বইপত্র-স্মৃতির শরণে জীবন্ত যে জন by আখতার হুসেন
জিয়া হায়দার স্মারকগ্রন্থ—সম্পাদনা: রশীদ হায়দার \ প্রকাশক: অনন্যা \ প্রকাশকাল: জুলাই ২০১১ \ প্রচ্ছদ: খালিদ আহসান \ মূল্য: ৬০০ টাকা নিভৃতচারী হলেও মানুষটির খোঁজখবর না জেনে থাকতে পারা যায়নি। সুযোগ পাওয়া যায়নি তাঁর সম্পর্কে একেবারে নিস্পৃহ থাকারও। এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকে আরও বেশি করে জানার সুযোগ আমরা পেলাম।
আর সেটা তাঁর স্মারকগ্রন্থের সুবাদে। এই গ্রন্থই আমাদের জানতে সাহায্য করছে তাঁর জীবনের আরও বহু অজানা দিকের খুঁটিনাটি সম্পর্কে। আমাদের কাব্যসাহিত্য, বিশেষত আধুনিক নাট্যজগতের বিশিষ্টতম মানুষ জিয়া হায়দার ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রামে যাওয়ার পর বাহ্যিকভাবে একেবারেই নেপথ্যচারী হয়ে গিয়েছিলেন বলে মনে হয়েছিল। অথচ আমরা এই গ্রন্থের কল্যাণেই জানতে পারি, তাঁর সেই নেপথ্যচারিতা আসলে তাঁর শূন্যে সওয়ার হওয়া ছিল না। ছিল নতুন কর্মযজ্ঞের সূচনাবিন্দু। গুণী কিংবা প্রতিভাবান মানুষের চরিত্রের প্রকৃতিটাই এমন যে, যেখানেই তিনি যাননা কেন, আলো ছড়ানোর কাজ তিনি করবেনই। ওটা যেন তাঁর মজ্জাগত, আপন দেহের রক্তমাংসে মেশানো তাঁর সুকৃতিরই ফল্গুধারা। ফলে আমরা দেখি, আমরা জানতে পারি, দেশের তো বটেই, সাহিত্য-সংস্কৃতিরও রাজধানী ঢাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে যাবার পরও তিনি আরও অভিযানী হচ্ছেন, নিজের কাঁধে মিশনারিসুলভ দায়িত্বের বোঝা তুলে নিচ্ছেন এবং তারই অংশ হিসেবে তাঁরই একান্ত প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চালু করা হচ্ছে দেশের প্রথম নাট্যকলা বিভাগ। কবিতার পরেই সাহিত্যশিল্পের যে বিভাগটি তাঁর সাধনার মুখ্য কেন্দ্র ছিল, সেই নাট্যকলার চর্চার প্রসারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাঁর মতো করে আর কে অতটা সক্রিয় ছিলেন! এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা, ধ্রুবার্থেই, অদ্বিতীয়। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শুধু ছিলেন না, ছিলেন ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টস (বিটা), চট্টগ্রাম’-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ‘ইউনিভার্সিটি থিয়েটারে’র পরিচালক হিসেবেও তাঁর নাট্যিক জীবন ছিল বহুবর্ণিল। কত মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে যে তিনি জড়িত ছিলেন! ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের মেধাবী ছাত্রের জন্য বৃত্তি, দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটিতে নিজের নামে এবং অন্যটিতে প্রয়াত মা-বাবার স্মরণে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করে গেছেন তিনি। দান করে গেছেন উল্লিখিত দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগে তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের প্রচুর মূল্যবান বই। তাঁর শিক্ষার্থীজীবনের সুকৃতি তাকে নিয়ে যেতে পারত বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তের বিশ্বমানের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতার পেশায়, কিন্তু স্বদেশের মাটিকেই তিনি আঁকড়ে পড়ে থাকেন আমৃত্যু। আপন কর্মের স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা প্রাপ্তির ভেতর দিয়ে। কত যে তাঁর পরিচয়—কবি, নাট্যকার, অনুবাদক, নাট্য বিভাগের শিক্ষক, পরিচালক-প্রযোজক, সর্বোপরি নাট্য-তাত্ত্বিক। জিয়া হায়দার যেমন স্মরিত হবেন তাঁর কাব্যকৃতির জন্য, সমভাবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর নাট্যভাবনা ও তত্ত্ব সম্পৃক্ত কিছু গ্রন্থের জন্যও। এ সবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত ‘থিয়েটারের কথা’, ‘স্তানিস্লাভস্কি ও তার অভিনয় তত্ত্ব’, ‘নাট্যকলায় ইজম ও এপিক থিয়েটার’ এবং ‘বিশ্বনাট্য সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ ইত্যাদি। সংযোজিত তাঁর গ্রন্থতালিকা যেমন ঋদ্ধ করেছে এই স্মারককে, তেমনি তাঁর কিছু আলোকচিত্রও জীবন্ত করে তুলেছে মানুষটিকে।
কতভাবে কতজনের সঙ্গে তিনি যে সম্পর্কিত ছিলেন, রক্তসম্বন্ধের আত্মীয়স্বজনের বাইরেও, তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত এই স্মারক গ্রন্থভুক্ত তাঁদের প্রত্যেকের রচনার ভেতর দিয়ে তারই সমূল সমাচার উঠে এসেছে। তাঁকে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের লেখাগুলো এতটাই আন্তরিক যে, সেসবের পাঠে মাঝেমধ্যেই আবেগে থরো থরো হয়ে ওঠার যোগাড় হয়। পারিবারিক পরিমণ্ডলের খোলামেলা মানুষটিকে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পরিবারের সর্বজ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে গিয়ে তাঁর জীবনগত খেসারত দেওয়ার কথাও আমরা যখন জানতে পারি, তখন আপনাআপনি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে মাথা। ঘরে-বাইরে মানুষটি সমান দায়িত্ববান ছিলেন। অনুজ রশীদ হায়দার আমাদের সে কথাই জানান এভাবে, ‘এমন ভাগ্য-বিড়ম্বিত মানুষ কমই দেখেছি। যে-বাড়িতে তাঁর জন্ম, সে-বাড়িতে যতোটা বিত্ত ছিল ততোটা বিদ্যা ছিলো না, কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন সব ভাইবোনকে শিক্ষিত করতে; করেওছিলেন। কিন্তু নিজের জীবন যে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল তা তিনি বুঝতে দেননি কাউকে, যখন বোঝা গেল, তখন তাঁর জীবন-সূর্য পশ্চিমে অনেক হেলে পড়েছে। সেই অস্তমিত পর্যায়ে ক্যান্সার আগমনী বার্তায় জানালো: আয়ু সীমিত।’
এই স্মারকগ্রন্থ শুধু স্মরণের ডালা নয়, শুধুই ব্যক্তি জিয়া হায়দারের স্মরণিকা নয়, আমাদের এক দীর্ঘ কালপর্বের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসেরও একটা উজ্জ্বল আধারবিশেষ। অভিনন্দন রশীদ হায়দারকে অতীব যত্নে অগ্রজের স্মরণে এই স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করার জন্য।
No comments