কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
সমস্যা ছিল, সমস্যা আছে। ভবিষ্যতেও থাকুক সেটা কামনা করি না। প্রত্যাশা করি ভবিষ্যতে সমস্যার পরিমাণ কমে যাক। যদিও তার আলামত তেমন দেখছি না। তবে আমাদের মতো দেশে সমস্যা জাদুমন্ত্র বলে হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে না, যেতে পারে না, সেটাও বুঝি। কিন্তু বর্তমান সময়ের কিছু ঘটনায় যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে তা চিন্তায় ফেলে।
ভাবি, এগুলোর পেছনে বড় বিপর্যয়ের কোনো আশঙ্কা নেই তো! সমস্যাগুলো ফেউ হয়ে বাঘের আগাম বার্তা বয়ে আনছে না তো! বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সমস্যা আগেও ছিল। এখনো আছে। টেলিভিশন, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন দেখব কি নিজেই যখন ভুক্তভোগী। প্রধানমন্ত্রী বললেন, রোজার মাসে মানুষ যেন ভোগান্তির শিকার না হয়, কষ্ট না পায়। ফলাফল উল্টো। প্রাক্তন সচিব এবং বর্তমানে মন্ত্রী পদের উপদেষ্টা রোজার মাসে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে যা বললেন, তার সঙ্গে বাস্তবের কোনোই মিল নেই। লুকোবারই কী প্রয়োজন। যা পারা যাবে, যেটুকু পারা সম্ভব সেই কথাটি সবাইকে জানিয়ে দিলেই তো ভালো। তাতে অন্তত মানসিক প্রস্তুতি থাকে। সমস্যা মোকাবিলায় মানুষ তবে নিজের মতো ব্যবস্থা নিতে পারে। মাঝে বিদ্যুৎ সমস্যা মোটামুটি সহনীয় হয়ে এসেছিল। কিন্তু রোজা শুরু হতে না হতেই যে বিপর্যয় এবং তার ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি ও বিরক্তি সৃষ্টির পেছনে কোনো কুউদ্যোগ নেই তো! রোজার শুরু থেকে বিদ্যুৎ বিপর্যয় এবং তার প্রতিবাদে বিভিন্ন অঞ্চলে দলবদ্ধ মানুষের রাস্তায় নামা ও বিদ্যুৎ অফিস ভাঙচুর কিছু প্রশ্ন তৈরি করে বৈকি! এরপর বলি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের তেলেসমাতির কথা। অনেক আগে থেকেই গণমাধ্যমে চিনি-তেল-ছোলা-পেঁয়াজ ইত্যাদি নিয়ে কথা হচ্ছিল। কাজের কাজ কিছুই করা যায়নি। বাজার চলে গেছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। সরকার সেখানে অসহায় দর্শক মাত্র। এক মন্ত্রী বলেন বাজারে না যেতে, এক মন্ত্রী বলেন কম খেতে। দেখেশুনে স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগে বারবার সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। মুনাফার জন্য একটি গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়া বিশ্বাসযোগ্য নয়। তৃতীয় বিশ্বে এ ধরনের সংকটের সঙ্গে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের একটা যোগ থাকে। স্থিতিশীল রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই বাজারে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করার দৃষ্টান্ত নতুন তো নয়। এই অবস্থায় মন্ত্রী অথবা দায়িত্বসম্পন্নদের বক্তব্যে উদাসীনতার আভাস পাওয়া গেলে দুশ্চিন্তা না করে পারা যায় না। কাদেরের ব্যাপারে কিছু পুলিশের নৃশংসতা রীতিমতো উদ্বেগজনক। তাদের এই শক্তি ও ঔদ্ধত্য সাহসের উৎস কোথায়! ভেতরের, নাকি বাইরের! যদি ভেতরের হয় তবে তাকে অচিরেই নির্মূল করতে হবে। আর যদি বাইরের হয় তাকে খুঁজে বের করে বিষদাঁত ভেঙে দিতে হবে। তবে হাইকোর্টের বিচারপতির ব্যবস্থা নেওয়ার পর সর্বমহলেই আলোচনা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে। গণমাধ্যমের খবরাখবর দেখার পরও তারা এত উদাসীন থাকতে পারল কী করে? মাত্র ক'দিন আগেই আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে মারার ঘটনা আমরা বেমালুম ভুলে গেছি ভাবলে ভুল হবে। উলি্লখিত বিষয়গুলো পুঁজি করে আগামী নির্বাচনে বিরোধীরা যে আওয়ামী লীগ এবং মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। অতি সম্প্রতি আদালতের অভ্যন্তরে সরকারবিরোধী আইনজীবীরা যে অশোভন আচরণ করলেন, আদালতের পবিত্রতা এবং গাম্ভীর্য নষ্ট করলেন তা কি সভ্য ও শিক্ষিত সমাজের কারো পক্ষে করা উচিত। যাঁরা করেছেন তাঁরা তো আদালতের সম্ভ্রম রক্ষা করার অঙ্গীকার নিয়েই পেশাগত কাজ করার অনুমতি লাভ করেছেন। সেই অনুমতির ভেতর নিয়মনীতি-শিষ্টাচার সভ্যতা ইত্যাদি পালনের অঙ্গীকার ছিল। রাষ্ট্র, বিচারালয়, সংবিধান ইত্যাদির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন বলেই না তাঁরা আইনজীবী হওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছেন। পড়াশোনা করে সার্টিফিকেটও লাভ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। তবু বিশেষ এক দুরভিসন্ধিমার্কা রাজনীতির ভূত তাঁদের যে সারাক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করে সেই ভূতটি কঠোরভাবে নির্মূল করা দরকার। দেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত অবাঙালি উপজাতিদের নিয়ে শুরু হয়েছে আরেক উদ্দেশ্যমূলক খেলা। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী সরকার যে ভূমিকা নিয়েছে, তার বিরোধিতা করছেন দোলায়িতচিত্ত কিছু বুদ্ধিজীবী। তাঁদের পেছনে আছে কিছু বিদেশি সংস্থার অর্থ এবং অন্যান্য আনুকূল্য। সম্প্রতি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট এবং দৃঢ়ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে যাদের নিয়ে কিছু বিদেশি সংস্থা, স্থানীয় এনজিও এবং দেশের কিছু বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ এত হৈচৈ করছেন, তাঁদের কিন্তু অত মাথাব্যথা নেই। আদিবাসী হলেন কি হলেন না, তা নিয়ে তাঁরা অত ভাবেন বলেও মনে হয় না। ওইসব সরল সোজা, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ জনপদের শ্রদ্ধেয় মানুষও চান শান্তি ও স্বস্তিময় জীবন। ভালোমন্দ খেয়েপড়ে, আপন সাংস্কৃতিক পরিচয় নিয়ে সুস্থভাবে থাকতে পারলেই তারা খুশি। স্বার্থান্বেষী মহল এই স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিকতা চায় না। তাই পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয় অশান্তি এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। পরিবর্তে সরকার এবং রাষ্ট্রের অবস্থানের পক্ষে পর্যাপ্ত ও যথোপযুক্ত প্রচার নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতেই হবে। নইলে সব অর্জন শুধু প্রচারের অভাবে মাঠে মারা যাবে। এটি কেবল দেশান্তরের জন্য নয়, বহির্বিশ্বেও প্রকৃত সত্য তুলে ধরাটা জরুরি হয়ে উঠেছে। নইলে অতি সম্প্রতি লন্ডনের 'দি ইকোনমিস্ট' যে অসত্য প্রচার করেছে, সে রকম তীর বিভিন্ন দিক থেকে আরো হয়তো আসতে থাকবে আমাদের দিকে। ইকোনমিস্ট যে অসত্য কথা লিখেছে তার পেছনে, ধরে নিতে দ্বিধা নেই যে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও ষড়যন্ত্র আছে। এ ধরনের প্রোপাগান্ডায় বিশ্বজুড়ে অঢেল অর্থ বিনিয়োগের ভাবনাও হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি সৃষ্টির জন্য আমাদের সমন্বিত উদ্যোগের অভাবের কথা বহুবার বহুভাবে লিখেছি। আবারও বলি, সত্য কথনের পক্ষে বহির্বিশ্বে আমাদের প্রচারের ব্যবস্থাটিকে সবল করা দরকার।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
« পূর্ববর্তী সংবাদ
No comments