স্মরণ-সমর দাস—অম্লান স্মৃতি by রেহানা আশিকুর রহমান

২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর, সমর দাস চলে গেছেন। তাঁর স্মৃতি আজও সমুজ্জ্বল। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি স্মৃতি-ভারাক্রান্ত। ষাটের দশকে শাহনাজ, সাবিনা, শাহিন সামাদ, সাবিহা মাহবুবসহ আমি ও শিশুশিল্পী হিসেবে আরও অনেকে যখন বেতারের ছোটদের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘খেলাঘর’-এ গান করতাম, সমর দাস তখনই কিংবদন্তি। দূর থেকে তাঁর কথা শুনেছি, দেখেছি, সমীহ করেছি, শ্রদ্ধায় ও বিস্ময়ে আপ্লুত হয়েছি।


সমর দাস চলে গেছেন। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি এখনো মর্মে মর্মে বাজে। কালের ডামাডোলে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তের দাগ মুছে গেছে, কিন্তু আজও তাঁর স্বাধীনতার গান আমাদের স্মৃতিতে সমুজ্জ্বল ও জাজ্বল্যমান। এখনো রক্তে নাড়া দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান প্রাণপুরুষ।
সমর দাসের অমর কীর্তি সুরারোপ
‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে,
রক্ত লাল, রক্ত লাল।’
আমাদের চেতনার সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। আমাদের গর্বের অর্জন জাতীয় সংগীতেরও অর্কেস্ট্রেশন তাঁর হাতে হয়েছিল। তাঁর আরও অনেক দেশাত্মবোধক ও আধুনিক গানের সুর, কনসার্ট আমরা ভুলতে পারব না—তা ক্ষণে ক্ষণে আমাদের স্মৃতিতে ভেসে আসে, মনের দ্যোতনায় অনুরণিত হয়। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙর তোল তোল’, ‘ওরা আমাদের সবুজ ধানের শীষে, চিরদিন আছে মিশে’, ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা’ ইত্যাদি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গীত গানের সুর এবং অন্যান্য সুরারোপিত আধুনিক গান, যেমন—‘তন্দ্রাহারা নয়ন আমার’ (হাসিনা মমতাজ), ‘পুরোনো আমাকে খুঁজে’ (শাহনাজ রহমতউল্লাহ), ‘লাজুক লাজুক চোখ মেলে ওই’ (ফেরদৌসী রহমান), ‘কাঁকন কার বাজে রুমঝুম’ (বশির আহমেদ), ‘কত যে ধীরে বহে মেঘনা’সহ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) বহু গান আমাদের এক অনির্বচনীয় সুর-সৌকর্যের জগতে নিয়ে যায়।
আমরা জানি, আমাদের দেশে শিল্পীদের মধ্যে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সাংগঠনিক কুশলতার বড় অভাব। আমাদের শিল্পীরা বড় বেশি অবহেলিত এবং বঞ্চনার শিকার আর তাঁরা সব থেকে বেশি অসংগঠিত এবং নিজ সম্ভাবনা, অসহায়তা অথচ অপরিহার্যতা সম্বন্ধে উদাসীন। এই বিশেষ বোধ ও উপলব্ধি থেকে আমরা অনুভব করেছিলাম, শিল্পীদের জন্য একটি জাতীয় সংগঠন গড়ে তোলা দরকার এবং এভাবেই ১৯৯০ সালে সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ সংগীত পরিষদ। জন্মলগ্ন থেকে আমৃত্যু সমর দাস এ সংগঠনের সভাপতি ছিলেন।
বাংলাদেশ সংগীত পরিষদ গঠনকালে, সব শিল্পীর—কণ্ঠশিল্পীই হোক, যন্ত্রশিল্পীই হোক অথবা সংগীত পরিচালক, গীতিকার ও নৃত্যশিল্পীই হোক—এক মঞ্চে একত্র করার প্রচেষ্টায় সমর দাসসহ আমরা সবাই বহু দেনদরবারে, আলাপ-আলোচনায়, তর্ক-বিতর্কে ও সমঝোতায় উপনীত হতে একত্রে চিন্তাভাবনা করেছি, অনেক সময় কাটিয়েছি। সংগঠনকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় আমরা সবাই অনলস পরিশ্রম ও যোগাযোগের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি মহলের সহযোগিতার ব্যবস্থা করি। বাংলাদেশ সংগীত পরিষদ শিল্পীদের জন্য একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সর্বত্রের ও সব কলার শিল্পীদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও আনুকূল্যে এটা সম্ভব হয়েছে। সংগঠনের জন্য পরিণত বয়সেও সমর দাসের সহযোগিতা, প্রেরণা, পরিশ্রম ও ভূমিকা ছিল অসাধারণ।
তিনি সফল সুরকার ছিলেন। তাঁর সংগীতসাধনার বিকাশ ষাটের দশক-পূর্ব যুগে। তখন থেকেই দেখি প্রযুক্তির অভাব সত্ত্বেও তিনি নিজ সৃজনশীলতা ও স্বকীয়তায় সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করেছেন। গান, বাণী, সুর, লয়, শিল্পী ও অর্কেস্ট্রা মিলিয়ে তিনি সৃষ্টি করতেন অনুপম সুরলহরি ও সংগীত। তাঁর সুরারোপিত গান গাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে। গানগুলো আমি গেয়েছি তুষ্টি ও সতর্কতার সঙ্গে। তিনি ছিলেন পূর্ণমাত্রায় শুদ্ধতা অর্জনে বিশ্বাসী। অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে তিনি গানগুলোর সুর তুলতেন, যন্ত্রবাদনের সঙ্গে সাযুজ্য আনতেন এবং কঠোরতার সঙ্গে শিল্পীর কাছ থেকে কাজ আদায় করতেন। ‘এই চোখ তোমারই জন্য’ শিরোনামে আমার আধুনিক গানের অ্যালবামের মধ্যে তাঁর সুরে গাওয়া গানটি ‘খোলা আকাশের নিচে আমি, দাঁড়িয়ে আছি একাকী’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রথম ছায়াছবি মুখ ও মুখোশ-এর তিনি ছিলেন সংগীত পরিচালক। মাটির পাহাড়, আসিয়া, ধীরে বহে মেঘনাসহ আরও অনেক ছবির তিনি ছিলেন সফল সংগীত পরিচালক ও সুরকার। তাঁর সম্পাদনা ও পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের গানের সমাহারে বের হয়েছিল বাংলাদেশের হূদয় হতে, একটি ফুলকে বাঁচাব বলে শিরোনামে লং প্লে রেকর্ড। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্রসহ ভারতের অনেক প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী এবং বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের গান নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো গ্রন্থিত হয়েছিল। আজও ওই গানগুলো স্বাধীনতার চেতনাকে বহন করছে উজ্জ্বল বহ্নিধারায়।
তিনি নিজে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র অত্যন্ত হূদয়গ্রাহী ও নিখুঁতভাবে বাজাতে পারতেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইলেকট্রিক হাওয়াইয়ান গিটার, পিয়ানো ও পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ান।
সমর দাস তাঁর কর্মবহুল জীবনে দেশে-বিদেশে বহু সম্মান পেয়েছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন ‘মানুষের জন্য মানুষ’। ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের সময়, ১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় দেখেছি তাঁর নেতৃত্বে আমাদের সংগীত পরিষদের উত্তরণ।
সমর দাস চলে গেছেন পরিণত বয়সেই। তবু তাঁর মৃত্যু স্বীকার করতে কষ্ট হয়। এক উজ্জ্বল, হূদয়গ্রাহী ও সৃজনশীল অস্তিত্ব চলে গেছে। এই শূন্যতা পূরণ করা কষ্টকর।
রেহানা আশিকুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.