রমজানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কেন হয়? by ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। এই মাসে খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যায়। পর্যাপ্ত সরবরাহের অভাবে কিংবা একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তীব্র আকার ধারণ করে। আসলে দেশে সরবরাহজনিত ব্যবস্থাপনার মান উন্নত না হওয়ায় রমজানে দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি হয়।


রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে প্রতিবছরই সরকার আগে থেকেই বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালায়। কিন্তু যারা সুযোগসন্ধানী, তারা বিভিন্ন অসাধু উপায় অবলম্বন করে। ফলে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা সম্ভব হয় না। এবার চিনি নিয়ে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বয়ং হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যদি বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য কথা বলতে হয় এবং ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হয়, তাহলে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরা কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন? বস্তুত প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছার পাশাপাশি যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদেরও আন্তরিক হতে হয়।
প্রতিবছরই দেখা যায়, রমজান মাস এলে ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য যৌক্তিক কারণে যতটুকু বাড়ার কথা, তার চেয়ে অধিক হারে বাড়ে। এ ক্ষেত্রে কেবল অসাধু ব্যবসায়ীদের কথা বলে লাভ নেই। বিভিন্ন স্তরে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি পণ্য পরিবহন খরচও বেড়ে যায়। চাহিদা হয়তো কিছুটা বাড়ে, কিন্তু আগে থেকেই অনুমান করে পর্যাপ্ত সরবরাহের ব্যবস্থা করলে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা যায়। আমাদের দেশে এ ব্যবস্থা দীর্ঘদিনেও গড়ে ওঠেনি। অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যের দাম বাড়তে পারে, তবে সেখানে যতটুকু বাড়ে রমজান মাসে এ দেশে দ্রব্যের দাম বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের দাম তার কয়েক গুণ বেশি হারে বাড়ে। এ ক্ষেত্রে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন বর্তমানে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। যেখানে ভারতে এক ডলার সমান ৪৪ রুপি, সেখানে আমাদের দেশে বর্তমানে এক ডলার সমান ৭৬.৫০ টাকা। বস্তুত, বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকিংয়ে দক্ষ ডেপুটি গভর্নর অথবা সামষ্টিক অর্থনীতি সম্পর্কিত কোনো ডেপুটি গভর্নর নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল কাজ হচ্ছে মূল্য স্থিতিশীল রাখা। কিন্তু তারা যেভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, তাতে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী সন্তুষ্ট নন বলে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ ব্যাপারে কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা দেখা যায়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ছয় মাসের জন্য যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, তা গতানুগতিক এবং কিভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে, সে সম্পর্কে কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা এতে নেই। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা পালন করে চলেছে। মুদ্রানীতির পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিময় হারে টাকার অবমূল্যায়ন রোধে সতর্ক হলেই চলবে না; কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এর সফল বাস্তবায়ন প্রয়োজন। এখনো ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদের হার ধার্য করে রেখেছে, যাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়।
টিসিবিকে কার্যকর করার কথা বলা হলেও তা সম্ভব হয়নি। এদিকে টিসিবি যতটুকু ফাও পাচ্ছে, তা-ও আবার সঠিকভাবে ব্যয় করছে না। টিসিবির ক্রয়কৃত পণ্যের ক্ষেত্রে বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে ক্রয়, নষ্ট এবং পোকায় খাওয়া পণ্য বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা, সঠিকভাবে গুদামজাত না করে পণ্যকে নষ্ট হতে দেওয়ার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সম্প্রতি প্রকাশিত হলেও অজ্ঞাত কারণে টিসিবির কার্যক্রমের অস্বচ্ছতা এবং অনিয়ম সম্পর্কে কোনো ধরনের তদন্ত হয়নি। বর্তমান সরকার জনদরদি হিসেবে টিসিবির অস্বচ্ছ ও অনিয়মপূর্ণ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
রমজানে যাঁরা রোজা রাখেন, তাঁদের জন্য যে পণ্যগুলো বেশি দরকার (যেমন_ছোলা, চিনি, চাল, দুধ, ভোজ্য তেল, খেজুর, খেসারি, মুড়ি), সেগুলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মাধ্যমে রোজার দুই-তিন মাস আগে এলসি খুলে বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।
বর্তমান সরকার প্রথম থেকেই এফবিসিসিআইকে সঙ্গে নিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস চালিয়ে ছিল। কিন্তু তার পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে যদি বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ করত, তাহলে ভালো হতো। অন্য সময়ে খাদ্যদ্রব্য রোজার মাসের প্রথমদিকে বাড়লেও এবার আগেই বেড়েছে। ফলে, মূল্যস্ফীতির হারও বেড়ে গেছে। চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি উৎপাদনজনিত মূল্যস্ফীতি যুক্ত হয়েছে। মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া সৎ ও সাধারণ মানুষকে নাভিশ্বাসে ফেলেছে। অথচ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সম্মানিত সংসদ সদস্যদের এ ব্যাপারে কাজে লাগানো যেত। এদিকে প্রতিটি বাজারে একটি করে বাজার তদারকি কমিটি এবং সাইনবোর্ড থাকা দরকার ছিল। সেই সাইনবোর্ডে উল্লেখ করা থাকবে_কোন পণ্য কত দরে ক্রয় করা হচ্ছে এবং কত দরে বিক্রয় হচ্ছে। কোনো দোকানি যদি ওই পণ্যের উলি্লখিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করে, তবে সঙ্গে সঙ্গে বাজার কমিটির ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় বের করা দরকার ছিল। আবার রমজানে যেসব খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি পায় এবং অত্যন্ত প্রয়োজন, সেগুলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাকাবের শাখাগুলো দ্বারা বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। এদিকে ঢাকা শহরে বিডিআর শপ, পরে যা নির্মল উদ্যোগ নামে চেইন গ্রুপের আওতায় প্রায় ১৫টি শাখায় পণ্য বিক্রি করত, হঠাৎ করে সেগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের অবস্থা আরো দুঃসহ করে তোলা হয়েছে।
এবার খাদ্যদ্রব্যের কথা বাদ দিয়ে রমজানে অন্যান্য দ্রব্য ক্রয়ের কথায় আসি। এক মাস রোজার পরই আসে খুশির ঈদ। সেই ঈদকে উপলক্ষ করে যেভাবে সাজসজ্জার জন্য মানুষরা ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে ক্রেতাদের উচিত আরেকটু সংযমী হওয়া। কেননা, পোশাক-পরিচ্ছদ কিনতে গিয়ে পোশাক-আশাক, গয়নাগাটি এবং জুতাসহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম রীতিমতো অধিক হারে বেড়ে যায়। এই সময়ে যদি সামান্য কৃচ্ছ্রতা ক্রেতাসাধারণ গ্রহণ করত, তবে এত দাম বাড়ত না। বিদেশে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। ক্রিসমাসের সময়ে রিডাকশন দেওয়া হয়। আমাদের দেশে রিডাকশন দেওয়া হলেও দেখা যায়, এক হাজার টাকার পণ্যের দাম বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হয়। তারপর সেখানে ১০-২৫ শতাংশ রিডাকশন লেখা হয়। ক্রেতাসাধারণ বুঝে না বুঝে ঠকে। প্রতিবাদ করলে বরং বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অবশ্য দেশের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তের দুশ্চিন্তা নেই, তাঁদের অনেকেই কেনাকাটার জন্য মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ উন্নত দেশে যান। আবার অনেকেই সেখানেই ঈদ উদ্যাপন করেন। লোভ এবং অতিরিক্ত অর্থ আমাদের নৈতিকতাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করছে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে, এ দেশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা একটি গ্যারেজ কিনে নামে-বেনামে দুই-তিনটি গাড়ির মালিক হচ্ছেন। ফলে এখন চলছে গ্যারেজ দখল। ধানমণ্ডি ৪ নম্বর রোডে গ্রিন রিপোজে সমিতিকে ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ কার্যক্রমে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, দলমতের ঊধর্ে্ব উঠে অনৈতিক কার্যক্রমে একে অন্যকে সহায়তা করতে। এ জন্যই একটু সংযমী হওয়া প্রয়োজন।
খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্য সব ক্রয়ের ক্ষেত্রে আমাদের সংযমী হওয়া উচিত। আবার যাঁরা অন্যের সম্পত্তি বিভিন্ন ধান্ধায় দখল করেন, তারাও কিন্তু অন্যায়কারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। অবৈধ কার্যক্রম সব সময়ই অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। রমজানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধকল্পে সরকারের পাশাপাশি উৎপাদনকারী, বিক্রেতাদেরও একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকা দরকার। অন্যদিকে ক্রেতাসাধারণকেও কৃচ্ছ্রতা সাধনে সচেতন হতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ও অর্থনীতি বিভাগ, অতীশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, সেন্টার ফর ব্র্যাক থ্রো থিংকিং ইং বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.