভাগ্য (যার মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়) পরিবারের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে একটা সমঝোতা করে নেন। এর জন্য পুলিশও মধ্যস্থতা করে (যা আমাদের মাননীয় মন্ত্রী ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল)। আমাদের হতদরিদ্র জনগণের অভাবকে হাতিয়ার বানিয়ে এভাবেই পার পেয়ে আসছে এই ঘাতক গোষ্ঠী। আমাদের দেশের সবচেয়ে দুর্বলতা হলো প্রচলিত ট্রাফিক আইন। এই আইনের ফাঁক এতই বড় যে জিন্দাবাদ করতে করতে বেরিয়ে যেতে পারে যে কেউ। এখন সময় হয়েছে ট্রাফিক আইন সংশোধন করার। প্রচলিত ট্রাফিক আইনকে নতুন করে প্রণয়ন ও কঠিনভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে না এবং সড়ক ও মহাসড়ক মেরামতের দিকেও একই সঙ্গে দৃষ্টি দিতে হবে, জোড়াতালি দিয়ে মেরামতি নয়, সঠিকভাবে তা করতে হবে। জনসাধারণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা আর স্বজন হারাতে চাই না, আমরা চাই বেপরোয়া ড্রাইভারদের বিচার, যাদের কারণে আমরা জনসাধারণ স্বজন হারাচ্ছি প্রতিনিয়ত। আমাদের দাবি এই বেপরোয়া ঘাতক চালকদের বিচার।
মঞ্জুলী কাজী: সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চিত্রগ্রাহক ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরের স্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.