দিল্লির চিঠি-পৃথক তেলেঙ্গানা রাজ্য কেন? by কুলদীপ নায়ার
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য অন্ধ প্রদেশ থেকে তেলেঙ্গানাকে পৃথক করে নতুন রাজ্য গঠনের দাবি অনেকটা পাঞ্জাবি সুবা দাবির মতো। প্রায় তিন দশকজুড়ে কয়েক দফা আন্দোলন ও সত্যাগ্রহ চালানোর পর পাঞ্জাবি সুবার দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল।
পাঞ্জাবি সুবার বিরুদ্ধে যে যুক্তি দেখানো হতো তা হলো, তৎকালীন অখণ্ড পাঞ্জাবের জনগণ ছিল একটা তাঁতের টানা ও পোড়েনের মতো অনেকটা, তারা নদীর পানিসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদ একসঙ্গেই ভাগাভাগি করে ভোগ করছে। যদি বিভক্তি ঘটে, তাহলে পাঞ্জাবের অধিবাসীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাঞ্জাবি সুবা শেষমেশ বাস্তবায়িত হয়েছিল। যদিও মাত্র ১৩টি জেলা নিয়ে এই প্রদেশ গঠিত হয়েছিল।
পৃথক রাজ্যের দাবিতে তেলেঙ্গানায় কোনো আন্দোলন-বিক্ষোভ হলে আমার মন চলে যায় পাঞ্জাব সুবার আন্দোলনের দিকে। যাঁরা এই দাবির বিরোধিতা করছিলেন, তাঁরাও ছিলেন পাঞ্জাবি। তেলেঙ্গানাকে অন্তত তেমন কোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে না। যাঁরা অন্ধ্র প্রদেশ ভাঙতে চাইছেন কিংবা এর বিরোধিতা করছেন, তাঁরা সব তেলেগুভাষী।
পাঞ্জাবি সুবার দাবি শেষ পর্যন্ত শিখ ও হিন্দুদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছিল। তেলেঙ্গানা তেলেগুর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তেলেগুকে। পাঞ্জাবি সুবার সমর্থনে তখন প্রায় সব শিখ অবস্থান নিয়েছিল আর প্রায় সব হিন্দু এর বিরোধিতা করেছিল। এই পক্ষপাতকে এড়ানোর চেষ্টা করেনি কোনো পক্ষ, তাই এই দাবি ধর্মীয় রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তবু এই দাবি অর্থব্যঞ্জক ছিল। কারণ, ১৯৫৬ সালে ভারতজুড়েই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন করা হয়েছিল। আর পাঞ্জাব দ্বিভাষিক রয়ে গিয়েছিল।
তবে তেলেঙ্গানার দাবি ভাষার ওপর ভিত্তি করে নয়। যাঁরা এককালে নিজামের হায়দরাবাদের পুরোনো অঞ্চলে বাস করতেন, যাঁদের মাতৃভাষা ছিল উর্দু—তাঁদের মিলিত থেকে আবেগ-অনুভূতি উদ্ভূত এই দাবি। তাঁদের খাদ্যাভ্যাস ও সাংস্কৃতিক শিকড় অন্যদের থেকে ভিন্ন, অনেক বেশি ইসলাম-ঘনিষ্ঠ। এমন কোনো রাষ্ট্র গঠনে সমস্যার কিছু নেই। শুধু একটাই সমস্যা, তা হলো: রাজ্য গঠনের জন্য দরকারি ইট-কাঠ তো শুধু আবেগ থেকে আসে না। তেলেঙ্গানা ও বাকি অন্ধ্র প্রদেশের মানুষের চোখ এখন হায়দরাবাদের ওপর নিবদ্ধ।
তেলেঙ্গানা থেকে নিয়ে গিয়ে সেকান্দাবাদ ও হায়দরাবাদ নগর দুটির সম্মিলন ঘটিয়ে একক অঞ্চল গঠন করলেই তো এই দাবি ধার হারায়। তবে তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনকারীদের দাবির ভিত্তিমূলে আছে বৈষম্যের শিকার হওয়া নিয়ে ক্ষোভ। জনগণের কাছে এই অনুভব আবেদনময়ী। আমি তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখেছি। কিন্তু সংযুক্ত অন্ধ্র প্রদেশে তেলেঙ্গানা কীভাবে বৈষম্যের শিকার, তা বুঝতে পারিনি।
১৯৫৬ সালের তুলনায় এখন প্রতি ১০০ জনে স্কুলগামী শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে ১৫ জন। অথচ উপকূলবর্তী অন্ধ্রে এই হার বেড়েছে মাত্র তিনজন। অনুরূপভাবে ২০০১ সালের হিসাবে প্রতি ১০ হাজার জনে তেলেঙ্গানায় কলেজে যাওয়া শিক্ষার্থী বেড়েছে ৫৪ জন, অথচ উপকূলীয় অন্ধ্রে তা বেড়েছে ৩৯ জন।
মোট আবাদি জমির পরিমাণ তেলেঙ্গানা অঞ্চলে আনুপাতিক হারে বেড়েছে সর্বাধিক। রাজ্য গঠনের পর তেলেঙ্গানা অঞ্চলে ১৫ লাখ হেক্টর আবাদি জমি বেড়েছে; ওদিকে উপকূলীয় অন্ধ্রে বেড়েছে ১০ লাখ হেক্টর। মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকেও তেলেঙ্গানা অঞ্চলের অবস্থান উপকূলীয় অন্ধ্রের নিচে, তবে রয়ালাসীমার থেকে এগিয়ে। অন্ধ্রের মাঝে মিশে যাওয়ার সময় তেলেঙ্গানা ছিল অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ। তবে অন্ধ্র প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়েও এখানে উন্নতির হার ভালো।
চার দশক পেছনে ফেলে এসে আমরা পাঞ্জাবিরা আজ বুঝতে পারছি, রাজ্যকে বিভক্ত করা ছিল ভুল। আমরা তখন বুঝতে পারিনি যে নিজেদের পঙ্গু বোধ করব; আর আমাদের যতটুকু সম্ভাবনা, সে অনুযায়ী বেড়ে ওঠার জায়গাটুকু পাব না। এমনকি যাঁরা ধর্মের ভিত্তিতে পাঞ্জাবি সুবার দাবি তুলেছিলেন, তাঁদেরও এখন মোহভঙ্গ ঘটেছে। কেননা, এখন শিখ ও অ-শিখ জনসংখ্যা প্রায় সমান।
সংরক্ষিত এলাকা ছাড়া যুক্তরাজ্য-ব্যবস্থায় যেকোনো জায়গায় যেকোনো ভারতীয় নাগরিক বসতি স্থাপন করতে পারে। ভারতের সংবিধান তাতে কোনো বাধা দেয় না। পাঞ্জাবের সমস্যা হয়তো আগামী দিনে আরও বাড়বে। এত বিস্তারিত প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ হলো, তেলেঙ্গানার জনগণ যাতে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে। আর তারা যাতে বুঝতে পারে যে দীর্ঘ মেয়াদে ভাষাভিত্তিক ঐক্য আছে, এমন বৃহৎ রাজ্য বরং অধিকতর ভালো। সমস্যা আসলে দৃঢ় নেতৃত্বের। রাজনৈতিক দলগুলোর এক পা তেলেঙ্গানায়, আরেক পা সংযুক্ত অন্ধ্র প্রদেশে। স্পষ্ট কথা বলার কেউ নেই।
ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের বাতাস কীভাবে বইছে? দলটি ভড়কে গেল যখন চিকিৎসকেরা বললেন, অনশনরত কে চন্দ্রশেখর রাও মারা যেতে পারেন। তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের ঘোষণা করল সরকার মাঝরাতে। পরে সরকার বুঝতে পারল, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যথাযথ অনুসন্ধান না করেই। পৃথক রাজ্য গঠনের ঘোষণা দেওয়ার আগে শ্রীকৃষ্ণ কমিশনকে নিযুক্ত করা উচিত ছিল। আমার কাছে পরিষ্কার যে তেলেঙ্গানা রাজ্য হোক বা না হোক, কেন্দ্রীয় সরকার ও কংগ্রেসকে শিগগির এ বিষয়ে পস্তাতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
পৃথক রাজ্যের দাবিতে তেলেঙ্গানায় কোনো আন্দোলন-বিক্ষোভ হলে আমার মন চলে যায় পাঞ্জাব সুবার আন্দোলনের দিকে। যাঁরা এই দাবির বিরোধিতা করছিলেন, তাঁরাও ছিলেন পাঞ্জাবি। তেলেঙ্গানাকে অন্তত তেমন কোনো সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে না। যাঁরা অন্ধ্র প্রদেশ ভাঙতে চাইছেন কিংবা এর বিরোধিতা করছেন, তাঁরা সব তেলেগুভাষী।
পাঞ্জাবি সুবার দাবি শেষ পর্যন্ত শিখ ও হিন্দুদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছিল। তেলেঙ্গানা তেলেগুর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তেলেগুকে। পাঞ্জাবি সুবার সমর্থনে তখন প্রায় সব শিখ অবস্থান নিয়েছিল আর প্রায় সব হিন্দু এর বিরোধিতা করেছিল। এই পক্ষপাতকে এড়ানোর চেষ্টা করেনি কোনো পক্ষ, তাই এই দাবি ধর্মীয় রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তবু এই দাবি অর্থব্যঞ্জক ছিল। কারণ, ১৯৫৬ সালে ভারতজুড়েই ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন করা হয়েছিল। আর পাঞ্জাব দ্বিভাষিক রয়ে গিয়েছিল।
তবে তেলেঙ্গানার দাবি ভাষার ওপর ভিত্তি করে নয়। যাঁরা এককালে নিজামের হায়দরাবাদের পুরোনো অঞ্চলে বাস করতেন, যাঁদের মাতৃভাষা ছিল উর্দু—তাঁদের মিলিত থেকে আবেগ-অনুভূতি উদ্ভূত এই দাবি। তাঁদের খাদ্যাভ্যাস ও সাংস্কৃতিক শিকড় অন্যদের থেকে ভিন্ন, অনেক বেশি ইসলাম-ঘনিষ্ঠ। এমন কোনো রাষ্ট্র গঠনে সমস্যার কিছু নেই। শুধু একটাই সমস্যা, তা হলো: রাজ্য গঠনের জন্য দরকারি ইট-কাঠ তো শুধু আবেগ থেকে আসে না। তেলেঙ্গানা ও বাকি অন্ধ্র প্রদেশের মানুষের চোখ এখন হায়দরাবাদের ওপর নিবদ্ধ।
তেলেঙ্গানা থেকে নিয়ে গিয়ে সেকান্দাবাদ ও হায়দরাবাদ নগর দুটির সম্মিলন ঘটিয়ে একক অঞ্চল গঠন করলেই তো এই দাবি ধার হারায়। তবে তেলেঙ্গানা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনকারীদের দাবির ভিত্তিমূলে আছে বৈষম্যের শিকার হওয়া নিয়ে ক্ষোভ। জনগণের কাছে এই অনুভব আবেদনময়ী। আমি তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে দেখেছি। কিন্তু সংযুক্ত অন্ধ্র প্রদেশে তেলেঙ্গানা কীভাবে বৈষম্যের শিকার, তা বুঝতে পারিনি।
১৯৫৬ সালের তুলনায় এখন প্রতি ১০০ জনে স্কুলগামী শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে ১৫ জন। অথচ উপকূলবর্তী অন্ধ্রে এই হার বেড়েছে মাত্র তিনজন। অনুরূপভাবে ২০০১ সালের হিসাবে প্রতি ১০ হাজার জনে তেলেঙ্গানায় কলেজে যাওয়া শিক্ষার্থী বেড়েছে ৫৪ জন, অথচ উপকূলীয় অন্ধ্রে তা বেড়েছে ৩৯ জন।
মোট আবাদি জমির পরিমাণ তেলেঙ্গানা অঞ্চলে আনুপাতিক হারে বেড়েছে সর্বাধিক। রাজ্য গঠনের পর তেলেঙ্গানা অঞ্চলে ১৫ লাখ হেক্টর আবাদি জমি বেড়েছে; ওদিকে উপকূলীয় অন্ধ্রে বেড়েছে ১০ লাখ হেক্টর। মাথাপিছু জিডিপির দিক থেকেও তেলেঙ্গানা অঞ্চলের অবস্থান উপকূলীয় অন্ধ্রের নিচে, তবে রয়ালাসীমার থেকে এগিয়ে। অন্ধ্রের মাঝে মিশে যাওয়ার সময় তেলেঙ্গানা ছিল অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ। তবে অন্ধ্র প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়েও এখানে উন্নতির হার ভালো।
চার দশক পেছনে ফেলে এসে আমরা পাঞ্জাবিরা আজ বুঝতে পারছি, রাজ্যকে বিভক্ত করা ছিল ভুল। আমরা তখন বুঝতে পারিনি যে নিজেদের পঙ্গু বোধ করব; আর আমাদের যতটুকু সম্ভাবনা, সে অনুযায়ী বেড়ে ওঠার জায়গাটুকু পাব না। এমনকি যাঁরা ধর্মের ভিত্তিতে পাঞ্জাবি সুবার দাবি তুলেছিলেন, তাঁদেরও এখন মোহভঙ্গ ঘটেছে। কেননা, এখন শিখ ও অ-শিখ জনসংখ্যা প্রায় সমান।
সংরক্ষিত এলাকা ছাড়া যুক্তরাজ্য-ব্যবস্থায় যেকোনো জায়গায় যেকোনো ভারতীয় নাগরিক বসতি স্থাপন করতে পারে। ভারতের সংবিধান তাতে কোনো বাধা দেয় না। পাঞ্জাবের সমস্যা হয়তো আগামী দিনে আরও বাড়বে। এত বিস্তারিত প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ হলো, তেলেঙ্গানার জনগণ যাতে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারে। আর তারা যাতে বুঝতে পারে যে দীর্ঘ মেয়াদে ভাষাভিত্তিক ঐক্য আছে, এমন বৃহৎ রাজ্য বরং অধিকতর ভালো। সমস্যা আসলে দৃঢ় নেতৃত্বের। রাজনৈতিক দলগুলোর এক পা তেলেঙ্গানায়, আরেক পা সংযুক্ত অন্ধ্র প্রদেশে। স্পষ্ট কথা বলার কেউ নেই।
ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের বাতাস কীভাবে বইছে? দলটি ভড়কে গেল যখন চিকিৎসকেরা বললেন, অনশনরত কে চন্দ্রশেখর রাও মারা যেতে পারেন। তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের ঘোষণা করল সরকার মাঝরাতে। পরে সরকার বুঝতে পারল, এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যথাযথ অনুসন্ধান না করেই। পৃথক রাজ্য গঠনের ঘোষণা দেওয়ার আগে শ্রীকৃষ্ণ কমিশনকে নিযুক্ত করা উচিত ছিল। আমার কাছে পরিষ্কার যে তেলেঙ্গানা রাজ্য হোক বা না হোক, কেন্দ্রীয় সরকার ও কংগ্রেসকে শিগগির এ বিষয়ে পস্তাতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।
No comments