জীবনের সাইকেল-নাগরিক দায় by মামুনুর রশীদ

এরনেন্তো চে গুয়েভারাকে হত্যার আগে বলিভিয়ান সামরিক কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কোন দেশের নাগরিক?’ দ্বিধাহীন চিত্তে চে গুয়েভারা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি আর্জেন্টিনার, কিউবার, মেক্সিকোর, এল সালভাদরের, ইকুয়েডরের, আমি এশিয়া, আফ্রিকার সব দেশের নাগরিক এবং সব দেশের প্রতি আমার নাগরিক দায় সমান।’


এই নাগরিক দায়িত্ব পালনের মধ্যে তিনি প্রাণও দিলেন। শুধু চে গুয়েভারা নন, আমাদের দেশেও অনেক বিপ্লবী এই নাগরিক দায় পালন করতে গিয়ে অকাতরে প্রাণ দিয়েছেন।
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশে দেশে নাগরিক দায় পালনের চেহারাটাও বদলে গেছে। তবে নৈরাশ্যজনক হচ্ছে, আধুনিক বিশ্বে যখন জবাবদিহি বাড়ছে মিডিয়ার কারণে, তখন স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডও বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত। ইরাক, লিবিয়া, মিসর, আফগানিস্তানের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে নাগরিক সুবিধার জন্য সরকারগুলো প্রাণপণ প্রচেষ্টায় রত। কিন্তু অন্য দেশগুলোর প্রতি তাদের লুণ্ঠনের হাত ক্রমাগতভাবে বেড়ে চলেছে। কোনো দেশই তাদের নিজস্ব সম্পদ রক্ষা করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে সেই সেই দেশের নাগরিকদের দায়টা কেমন? আমাদের দেশে একটা বড় ধরনের উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তেল-গ্যাস ও জাতীয় সম্পদ রক্ষা কমিটি। ফুলবাড়ীতে যেখানে একটা বড় ঘটনা ঘটেছে, সেখানে নাগরিক দায় পালন করতে গিয়ে দায়িত্ববান এসব নাগরিক নির্যাতিতও হয়েছেন। কিন্তু যেসব নাগরিক রাষ্ট্রক্ষমতার চারপাশে আছেন, তাঁরা এই আন্দোলনের বিরোধিতা করছেন। বিপুলসংখ্যক নাগরিকের সমাবেশও ঘটেনি। মাঝখান থেকে আমলা ও বিশেষজ্ঞরা এর মধ্যে বিভ্রান্তির চেষ্টা করছেন। এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে কার লাভ হচ্ছে?
আজকে রাজধানীতে যখন প্রবল যানজটের সৃষ্টি হয়, তখন ওই আমলা, বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদটিও কিন্তু বাদ পড়েন না। নিজে নিরাপদ থাকার জন্য ট্রাফিক আইনটি ভেঙে ফেলেন; কিন্তু তা তো সাময়িক। ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লেই সাধারণ নাগরিকের মতোই তাঁদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, নিজের ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠানো হলো; কিন্তু দেশে তার কর্মসংস্থান হলো না, বিদেশেও হলো না। তখনই বা কী হচ্ছে? ক্ষমতার ছিটেফোঁটা হাতে পেলেই এ দেশের আমলা-রাজনীতিক নাগরিকত্ব ভুলে যান, দায় শোধ করার কোনো প্রয়োজনই মনে করেন না।
সব সময়ই সরকার দেশকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় আর বিরোধী দল সর্বকালেই সরকার পতনের আন্দোলন করে থাকে। বিরোধী দলের আন্দোলনে মানুষের বেঁচে থাকার বিষয়টি একেবারে উহ্য থেকে যায়। হরতাল আসে দলীয় স্বার্থে। দ্রব্যমূল্য রোধে, সড়ক নিরাপদের জন্য, যানজট নিরসনে, পথঘাট বাড়ানোর দাবিতে কখনো হরতাল হয় না। দেশে ট্রাফিক আইন কার্যকর করার প্রশ্নে, তারেক মাসুদ, মিশুকদের মতো অসংখ্য সম্ভাবনাময় প্রাণের বাঁচার প্রশ্নে কোনো সম্মিলিত উদ্যোগ নেই। শহীদ মিনারের পাদদেশে কিছু উদ্বিগ্ন নাগরিকের আহাজারির মধ্য দিয়েই তা চাপা পড়ে যায়। ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার অংশীদারদেরও যে একই পরিণতি হতে পারে, এর অনেক উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও নাগরিক দায়টি পালন করতে তারা বড়ই উদাসীন।
জনগণও ভোট দিয়েই তার নাগরিক দায়িত্ব শেষ করে ফেলে। জনপ্রতিনিধিদের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থটিকেই বড় করে দেখতে থাকে। রাজধানীর যানজট নিরসনের জন্য অনেক ঘরবাড়ি ভাঙার প্রয়োজন হবে। সে সময়ই নাগরিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে দেখা গেল নিজের কয়েক ফুট জায়গা রক্ষার জন্য প্রাণপণ তদবির শুরু হয়ে যায়। পথ প্রশস্ত হলে যে নিজেরই সুবিধা হবে, প্রাত্যহিক যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, তাও বেমালুম ভুলে যায় ওই নাগরিকেরা। শুরু হয় দুর্নীতি, টাকার লেনদেন। তাতে কাজও হয়। আজকে যে পথে তারেক-মীশুকের সমাধি হলো, তাও এক রাজনৈতিক দুর্নীতির ফল। কোনো এক রাজনীতিবিদের ভোটের সাফল্যের জন্য আঁকাবাঁকা পথটি নির্মিত হয়েছিল। ঢাকা-আরিচার দূরত্বও তাতে বেড়েছে অনেক। সোজা পথটি বাঁকা না করে অনেক সোজা হতে পারত। পথ প্রশস্ত না হলে মানুষের হূদয়, কল্পনাশক্তি বাড়ে না। এই রাজধানী শহরটিকে নিয়েও কত রাজনৈতিক দুর্নীতি হয়েছে। শহরের কোনো স্থাপত্য নেই। শহরটাকে চেনার কোনো পথ নেই। জনবহুল এই দেশে ঢাকার মতো আরও পাঁচটি বড় শহর হতে পারত। সেখানেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত কক্সবাজার, কুয়াকাটা অথবা চট্টগ্রামের সাগর-সৈকত থেকে কক্সবাজার হয়ে দেশের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমিকে ব্যবহার করা যেত। শহরগুলোতে, আবাসভূমিতে, কৃষিজমিতে অপরিকল্পিতভাবে ঢুকে পড়ছে শিল্প-কলকারখানা। তাতে মানুষের জীবন হয়ে পড়ছে বিপন্ন। সাম্প্রতিককালে মরণব্যাধি ক্যানসারের কারণ এগুলোই।
উন্নত দেশগুলো নিজেদের রক্ষা করছে, অরক্ষিত করছে সারা পৃথিবী। ভয়াবহ এই পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের রক্ষা করব কীভাবে? একমাত্র আমরা সবাই যদি নাগরিক দায়িত্বটাকেই বড় করে দেখি!
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।

No comments

Powered by Blogger.