শ্রদ্ধাঞ্জলি-বুনোফুলের বন্ধু

আমরা অনেক কিছুই ভুলে যাই। শৈশবের ফেলে আসা গ্রাম, প্রিয় নদী, সবুজ মাঠ, অলস দুপুরে ঘুঘুর ডাক, শিশিরের শব্দ, জোছনাবোনা রাত, হেমন্তের সোনালি মাঠ, শীতের বিষণ্ন বিকেল—আরও কত কী। কিন্তু কেউ কেউ এসব ভোলেন না। তাঁদেরই একজন তিনি, নওয়াজেশ আহমদ।


তিনি এসবের অনেক কিছুই আমাদের জন্য ধরে রেখেছেন ছবির খাতায় কিংবা মনের পাতায়। আমরা হয়তো সেসব দিনের মতো তাঁকেও ভুলে গেছি। কিন্তু তিনি আমাদের ভুলতে চাননি। এসব করতে গিয়ে বাংলার বর্ণিল প্রকৃতির ফ্রেমে তিনিও জীবন্ত হয়ে আছেন। তবুও আমরা ভুলে যাই প্রতিনিয়ত। তাই তো গত বছর তাঁর জন্ম-মৃত্যুর দিন দুটো নিঃশব্দেই পেরিয়ে গেল। এবারও ২৪ নভেম্বর তাঁর মৃত্যুদিবসে কেউ কি তাঁকে স্মরণ করেছিল?
মনে পড়ে নগরের গাছ চেনানোর দল তরুপল্লবের প্রথম অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন রমনা বটমূলে। সেদিন অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন দুই বৃক্ষসখা অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা ও বিপ্রদাশ বড়ুয়া। আগামী ২ ডিসেম্বর তরুপল্লবের দশম অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গাছ দেখা, গাছ চেনা অনুষ্ঠানের চার বছর পূর্তি হবে। সামনের দিনগুলোতে এই অনুষ্ঠানে হয়তো আরও অনেকেই উপস্থিত থাকবেন, কিন্তু তাঁর শূন্যতা থেকেই যাবে।
তাঁর সঙ্গে আমার সখ্য মাত্র দুতিন বছরের। বেশি দিন তাঁর সান্নিধ্য পাইনি। একটি বই উৎসর্গ করেছিলাম তাঁকে। একবার আমরা নরসিংদী গিয়েছিলাম লটকনের বাগান দেখতে। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি নিজেই। তাঁর পরিকল্পনা ছিল একেবারে নিখুঁত। আমরা কখন কোথায় যাব, কী করব সব একেবারে পাকাপাকি করে তবেই বের হলেন। অনিবার্য সঙ্গী ছিল তাঁর প্রিয় ক্যামেরা। লটকন নিয়ে তাঁর বাড়তি উৎসাহের একটা কারণ আছে। এ ফলের পুরুষ এবং স্ত্রী গাছ আলাদা। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন কোন প্রক্রিয়ায় এদের পরাগায়ন হয়। কীভাবে এর ফলন আরও বাড়ানো যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায়। কারণ সতেজ অবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে ফলের খোসার রং না বদলালে ফলটি খুব সহজেই দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা সম্ভব। একটি স্কুলের পাশে গাড়ি রেখে আমরা গ্রামের ছায়ামাখা পথে হাঁটতে থাকি। দুজনের ক্যামেরাই সচল। তাঁর ক্যামেরার চোখ নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের অসংখ্য সুনিপুণ দৃশ্যে।
পারিল গ্রামের সেই ছোট্ট শিশুটি একদা রূপসী বাংলার আমন্ত্রণে বেরিয়ে পড়েন। আর ঘরে ফেরেননি। সৃষ্টির উন্মাদনায় ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কখনো দেশ থেকে দেশান্তরে। একবার ঢাকা বইমেলায় ঘুরতে ঘুরতেই হঠাৎ করে চোখে পড়ে তাঁরওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার্স অব বাংলাদেশ অ্যালবামটি। বইটি দেখে এতই মুগ্ধ হই যে পারলে তখনই কিনি। কিন্তু বাদ সাধল পকেট। পরের দিন বইটি কিনে ফেললাম। বাসায় ফিরে মোহাবিষ্টের মতো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকি। পাতাজুড়ে বিচিত্র রঙের বুনো ফুলের মেলা। ঝকঝকে জীবন্ত ছবি। যেন একটু বাতাসেই দুলে উঠবে। তখন মনে হয়েছিল, আহা! যদি এমন করে ছবি তুলতে পারতাম। তারপর বাংলা একাডেমীতে পেলাম তাঁর মহাবনষ্পতির পদাবলী গ্রন্থটি। কিছুদিন পর ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার্স অব বাংলাদেশ গ্রন্থের বাংলা সংস্করণটিও কিনে ফেলি। আলোকচিত্র অ্যালবাম ছিন্নপত্র ও ধানসিড়ি নদীটির পাশে তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। অ্যালবাম দুটিতে তিনি ক্যামেরার কাব্যকে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের ভাবনায় রূপদান করেছেন।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই সচল থেকেছে তাঁর ক্যামেরা ও কলম। দীর্ঘদিন ধরে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় বনফুল নামে পুষ্পবৃক্ষ নিয়ে চমকপ্রদ গল্পগাথা আমাদের উপহার দিয়েছেন। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের পত্রিকা-সাময়িকীতে অজস্র গবেষণা প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় চা-গবেষণায় কাজ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশেও পরামর্শক ও গবেষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতেও আমৃত্যু সম্পৃক্ত ছিলেন।
যেকোনো গবেষণাকর্মই হিমশৈলীর চূড়ার মতো। যার সিংহভাগই দৃশ্যত চোখের আড়ালে থাকে। নওয়াজেশ আহমদ সারাটি জীবন আমাদের জন্য যে গবেষণা ও আনন্দ দানের কাজে ব্যয় করেছেন তা হিমশৈলীর চূড়ার সঙ্গেই তুলনীয়। পরিতাপের বিষয়, তাঁকে কোনো সম্মান আমরা জানাতে পারিনি, পারিনি কাজের কোনো স্বীকৃতি দিতে। আজ পর্যন্ত তাঁর এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞের কোনো মূল্যায়নই হয়নি। এ দেশে কী অবলীলায় অযোগ্য, মেধাহীন, চাটুকারেরা বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কার হাতিয়ে নেয়? নওয়াজেশ আহমদ সঠিক কাজটিই করেছেন। কখনো মাথা নোয়াননি। প্রকৃত সৃষ্টিশীল মানুষ কখনোই কোনো অন্যায় কাজে মাথা নোয়াতে পারেন না।
মৃত্যুর পরের দিন তাঁর মৃতদেহ রাখা হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। যে ফুল নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিলেন তিনি সেই ফুলে ফুলে ঢেকে গেল তাঁর কফিন। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল আলোকচিত্রীদের শ্রদ্ধা নিবেদন। দেশের খ্যাতিমান আলোকচিত্রীরা শেষ মুহূর্তে সবাই তাঁদের প্রিয় ক্যামেরাটি রাখলেন কফিনের পাশে। শোক ও শ্রদ্ধা জানানোর অকৃত্রিম ও শ্রেষ্ঠতম উপায়। তারপর মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হলো তাঁর প্রিয় গ্রাম পারিল নওয়াধায়। মানুষের জীবন তো বৃত্তের মতোই; যেখান থেকে শুরু সেখানেই শেষ। তিনিও একই বিন্দুতে ফিরে গেলেন দীর্ঘ সময় পর।
২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান না-ফেরার দেশে। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
মোকারম হোসেন
tarupallab@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.