নিতুন কুণ্ডু :কিংবদন্তি ভাস্কর্যশিল্পী by রাজু আলীম
বাংলাদেশের শিল্পাকাশে এক কিংবদন্তি শিল্পীর নাম নিতুন কুণ্ডু। তিনি মূলত বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেলেও তার জলরঙ, তেলরঙে আঁকা জীবন ও প্রকৃতির ক্যানভাস আমাদের সৃজনশীল মনে এখনও দাগ কেটে আছে। এ ছাড়া তার হাতে গড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান 'অটবি' দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে পরিচিত। আমরা নিতুন কুণ্ডুকে ভাস্কর্যশিল্পী, অটবির স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে জানলেও তার পরিচয় আরও বহুমাত্রিক।
তিনি আমাদের দেশের চারু-কারু ও ভাস্কর্যশিল্পকে বিশ্বব্যাপী উপস্থাপন করার আজীবন চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের রাজধানীর সার্ক ফোয়ারার ঝর্ণাধারা বহির্বিশ্বের পর্যটকদের নজরকাড়ার মতো সৌন্দর্য, চট্টগ্রামের সাম্পান কিংবা রাজশাহীর 'সাবাস বাংলাদেশ'-এর ভাস্কর কিংবদন্তি শিল্পী নিতুন কুণ্ডু আজীবন বাঙালির স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকবেন।
কিশোরবেলা থেকেই শিল্প-সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন নিতুন কুণ্ডু। ১৯৫৫ সালে দিনাজপুরের অজপাড়াগাঁ থেকে মেইল ট্রেনে চড়ে প্রায় শূন্য হাতে যখন ঢাকায় আসেন, তখন থেকেই মনে হয় শিল্পের পোকা মাথায় ঢুকেছিল তার। শিল্পের শিশিরবিন্দু স্পর্শ করেছিল নিতুন কুণ্ডুকে। বিন্দু বিন্দু জল থেকেই সাগরের সৃষ্টি হয়। আর শিল্পের বিন্দু বিন্দু কণা থেকে নিতুন কুণ্ডুর শিল্পের প্রসারতা বেড়ে বিশালতায় রূপ নিয়েছিল। ভাস্কর নিতুন কুণ্ডুুর কাজে, কল্পনায়, ক্যানভাসে, ভাস্কর্যে ম্যাজিক চিত্রকল্প খেলা করে। স্বপ্নের জলরঙে আঁকা স্বপ্ন নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন নিজস্ব নীলিমা। শিল্পজীবন শুরু করেছিলেন সাইনবোর্ড ও ব্যানার আঁকা দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়ার প্রাথমিক পর্যায় থেকে নিত্যসঙ্গী ছিল রঙ-তুলি আর ক্যানভাস। স্বপ্ন ছিল বিখ্যাত শিল্পী হওয়ার। আশা ছিল অসংখ্য মানুষের ভিড়ে তাকে আলাদাভাবে খুঁজে পেতে। হতে চাইতেন একজন নামকরা শিল্পী। তার ইচ্ছা ছিল চারুকলার শিক্ষক হওয়ার। তিনি হয়তো কোনো একাডেমিক শিক্ষক হননি; কিন্তু পরোক্ষভাবে অনেকের শিক্ষাগুরু হয়ে আছেন; হয়েছেন শিল্পের পথপ্রদর্শক। শিল্পের নানা মাত্রিকতায় কাজ করেছেন নিতুন কুণ্ডু। শিল্পচিন্তার ক্ষুদ্র প্রয়াস থেকে শুরু করে বিশালতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। সামান্য কোটপিন, ক্রেস্ট, ট্রফি ডিজাইন থেকে শুরু করে আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটের সর্বোচ্চ শাখায় বিচরণ করেছিলেন এ শিল্পী। ১৯৭৫ সালে ঢাকার আজিমপুরে নিজের ছোট্ট বাসাতেই শিল্পের সূচনা করেছিলেন। ১৯৭০ সালে তোপখানা রোডে বিখ্যাত বিটপীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৩ সালে অটবি নামে বর্তমান সময়ের বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন তিনি। বর্তমানে অটবি নামের সঙ্গে সামান্য অর্থনৈতিক ঘ্রাণ থাকলেও তখন সাফল্যের হাতছানি ছিল না। নিষ্ঠার সঙ্গে অটবি নাম নিয়ে শুরু করেছিলেন তার শিল্পের এক ভিন্ন আঙ্গিক, অন্যরকম সাধনা। অটবি এখন চমৎকার শিল্পরূপ নিয়ে ফার্নিচার শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ। তিনি হয়তো কখনোই ভাবেননি অটবি এই পর্যায়ে আসবে। জীবনের নানা দুঃখ-বেদনার মধ্যেও তিনি শিল্পের পথ থেকে কখনও সরে দাঁড়াননি। শিল্পের দিকে কখনও ব্যবসায়ীর নজর দেননি। আজন্ম শিল্পী নিতুন কুণ্ডু দেশের সেরা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরূপে পরিচিত হলেও থেমে থাকেননি শিল্পচর্চায়। এই বিখ্যাত অঙ্কন ও ভাস্কর্যশিল্পী জন্মেছিলেন ১৯৩৫ সালে দিনাজপুরে। ১৯৫২ সালে তিনি দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই শিল্পী স্কুলজীবনেও ছিলেন প্রথম স্থানে। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুণ্ডু এবং মা বীণাপাণি কুণ্ডুুর আগ্রহ-মমতায় তার শিল্পের চেতনা বেড়ে ওঠে। নিতুন কুণ্ডু মায়ের অনুপ্রেরণায়, সহযোগিতায় এবং নিজের প্রচেষ্টায় একজন সফল শিল্পী হতে পেরেছিলেন।
১৯৫৯ সালে নিতুন কুণ্ডু তার জীবন শুরু করেছিলেন ডিজাইনার হিসেবে। ১৯৬২ সালে ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা ইউসিসে প্রধান ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইউসিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। পরে শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে যৌথভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর নানা ধরনের অঙ্কনের কাজ করেন। নিতুন কুণ্ডু মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী হিসেবে ব্যাপক আলোচিত। মূলত ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহের শেষ ছিল না তার। সবসময় পেইন্টিং এবং স্কাল্পচার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। শিল্পী হওয়ার নেশায় ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকতেন। তার আজীবন একজন শিল্পী হয়েই থাকার প্রবল ইচ্ছা ছিল। শিল্পের আকাঙ্ক্ষা হয়তো কখনোই শেষ হবে না। তার শিল্পের সর্বোচ্চ মিনারে অবস্থান করা এই শিল্পী ১৯৯৭ সালে অর্জন করেছিলেন একুশে পদক। তার হাতে গড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান অটবি ত্রিশ বছর অতিবাহিত করেছে। অটবি ছাড়াও নিতুন কুণ্ডু নিজেই একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। শিল্পী নিতুন কুণ্ডু তার সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। তিনি বাংলাদেশের শিল্পে নতুন ধারা তৈরি করেছেন নিঃসন্দেহে। তিনি আমাদের মাঝে সশরীরে নেই। আজ ১৫ সেপ্টেম্বর। তার মহাপ্রয়াণ দিবস। তার আত্মার প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
রাজু আলীম :কবি, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা
telepress@gmail.com
কিশোরবেলা থেকেই শিল্প-সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন নিতুন কুণ্ডু। ১৯৫৫ সালে দিনাজপুরের অজপাড়াগাঁ থেকে মেইল ট্রেনে চড়ে প্রায় শূন্য হাতে যখন ঢাকায় আসেন, তখন থেকেই মনে হয় শিল্পের পোকা মাথায় ঢুকেছিল তার। শিল্পের শিশিরবিন্দু স্পর্শ করেছিল নিতুন কুণ্ডুকে। বিন্দু বিন্দু জল থেকেই সাগরের সৃষ্টি হয়। আর শিল্পের বিন্দু বিন্দু কণা থেকে নিতুন কুণ্ডুর শিল্পের প্রসারতা বেড়ে বিশালতায় রূপ নিয়েছিল। ভাস্কর নিতুন কুণ্ডুুর কাজে, কল্পনায়, ক্যানভাসে, ভাস্কর্যে ম্যাজিক চিত্রকল্প খেলা করে। স্বপ্নের জলরঙে আঁকা স্বপ্ন নিয়ে তিনি তৈরি করেছিলেন নিজস্ব নীলিমা। শিল্পজীবন শুরু করেছিলেন সাইনবোর্ড ও ব্যানার আঁকা দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে পড়ার প্রাথমিক পর্যায় থেকে নিত্যসঙ্গী ছিল রঙ-তুলি আর ক্যানভাস। স্বপ্ন ছিল বিখ্যাত শিল্পী হওয়ার। আশা ছিল অসংখ্য মানুষের ভিড়ে তাকে আলাদাভাবে খুঁজে পেতে। হতে চাইতেন একজন নামকরা শিল্পী। তার ইচ্ছা ছিল চারুকলার শিক্ষক হওয়ার। তিনি হয়তো কোনো একাডেমিক শিক্ষক হননি; কিন্তু পরোক্ষভাবে অনেকের শিক্ষাগুরু হয়ে আছেন; হয়েছেন শিল্পের পথপ্রদর্শক। শিল্পের নানা মাত্রিকতায় কাজ করেছেন নিতুন কুণ্ডু। শিল্পচিন্তার ক্ষুদ্র প্রয়াস থেকে শুরু করে বিশালতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। সামান্য কোটপিন, ক্রেস্ট, ট্রফি ডিজাইন থেকে শুরু করে আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটের সর্বোচ্চ শাখায় বিচরণ করেছিলেন এ শিল্পী। ১৯৭৫ সালে ঢাকার আজিমপুরে নিজের ছোট্ট বাসাতেই শিল্পের সূচনা করেছিলেন। ১৯৭০ সালে তোপখানা রোডে বিখ্যাত বিটপীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৩ সালে অটবি নামে বর্তমান সময়ের বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলেন তিনি। বর্তমানে অটবি নামের সঙ্গে সামান্য অর্থনৈতিক ঘ্রাণ থাকলেও তখন সাফল্যের হাতছানি ছিল না। নিষ্ঠার সঙ্গে অটবি নাম নিয়ে শুরু করেছিলেন তার শিল্পের এক ভিন্ন আঙ্গিক, অন্যরকম সাধনা। অটবি এখন চমৎকার শিল্পরূপ নিয়ে ফার্নিচার শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ। তিনি হয়তো কখনোই ভাবেননি অটবি এই পর্যায়ে আসবে। জীবনের নানা দুঃখ-বেদনার মধ্যেও তিনি শিল্পের পথ থেকে কখনও সরে দাঁড়াননি। শিল্পের দিকে কখনও ব্যবসায়ীর নজর দেননি। আজন্ম শিল্পী নিতুন কুণ্ডু দেশের সেরা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরূপে পরিচিত হলেও থেমে থাকেননি শিল্পচর্চায়। এই বিখ্যাত অঙ্কন ও ভাস্কর্যশিল্পী জন্মেছিলেন ১৯৩৫ সালে দিনাজপুরে। ১৯৫২ সালে তিনি দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। অত্যন্ত মেধাবী এই শিল্পী স্কুলজীবনেও ছিলেন প্রথম স্থানে। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টস থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তার বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুণ্ডু এবং মা বীণাপাণি কুণ্ডুুর আগ্রহ-মমতায় তার শিল্পের চেতনা বেড়ে ওঠে। নিতুন কুণ্ডু মায়ের অনুপ্রেরণায়, সহযোগিতায় এবং নিজের প্রচেষ্টায় একজন সফল শিল্পী হতে পেরেছিলেন।
১৯৫৯ সালে নিতুন কুণ্ডু তার জীবন শুরু করেছিলেন ডিজাইনার হিসেবে। ১৯৬২ সালে ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিসেস বা ইউসিসে প্রধান ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইউসিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। পরে শিল্পী কামরুল হাসানের সঙ্গে যৌথভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর নানা ধরনের অঙ্কনের কাজ করেন। নিতুন কুণ্ডু মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী হিসেবে ব্যাপক আলোচিত। মূলত ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহের শেষ ছিল না তার। সবসময় পেইন্টিং এবং স্কাল্পচার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। শিল্পী হওয়ার নেশায় ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকতেন। তার আজীবন একজন শিল্পী হয়েই থাকার প্রবল ইচ্ছা ছিল। শিল্পের আকাঙ্ক্ষা হয়তো কখনোই শেষ হবে না। তার শিল্পের সর্বোচ্চ মিনারে অবস্থান করা এই শিল্পী ১৯৯৭ সালে অর্জন করেছিলেন একুশে পদক। তার হাতে গড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান অটবি ত্রিশ বছর অতিবাহিত করেছে। অটবি ছাড়াও নিতুন কুণ্ডু নিজেই একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। শিল্পী নিতুন কুণ্ডু তার সৃষ্টির মধ্যে বেঁচে থাকবেন চিরকাল। তিনি বাংলাদেশের শিল্পে নতুন ধারা তৈরি করেছেন নিঃসন্দেহে। তিনি আমাদের মাঝে সশরীরে নেই। আজ ১৫ সেপ্টেম্বর। তার মহাপ্রয়াণ দিবস। তার আত্মার প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।
রাজু আলীম :কবি, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা
telepress@gmail.com
No comments