নির্বাচনী সহিংসতা : ইউনিয়ন পরিষদ by এ এম এম শওকত আলী

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্তত দুইবার সহিংস ঘটনা ঘটে। এর মাত্রা সাধারণত জাতীয় বা উপজেলা নির্বাচনের তুলনায় অধিকতর। কেন এ ধরনের অত্যধিক মাত্রার সহিংসতা স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তরে হয়, তা নিয়ে কোনো গবেষণা প্রকাশিত হয় না। তবে মিডিয়াই এ ক্ষেত্রে সব সময় সর্বাধিক তথ্য প্রদান করে থাকে।


একটি ইংরেজি দৈনিকে ৯ জুন প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, নড়াইল, নেত্রকোনা ও দিনাজপুর জেলায় একই দিনে এবং একই রাতে অন্তত ৬৫ জন নির্বাচনী সহিংসতায় আহত হয়েছেন। গাইবান্ধায় তাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি নির্বাচনোত্তর সহিংস সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। এর ফলে হাজার হাজার ব্যক্তি তাজুলের লাশ নিয়ে জেলা সদরে এসে এই হত্যার বিচার দাবি করেছেন। স্থানীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে নিহত তাজুলের আত্মীয়স্বজন দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
নড়াইল জেলায় পরাজিত চেয়ারম্যানপ্রার্থীর সমর্থকরা নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের আক্রমণ করলে পুলিশের লাঠিচার্জে অন্তত ৩৫ জন আহত হন। নির্বাচনী কর্মকর্তারা রাত ৮টায় ব্যালট বাঙ্ নিয়ে উপজেলা সদরে যাওয়ার সময় এই আক্রমণের ঘটনা ঘটে। উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ ফাঁকা গুলিও বর্ষণ করে। নেত্রকোনার ঘটনায় দুইজন পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকরা পরস্পরকে আক্রমণ করেন। দুজন পরাজিত চেয়ারম্যানপ্রার্থীর পরস্পরকে আক্রমণ করার বিশদ ব্যাখ্যা প্রকাশিত প্রতিবেদনে ছিল না। তবে ধারণা করা যায়, দুজন প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় ভোট বিভক্ত হয়। এর সুফল ভোগ করেন জয়ী প্রার্থী। নির্বাচনের আগে এ ধরনের বিভক্তি এড়ানোর জন্য এক প্রার্থী অন্য প্রার্থীকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের অনুরোধও করতে পারেন।
এই অনুরোধে সাড়া না দেওয়ায় পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ফলে নির্বাচনোত্তরকালে সহিংস ঘটনা ঘটে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অন্যান্য কারণও থাকতে পারে। যেমন_ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি প্রার্থীদের আনুগত্য। কারণ বর্তমান নির্বাচনের আগে উপজেলা নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল নিজ নিজ দলীয় প্রার্থী মনোনীত করার ঘোষণা দিয়েছিল। এই দুই দলের মধ্যে সুসম্পর্ক অতীতেও ছিল না, এখনো নেই। বরং পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতির মাত্রা বর্তমানে চরমে পেঁৗছেছে।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলার ঘটনাটি ভিন্নতর। এ ক্ষেত্রে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকরা দুটি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণায় বিলম্বের কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে অন্তত তিনটি যানবাহন ভাঙচুর করেন। এর মধ্যে কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটেরও একটি জিপগাড়ি ছিল। এ ঘটনা প্রতিরোধের লক্ষ্যে পুলিশ লাঠিচার্জসহ ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। এর ফলে অন্তত ৩০ জন আহত হন। এ ঘটনার ব্যাপারে সুখবর হলো, পুলিশ ঘটনাস্থলে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁদের ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন।
লালমনিরহাটের ঘটনাটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য জয়ী চেয়ারম্যানপ্রার্থীর সমর্থকরা স্থানীয় একজন সাংবাদিককে আহত করেছেন। ওই সাংবাদিকের নাম মাসুদ রানা রাশেদ। তাঁর অপরাধ, তিনি নির্বাচনের আগে সম্ভাব্য জয়ী চেয়ারম্যানের পক্ষে প্রচারণা করতে রাজি হননি। অন্তত ছয়জন তাঁকে আক্রমণ করেন। তাঁদের মধ্যে একজন চেয়ারম্যানপ্রার্থীর ভাতিজা ছিলেন। প্রকাশিত সংবাদে এ বিষয়ে মাসুদের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আক্রমণকারীরা সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমর্থক। তাঁরা মাসুদের পরিবারকে কোনো মামলা না করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। জয়ী চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে বক্তব্য দিয়েছেন। রাশেদের বাবাকেও ওই ব্যক্তি আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেছেন, স্থানীয় থানায় শিগগিরই তিনি মামলা করবেন।
ফরিদপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে কয়েকটি নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সংবাদটি ২০ জুনের একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত। এ সংবাদে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও নির্বাচনী কোড লঙ্ঘনের দায়ে একজন জয়ী চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তারসহ ছয়জনকে জরিমানা করা হয়েছে। ঘটনাটি ফরিদপুর ও গাইবান্ধা জেলা-সংক্রান্ত। জরিমানার পরিমাণ সর্বমোট ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। কুড়িগ্রাম জেলায় নির্বাচনী সংঘর্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ২০ জন আহত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ঘটনার কারণ ভিন্ন। ভোট গণনার সময় একটি কেন্দ্রে একজন সদস্য প্রার্থীর সমর্থকরা হামলা চালান। জামালপুরের ঘটনায় অন্তত ছয়জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনার সঙ্গে অন্যান্য ঘটনার মিল অতটা নেই। এক পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকরা প্রিসাইডিং অফিসারকে ভোট পুনর্গণনার অনুরোধ জানালে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে সংশ্লিষ্ট সমর্থকরা ব্যালট বাঙ্ ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালান। এ ক্ষেত্রেও পুলিশ লাঠিচার্জসহ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ ঘটনায় ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করার কোনো তথ্য নেই। গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলে ভালো হতো। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘটনা ভিন্নতর। এ ক্ষেত্রে বোমাবাজি করা হয়েছে। এর ফলে দুই শিশুসহ চারজন আহত হয়েছে। এ ঘটনার জন্য দায়ী কারা, তা জানা যায়নি। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভীতি সৃষ্টির জন্যই বোমা ব্যবহার করা হয়েছে।
মানিকগঞ্জের একটি ঘটনা ১৭ জুন একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশ করা হয়। এ ঘটনার মূল তথ্য হলো_জয়ী চেয়ারম্যানের সমর্থকরা পরাজিত চেয়ারম্যানপ্রার্থীর বাড়িতে হামলা চালান। প্রায় ৭০ জন সমর্থকের হামলায় একটি জিপ, দুটি মোটরসাইকেল ও ঘরের আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরাজিত প্রার্থীর পরিবারের সদস্যদেরও আক্রমণ চালিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাটুরিয়া থানায় মামলা করা সত্ত্বেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। মাদারীপুর, চাঁদপুর ও রাজবাড়ী জেলায় নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত তিনজন নিহত হন। এর আগে বর্ণিত গাইবান্ধার ঘটনা যোগ করলে নিহতের সংখ্যা হবে চার। রাজশাহী এবং পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে সহিংস ঘটনার বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে। মাদারীপুরের যে ব্যক্তি নিহত হয়েছেন, স্থানীয় সূত্রমতে, এর জন্য কয়েকজন অচেনা ঘাতকই দায়ী। চাঁদপুরের ঘটনায় পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হন। এক ব্যক্তি ব্যালট বাঙ্ ছিনতাইকালে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে তিনি নিহত হন। ঘটনাটি ঘটে মতলব (দক্ষিণ) উপজেলায়। এখানেও দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হন। ঘটনাটি ছিল ব্যালট বাঙ্ ছিনতাই-সংক্রান্ত।
মুন্সীগঞ্জ জেলায় নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে ১৭ জন আহত হয়েছেন। সংবাদ ১৯ জুনের। এ ঘটনায় দুই পক্ষই মারাত্মক অস্ত্রসহ গুলি ব্যবহার করে। এতে দুই ব্যক্তি বুলেটবিদ্ধ হন। পুলিশ সংঘর্ষের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে কুমিল্লা জেলায় ১৩টি ইউনিয়নের নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যদিকে ঝিনাইদহ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় নির্বাচনী সহিংসতায় একজন নিহত এবং ৩৬ জন আহত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকরা কিছু ভোটার যেন ভোটকেন্দ্রে যেতে না পারে, সেই চেষ্টা করে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকরা এতে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়। দুই পক্ষই অস্ত্র ব্যবহার করে। এতে ২৬ জন আহত হন। কিশোরগঞ্জের সহিংস ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যসহ ১২ জন আহত হন। পুলিশের মতে, এক অপরাধী চক্র ভোট গ্রহণের সময় ৬০০ ব্যালট পেপার, সিল এবং অন্যান্য সামগ্রী ছিনতাই করে। এ সময় সংঘর্ষের ফলে ৯ ব্যক্তি আহত হন। এ ক্ষেত্রে পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য একটি কেন্দ্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। অপরাধী চক্র ব্যালট পেপার এবং অন্যান্য সামগ্রী ছিনতাইকালে কর্তব্যরত পুলিশ বাধা দিলে একজন সাব-ইন্সপেক্টরসহ দুই পুলিশ সদস্য আহত হন।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন-সংক্রান্ত ঘটনা পর্যালোচনা করলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সংঘটিত অপরাধের সংখ্যা ও মাত্রা অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় অধিকতর। এ সম্পর্কে এর আগে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও কোনো দিকনির্দেশনামূলক গবেষণা হয়নি। ইচ্ছুক গবেষকরা এ বিষয়ে চিন্তা করতে পারেন।
সহিংস ঘটনার আধিক্যের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা সম্ভব_১. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অন্যান্য নির্বাচনের তুলনায় প্রতিযোগিতা তীব্রতর। ২. ভোটারদের সংখ্যা অধিকতর। ৩. প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকদের উৎসাহ-উদ্দীপনাও অধিকতর। ৪. অপেক্ষাকৃত স্বল্প ভৌগোলিক পরিসরে নির্বাচন হওয়ায় প্রার্থীসহ সমর্থকরা একে অপরের পরিচিত, যা উপজেলা চেয়ারম্যান বা সংসদ সদস্য নির্বাচনে দৃশ্যমান নয়। ৫. পরিষদের চেয়ারম্যান বা সদস্যপদ লাভ করলে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ ঘটে। এর ফলে গ্রামে এসব নির্বাচিত ব্যক্তিকে সবাই সম্মান না করলেও তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন। ৬. গ্রামপর্যায়ে দলাদলি অত্যধিক। ফলে প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। কে জিতবে, সেটাই হয় মুখ্য; অন্য কিছু নয়। পর্যালোচনায় একটি ধারা ছিল_জয়ী প্রার্থীও প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করেছেন। তাঁদের কয়জন চার্চিলের উক্তি জানেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বলেছিলেন, জয়ী হলে বদান্যতা প্রদর্শন করো (ওহ ারপঃড়ৎু সধমহধহরসরঃু)। তাঁদের দোষারোপ করে লাভ নেই। কারণ জাতীয় পর্যায়েও বদান্যতার তীব্র অভাব। অর্থাৎ, একই আচরণ। এ পর্যায়ের নেতারা দল সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ী হয়ে বদান্যতার আচরণ শেখাবেন কিভাবে। তবে কিছু ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে জয়ী হয়েও জাতীয় কোনো দল সমর্থকদের বিজয়মিছিল করতে বলেছিল। ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে জয়ী হয়ে উল্লাসমুখর মিছিলের পরিবর্তে সরাসরি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা হয়। দিন বদলের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দল কি পারবে এই আচরণ বদলাতে?

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.