ঢাকা সিটি করপোরেশন-ভাগ নয়, সংস্কার জরুরি by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

অবশেষে জনমত উপেক্ষা করে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করার জন্য সরকারি দল সংসদে বিল উত্থাপন করতে যাচ্ছে। এ উদ্যোগের এত সমালোচনা হয়েছে, তবু সরকার পিছপা হয়নি। এতে সরকার লাভবান হবে, না ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা সময়ই শুধু বলতে পারে। আমার ধারণা, সরকার দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


ঢাকা সিটি করপোরেশন নানা দুর্বলতায় কণ্টকিত। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা, গবেষণা, জনমত ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঢাকা সিটি করপোরেশনের আমূল সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার এই গঠনমূলক পথে না গিয়ে স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ডিসিসি দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমরা সংসদ নির্বাচন বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে যত হই-হট্টগোল করি তার দশ ভাগও করি না এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা সম্পর্কে। মনে হয় নির্বাচন ও নির্বাচনে জেতাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জিত হলেই আমাদের সব উৎসাহ শেষ।
পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে (হয়তো দ্বিতীয় কোনো দেশই নেই) যে দেশে প্রধান বিরোধী দল সংসদীয় কার্যক্রম বছরের পর বছর বয়কট করে থাকে। অর্থাৎ একটা দেশে সংসদ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বিরোধী দলের বিতর্ক বা সমালোচনা ছাড়াই। বাংলাদেশে যে বছরের পর বছর এমনটি হচ্ছে এ নিয়ে জনগণের খুব একটা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। যাঁরা বিরোধী দলের এমপিদের ভোট দিয়ে জয়ী করেছেন, এ ব্যাপারে তাঁদেরও কোনো সম্মিলিত বা আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ বা বক্তব্য পাওয়া যায় না। সরকারি দল, মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধি শুধু এ ব্যাপারে সমালোচনামুখর। লাখ লাখ ভোটার এ ব্যাপারে নির্বিকার। তাদের সহায়তা দেওয়ার জন্য কোনো আইনও নেই।
আমাদের সিটি করপোরেশনগুলো স্থানীয় সরকারের কয়েকটি বড় স্তম্ভ। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সময় আমরা এই স্তম্ভ নিয়ে খুব সোচ্চার হয়ে উঠি। কিন্তু সিটি করপোরেশনের নির্বাচন পদ্ধতি, মেয়রের দায়িত্ব ও ক্ষমতা, কাউন্সিলরদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা, বাজেট, আয়ের উৎস, ব্যয়ের খাত, সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা প্রণয়ন বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া, স্থানীয় অধিবাসীদের (এবং ভোটার) সঙ্গে মেয়র ও কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগের উপায়, কাউন্সিলরদের এলাকাভিত্তিক অফিস প্রদান, সিটি করপোরেশনের কাজের সীমারেখা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট (এনআইএলজি) বা অন্য কোনো বেসরকারি সংস্থা, দাতা সংস্থা কেউ এসব আলোচনায় আগ্রহী নয়। উন্নয়ন সহযোগীদের টাকায় স্থানীয় সরকারগুলোতে নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। এখানে অনেক টাকার ব্যবহার হয়। মন্ত্রণালয় বা অন্য অনেকেই এসব প্রকল্প সম্পর্কেই শুধু আগ্রহী। এসব প্রকল্পের সঙ্গে বহু ‘বিদেশ সফরের’ কর্মসূচিও যুক্ত থাকে। সচিব থেকে শুরু করে প্রায় সবাই এসব প্রকল্প নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।
স্থানীয় সরকারসংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকেও মূল সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে দেখা যায় না। সরকারি-বেসরকারি প্রায় সবাই স্থানীয় সরকার সম্পর্কে স্ট্যাটাসকোতে আগ্রহী। ‘যেমন আছে তেমন থাকুক’—এই নীতিই আদৃত হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
এই নিবন্ধে শুধু সিটি করপোরেশন প্রসঙ্গে দু-একটি কথা বলব।
আমাদের সরকারব্যবস্থা সংসদীয় পদ্ধতির। অর্থাৎ জনগণ প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন না। জনগণ এমপি নির্বাচন করেন। এমপিরা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। এমপিরা চাইলে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বদলাতেও পারেন। সংসদীয় পদ্ধতির এটা একটা বড় শক্তি। কাজেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেই তিনি যা খুশি তা করতে পারেন না। (বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্রের কারণে পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। এখানে প্রধানমন্ত্রী অনেকটা একনায়ক।) দলীয় এমপিরা একজোট হলে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি পদে পরিবর্তন আনতে পারেন। বিএনপির ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে দলীয় এমপিরাই রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অশোভনভাবে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
কেন্দ্রীয় সরকারে সংসদীয় পদ্ধতি অথচ সিটি করপোরেশনে চলছে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি! এটা কেন হবে? হচ্ছে, কারণ বেশির ভাগ নেতাই স্ট্যাটাসকোতে বিশ্বাসী। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন আনার সাহস কোনো ক্ষমতাসীন দল দেখাতে পারছে না। দলপ্রধানকে নানা স্বার্থান্ধ লোক নানা ভয় দেখাচ্ছে। ‘কিছু পরিবর্তন হলে যদি দলের ক্ষতি হয়’—এ রকম মনোভাবও দুই নেত্রীকে অনেক সময় আড়ষ্ট করে রাখে। ‘যা আছে তাই থাকুক, এতে লাভ না হলেও ক্ষতি তো হচ্ছে না’—হয়তো এ রকম মনোভাব দুই নেত্রীর। তাই সিটি করপোরেশনের ক্ষমতাকাঠামো বা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হচ্ছে না।
শুধু দুই বড় দল বা দুই নেত্রীকে দোষ দেব কেন? ছোট দল, দলের নেতা, মিডিয়া বা নাগরিক সমাজ কোনো মহলই কি ধারাবাহিকভাবে এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছে? জনমত সৃষ্টি করেছে? বর্তমান কাঠামো বা ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নিয়ে জোরালো সমালোচনা করেছে? করেনি। ব্যতিক্রম খুবই কম।
ঢাকার পাশেই কলকাতা সিটি করপোরেশন। তাদের নির্বাচন পদ্ধতি, সিটি সংসদ, কাউন্সিলরদের দায়িত্ব, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ পদ্ধতি ইত্যাদি স্টাডি করলে আমরা আমাদের নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করতে পারব। কলকাতা একটি প্রাচীন নগর। সেখানকার পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে।
বাংলাদেশে সিটি করপোরেশনে সরাসরি মেয়র নির্বাচন প্রথা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। এই পদ্ধতিতে একজনের জন্য নির্বাচনটা হয়ে পড়ে ব্যয়বহুল ও পরিশ্রমসাপেক্ষ। ক্ষেত্রবিশেষে ‘মেয়র’ একক ক্ষমতাবলে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে পাঁচ বছর কেউ চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই। তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতি না ঘটলে (খোদা না করুক), শত অন্যায়েও তাকে এই পদ থেকে সরানোর কোনো সুযোগ নেই। কী ক্ষমতাধর পদ! প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর! প্রধানমন্ত্রী বদলানো যায়, মেয়র বদলানো যায় না!
অথচ নির্বাচিত কাউন্সিলররা মেয়র নির্বাচন করলে এই সমস্যা থাকত না। যে দলের কাউন্সিলর বেশি নির্বাচত হবেন সেই দলেরই মেয়র ও ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত হবেন। মেয়র বা ডেপুটি মেয়র দক্ষতার পরিচয় দিতে না পারলে অনাস্থা ভোট দিয়ে নতুন মেয়র নির্বাচন করার সুযোগ থাকে।
আমাদের সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলরদের মনোনয়ন, নির্বাচন, দায়িত্ব, ক্ষমতা, দলীয় ভিত্তিতে মনোনয়ন ইত্যাদি কোনো বিষয় নিয়েই তেমন আলোচনা হয় না। ভোটারদের এক বিরাট অংশ কাউন্সিলরদের চেনেন বলেও মনে হয় না। এ এক অদ্ভুত ব্যবস্থা। কারও কাছে কাউন্সিলরদের জবাবদিহিও করতে হয় না। তাঁরা কী কাজ করেন, কী কাজ করার কথা, এসব নিয়ে মিডিয়ায়ও তেমন আলোচনা নেই। মিডিয়া শুধু নির্বাচনী খবর ও মাঝে মাঝে দুর্নীতির খবর প্রকাশ বা প্রচার করেই দায়িত্ব সম্পাদন করে। অন্য কোনো ব্যাপারে মিডিয়ার আগ্রহ কমই দেখা যায়।
বর্তমান মন্ত্রিসভা ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুভাগে ভাগ করার মতো একটি ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানি না শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে কি না। ঢাকা সিটি করপোরেশন নিয়ে অনেক কিছু ভাববার আছে। কিন্তু মন্ত্রিসভা এমন একটি বিষয়ই ভেবেছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সিটি করপোরেশনকে আরও পঙ্গু করে ফেলবে। আরও নানা সমস্যার মধ্যে সিটি করপোরেশন নিক্ষিপ্ত হবে। একটা লেজেগোবরে অবস্থার মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশন পড়তে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যথাসময়ে না হওয়াতে বর্তমান সরকার নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। আমাদের রাজনীতি বা সরকার যে প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্রের নয়, এতে তারও প্রমাণ মেলে। নেতাদের মনোভাব: ‘আমরাই শুধু নির্বাচিত হব আর কেউ নির্বাচিত হতে পারবে না। যতটা পারো নির্বাচন ঠেকাও।’ (ডাকসু ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কুড়ি বছর কোনো নির্বাচন হয় না।) কারণ দূষিত রাজনীতির নেতারা জানেন, নির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতাবান হন। তাঁরা অন্য কাউকে ক্ষমতা দিতে চান না। ৩০০ জন এমপিই শুধু ক্ষমতা ভোগ করতে চান।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন না হওয়াতে আমরা এর একটা ইতিবাচক দিক দেখি। তা হলো নির্বাচনের আগে সিটি করপোরেশনকে সংসদীয় গণতন্ত্রায়ন করা। সংসদীয় গণতন্ত্রের আলোকে ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ কাঠামো অনুসরণে ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাঠামো, নিজস্ব সংসদ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, কাউন্সিলরদের ভূমিকা পুনর্বিন্যাস, আয়ের উৎস, ব্যয়ের খাত, অন্যান্য সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা ও আইন পরিমার্জনা করার একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। নির্বাচন হয়ে গেলে অন্তত পাঁচ বছরের জন্য সেই সুযোগ আর পাওয়া যেত না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই এই কাজে হাত দিলে সবচেয়ে ভালো হতো। না করার চেয়ে অবশ্য বিলম্বে করাও ভালো।
ঢাকা সিটি করপোরেশনকে সংসদীয় গণতন্ত্রায়ন করা সম্ভব হলে অন্যান্য সিটি করপোরেশনে তার প্রয়োগ সহজ হবে। একবার প্র্যাকটিস শুরু হলে তার নানা দুর্বলতা চিহ্নিত করা যাবে। তখন অন্য সিটি করপোরেশনে তা সংশোধন করে প্রয়োগ করা সহজ হবে। কোনো আইন ধর্মীয় বিধান নয়, তাই পরিবর্তনশীল।
সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকা সিটি করপোরেশনকে নতুন করে বিন্যাস করার কাজে মনোযোগ দিলে ভালো হয়। এটা একটা বড় কাজ। বর্তমান সরকার কাজটি সাফল্যের সঙ্গে করতে পারলে ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.