সময়চিত্র-হরতাল সমস্যা নয়, সমাধানও নয় by আসিফ নজরুল
আমাদের একটি সম্মেলন ছিল কাঠমান্ডুতে। দক্ষিণ এশিয়ায় বেসরকারি পর্যায়ে সম্মেলনের জন্য কাঠমান্ডু এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়। কাঠমান্ডু এয়ারপোর্টে নেমেই ভিসা পাওয়া যায়, দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো, দ্রব্যমূল্য বা যানজট পরিস্থিতি অন্য যেকোনো দক্ষিণ এশিয়ার দেশের চেয়ে সহনীয়।
কাঠমান্ডুতেই তাই সাউথ এশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটসের উদ্যোগে ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হলো সন্ত্রাসবাদ ও মানবাধিকারবিষয়ক সম্মেলনটি।
সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। বিশেষ করে ভারতের কিছু কিছু অঞ্চল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতন, গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, বিশেষ বাহিনীগুলোর দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার বিবরণ ছিল খুবই উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশেও সন্ত্রাসবাদবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে সন্ত্রাস দমনের বিভিন্ন বিধান রয়েছে। এর পরও বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে সন্ত্রাসবাদ দমনের একটি কঠোর আইন করেছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নামে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন আইনের সংশোধন করে নাগরিকদের টেলিফোন, ই-মেইলসহ সব গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের বিধান করেছে। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার পরও প্রতিবেশী অধিকাংশ রাষ্ট্রের তুলনায় বেশি খারাপ নয়। কাঠমান্ডু সম্মেলনে তাই তুলনামূলকভাবে কম সমালোচনা হয় আমাদের দেশের। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে শাহ্দীন মালিক, শাহনাজ হুদা ও আমার সময় কাটে অন্য দেশের পরিস্থিতির প্রতি বেশি উদ্বেগ নিয়ে।
আমাদের সমস্যা হয় অন্য ক্ষেত্রে। গ্যাংটক, কাঠমান্ডু বা কলম্বো যেখানেই যাই, দক্ষিণ এশিয়ার বন্ধুরা জানতে চায়, কী অবস্থা চলছে বাংলাদেশে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের মতো জাতিগত বিরোধ নেই বাংলাদেশে, বর্ণবাদ বা ধর্মীয় সন্ত্রাসও নেই এখানে। ১৬ কোটি মানুষের প্রায় সবার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সামাজিক আচরণ একই রকম এখানে। তার পরও এত রাজনৈতিক অস্থিরতা কেন বাংলাদেশে?
এর উত্তর আমরা সবাই জানি। তবু বিদেশি কারও কাছে দেশের বদনাম করতে কষ্ট হয় আমার। কিছু বিষয় তাই চেপে রাখি, কিছু বিষয় হালকা করে বলি, অথবা সমস্যাটি মূলত ‘প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি সৃষ্টির ব্যর্থতা’—এ ধরনের তাত্ত্বিক কথা বলি। আর হতাশ হয়ে ভাবি, এই প্রশ্ন কত দিন শুনব আমরা?
একসময় দেশে ফেরার সময় হয়। আগে ঢাকার বিমানবন্দর ছাড়ার সময় একবার কাঁদতাম, আরেকবার ফেরার সময়। প্রথম কান্না কষ্টের, দ্বিতীয়টা আনন্দের—কিন্তু দুটোই দেশকে ভালোবাসার। এমন ভালোবাসা নিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মানুষ। নিউজার্সি, বোলজানো, ইস্তাম্বুল, দুবাই—সবখানে দেখেছি, বাংলাদেশের মানুষের হূদয় পড়ে থাকে বাংলাদেশেই। টেলিভিশনে কথা বলি বলে আমাদের কাছে আকুল আগ্রহে তাঁরা জানতে চান কী হচ্ছে দেশে। অনেকে তাঁদের সমস্যার কথা বলেন। বিমান, বিমানবন্দর কিংবা পাসপোর্ট কন্ট্রোলের কঠিন লাইনে দাঁড়িয়েও দেশের জন্য তাঁদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। সবকিছুর মর্মার্থ একই। দেশ ভালোভাবে চলছে না, দেশটা আরও ভালোভাবে চালানো উচিত ছিল আমাদের দুই দলের।
দেশের মানুষের কাছে তা অস্বীকারই করি কীভাবে? ১৯ সেপ্টেম্বর আমরা পা রাখি প্রায় এক অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশে। আগের দিন হঠাৎ সহিংস জামায়াত বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশকে। পুলিশও পাল্টা মার দিয়েছে, নির্বিচারে গ্রেপ্তার করেছে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের। আজ এই লেখার দিনে চলছে হরতাল। দুই বড় দল আরও বড় সংঘাতের হুমকি দিয়ে রেখেছে পরস্পরকে। সন্ত্রাসবাদ নেই, বিচ্ছিন্নতাবাদ নেই, জাতি বা বর্ণগত বিরোধ নেই, তবু কেন শান্তি নেই দেশে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?
২.
হরতাল একসময় ছিল গৌরবের বিষয়। অগণতান্ত্রিক এরশাদ সরকারের আমলে হরতালের পক্ষে ছিল ব্যাপক জনমত। এরশাদের মন্ত্রীরা হিসাব কষে দেখাতেন এক দিনের হরতালে কত ক্ষতি বাংলাদেশের, কত সমস্যায় পড়ে খেটে খাওয়া মানুষ। আমাদের নেতারা বলতেন—হরতাল গণতন্ত্রের জন্য, গণতন্ত্র এলে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না, বঞ্চনাবোধ থাকবে না। আমরা তা বিশ্বাস করতাম।
এরপর ‘গণতন্ত্র’ এসেছে এবং অনেক বছর ধরে আছে। কিন্তু মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কমেছে কি? দ্রব্যমূল্য, যোগাযোগব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান কোনো ক্ষেত্রেই লক্ষণীয় কোনো রকম উন্নতি হয়েছে কি? অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কি ভালো হয়েছে এরশাদ আমলের তুলনায়? গণতন্ত্রের যুগে অন্তত বাকস্বাধীনতা, সংগঠন ও সমাবেশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ বাড়ার কথা। কিন্তু এরশাদ আমলের তুলনায় এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি? এরশাদ আমলে বিরোধী দলগুলো যেভাবে নির্যাতিত হতো, সে তুলনায় গণতান্ত্রিক আমলে অত্যাচার আর নির্যাতন কমেছে কি?
এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর ভালো লাগবে না আমাদের গণতান্ত্রিক নেতাদের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের প্রজন্মের মানুষের কাছে এরশাদ এখনো প্রাসঙ্গিক। এরশাদের অগণতান্ত্রিক শাসনের চেয়ে শ্রেয়তর রাখার মৌলিক ও নৈতিক দায়দায়িত্ব কোনোভাবে পরবর্তী শাসকদলগুলো এড়াতে পারে না। এরশাদের আমলের তুলনায় খালেদা জিয়ার প্রথম আমলটা হয়তো ভালো ছিল। কিন্তু এর পরের সরকারগুলোর ক্রমাবনতি আমরা কি অগ্রাহ্য করতে পারি? খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমল ছিল ভয়াবহ। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় আমলও কি ভয়াবহ নয়?
হরতাল নিয়ে তাই বাড়তি উদ্বেগের কিছু নেই। কালেভদ্রে হলে হরতাল কোনো সমস্যা নয়। হরতাল বরং অনেক গভীর সমস্যার সিম্পটম বা লক্ষণ। হরতালে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দুঃশাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও বেশি। শেয়ার মার্কেটে যাঁরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, দলীয়করণ-দুর্নীতি আর অনিয়মের বলিতে যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, অব্যবস্থাপনার কারণে যাঁরা প্রতিদিন নিশ্চল হয়ে থাকেন পথঘাটে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যাঁদের থাকতে হয় অর্ধাহারে, তাঁরাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এসব মানুষকে সরকার আর সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা যতই জোরেশোরে হরতালের এক দিনের ক্ষতির হিসাব দেন না কেন, আমার মনে হয় না তাঁরা বিচলিত হন এতে। আমাদের মূল সমস্যা সুশাসনের নিদারুণ ঘাটতির। এটি মানুষকে এতই বঞ্চিত, ক্ষুব্ধ আর হতাশ করে রাখে যে কালেভদ্রের হরতালের ক্ষতি আমলে নেওয়ার মানসিকতাও অনেকের নেই এখন আর।
হরতাল তাই হয়তো এখন অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। হরতালের দিন বিরোধী দলকে মাঠে নামতে দেওয়া হয় না, সহিংস পিকেটিং আর হয় না বললেই চলে। হরতালে এখন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে নজিরবিহীনভাবে অনুষ্ঠিত হয় পরীক্ষা, রাস্তায় চলে কিছু সরকারি ব্যবস্থাপনার যান, রাজপথে থাকে পোশাক পরা আর পোশাক ছাড়া সরকারের পেটুয়াবাহিনী। তার পরও হরতাল পালিত হয়। পালিত যে হয়, তার সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রমাণ হরতালের দিন রাজধানীর সড়কগুলোর চিত্র। আমি এক হরতালের দিন রিকশায় ধানমন্ডির স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে আসি ১৭ মিনিটে। একই পথে অন্য দিনগুলোতে গাড়িতে আমার সময় লাগে প্রায় তিন গুণ বেশি। অন্যদের নিশ্চয়ই একই অভিজ্ঞতা হয়। হরতাল হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা বুঝতে মানুষের আর নেতাদের কথা শুনতে হয় না। কিন্তু শুধু হরতাল পালনই কি আমাদের সমাধান?
৩.
বহুদিন পরে গতকালের হরতাল ডাকা হয়েছিল জনস্বার্থের কথা বলে। বিশ্ববাজারে কমছে জ্বালানির দাম আর বাংলাদেশে ক্রমেই বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়লে আবারও বাড়বে দ্রব্যমূল্য, আরও করুণ পরিস্থিতি হবে সাধারণ মানুষের। তাহলে কেন একতরফাভাবে (এমনকি সংসদ, মন্ত্রিসভা বা দল ও জোটকাঠামোতে আলোচনা না করে) বাড়ানো হচ্ছে জ্বালানির দাম? সরকারের উত্তর নেই। মৃদুকণ্ঠে একবার শোনা গেল, ভারতে দাম আরও বেশি, এটাই নাকি কারণ! কিন্তু ভারতের মানুষের সমান ক্রয়ক্ষমতা কি আছে আমাদের; ভারতের মতো বিস্তৃত ও দক্ষ যোগাযোগব্যবস্থা কি রয়েছে আমাদের; ভারতে কি সমানভাবে সক্রিয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট?
ভারত তো নয়ই, জ্বালানির দাম বাড়ানোর কারণ এমনকি আইএমএফের ‘পরামর্শ’ও নয়। জ্বালানির দাম সরকার বাড়িয়েছে বিভিন্ন অস্বচ্ছ খাতে (২২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ চমৎকারভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন) ভর্তুকির চাপ কমাতে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতার কুফলগুলোকে আড়াল করতে। সহজভাবে বললে, নিজেদের অদক্ষতা, অনিয়ম বা হয়তো দুর্নীতির কারণে যে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, জনগণের পকেট থেকে তা পুষিয়ে নিতে!
বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর অবশ্যই এর প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু তা শুধু মৌসুমি বা বিচ্ছিন্নভাবে হলে হবে না। সরকার এ ধরনের স্বেচ্ছাচারমূলক অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগে। বিএনপি যদি ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ ভিত্তিতে প্রতিবাদ করে, তাহলে তার শ্রেণীস্বার্থ নিয়ে মানুষের প্রশ্ন থেকে যাবে।
আশুগঞ্জ-আখাউড়ায় ভারতকে অস্বচ্ছ ও একতরফাভাবে ট্রানজিট দেওয়া, কনোকোফিলিপসকে সমুদ্রের তেলক্ষেত্র লিজ দেওয়া কিংবা দেশে শেয়ারবাজারে তীব্র সংকটের সময় বিএনপি নীরব বা প্রায়-নীরব ছিল। ফলে দলটির ভূমিকা কতটা জনস্বার্থে আর কতটা ক্ষমতায় যাওয়ার হিসাব-নিকাশ থেকে, সেই সংশয় অব্যাহত থাকবে অনেকের মনে।
আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন বিএনপিকে। বিএনপিকে অবশ্যই সংসদে যেতে হবে। জামায়াতে ইসলামের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার রাজনীতি থেকে সুস্পষ্টভাবে সরে আসতে হবে। পরিবারকেন্দ্রিক কর্মসূচি পরিহার করে দেশকেন্দ্রিক কর্মসূচি প্রদান করতে হবে। বিএনপি যদি সত্যি যোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারে, তাহলেই সরকারের টনক নড়বে। তখন সরকার হয়তো অনেক বেশি জনস্বার্থমুখী হবে।
আমাদের প্রত্যাশা সরকার আর বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা দেখার। এই প্রতিযোগিতা যেদিন দৃশ্যমান হবে, কেবল তখনই হরতাল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বিষবাষ্প থেকে অনেকাংশে মুক্ত হব আমরা।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। বিশেষ করে ভারতের কিছু কিছু অঞ্চল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতন, গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, বিশেষ বাহিনীগুলোর দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার বিবরণ ছিল খুবই উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশেও সন্ত্রাসবাদবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে সন্ত্রাস দমনের বিভিন্ন বিধান রয়েছে। এর পরও বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে সন্ত্রাসবাদ দমনের একটি কঠোর আইন করেছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নামে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন আইনের সংশোধন করে নাগরিকদের টেলিফোন, ই-মেইলসহ সব গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘনের বিধান করেছে। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার পরও প্রতিবেশী অধিকাংশ রাষ্ট্রের তুলনায় বেশি খারাপ নয়। কাঠমান্ডু সম্মেলনে তাই তুলনামূলকভাবে কম সমালোচনা হয় আমাদের দেশের। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে শাহ্দীন মালিক, শাহনাজ হুদা ও আমার সময় কাটে অন্য দেশের পরিস্থিতির প্রতি বেশি উদ্বেগ নিয়ে।
আমাদের সমস্যা হয় অন্য ক্ষেত্রে। গ্যাংটক, কাঠমান্ডু বা কলম্বো যেখানেই যাই, দক্ষিণ এশিয়ার বন্ধুরা জানতে চায়, কী অবস্থা চলছে বাংলাদেশে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের মতো জাতিগত বিরোধ নেই বাংলাদেশে, বর্ণবাদ বা ধর্মীয় সন্ত্রাসও নেই এখানে। ১৬ কোটি মানুষের প্রায় সবার ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, সামাজিক আচরণ একই রকম এখানে। তার পরও এত রাজনৈতিক অস্থিরতা কেন বাংলাদেশে?
এর উত্তর আমরা সবাই জানি। তবু বিদেশি কারও কাছে দেশের বদনাম করতে কষ্ট হয় আমার। কিছু বিষয় তাই চেপে রাখি, কিছু বিষয় হালকা করে বলি, অথবা সমস্যাটি মূলত ‘প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি সৃষ্টির ব্যর্থতা’—এ ধরনের তাত্ত্বিক কথা বলি। আর হতাশ হয়ে ভাবি, এই প্রশ্ন কত দিন শুনব আমরা?
একসময় দেশে ফেরার সময় হয়। আগে ঢাকার বিমানবন্দর ছাড়ার সময় একবার কাঁদতাম, আরেকবার ফেরার সময়। প্রথম কান্না কষ্টের, দ্বিতীয়টা আনন্দের—কিন্তু দুটোই দেশকে ভালোবাসার। এমন ভালোবাসা নিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের মানুষ। নিউজার্সি, বোলজানো, ইস্তাম্বুল, দুবাই—সবখানে দেখেছি, বাংলাদেশের মানুষের হূদয় পড়ে থাকে বাংলাদেশেই। টেলিভিশনে কথা বলি বলে আমাদের কাছে আকুল আগ্রহে তাঁরা জানতে চান কী হচ্ছে দেশে। অনেকে তাঁদের সমস্যার কথা বলেন। বিমান, বিমানবন্দর কিংবা পাসপোর্ট কন্ট্রোলের কঠিন লাইনে দাঁড়িয়েও দেশের জন্য তাঁদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন। সবকিছুর মর্মার্থ একই। দেশ ভালোভাবে চলছে না, দেশটা আরও ভালোভাবে চালানো উচিত ছিল আমাদের দুই দলের।
দেশের মানুষের কাছে তা অস্বীকারই করি কীভাবে? ১৯ সেপ্টেম্বর আমরা পা রাখি প্রায় এক অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশে। আগের দিন হঠাৎ সহিংস জামায়াত বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশকে। পুলিশও পাল্টা মার দিয়েছে, নির্বিচারে গ্রেপ্তার করেছে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের। আজ এই লেখার দিনে চলছে হরতাল। দুই বড় দল আরও বড় সংঘাতের হুমকি দিয়ে রেখেছে পরস্পরকে। সন্ত্রাসবাদ নেই, বিচ্ছিন্নতাবাদ নেই, জাতি বা বর্ণগত বিরোধ নেই, তবু কেন শান্তি নেই দেশে? কোথায় যাচ্ছি আমরা?
২.
হরতাল একসময় ছিল গৌরবের বিষয়। অগণতান্ত্রিক এরশাদ সরকারের আমলে হরতালের পক্ষে ছিল ব্যাপক জনমত। এরশাদের মন্ত্রীরা হিসাব কষে দেখাতেন এক দিনের হরতালে কত ক্ষতি বাংলাদেশের, কত সমস্যায় পড়ে খেটে খাওয়া মানুষ। আমাদের নেতারা বলতেন—হরতাল গণতন্ত্রের জন্য, গণতন্ত্র এলে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা থাকবে না, বঞ্চনাবোধ থাকবে না। আমরা তা বিশ্বাস করতাম।
এরপর ‘গণতন্ত্র’ এসেছে এবং অনেক বছর ধরে আছে। কিন্তু মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কমেছে কি? দ্রব্যমূল্য, যোগাযোগব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান কোনো ক্ষেত্রেই লক্ষণীয় কোনো রকম উন্নতি হয়েছে কি? অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কি ভালো হয়েছে এরশাদ আমলের তুলনায়? গণতন্ত্রের যুগে অন্তত বাকস্বাধীনতা, সংগঠন ও সমাবেশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ বাড়ার কথা। কিন্তু এরশাদ আমলের তুলনায় এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি? এরশাদ আমলে বিরোধী দলগুলো যেভাবে নির্যাতিত হতো, সে তুলনায় গণতান্ত্রিক আমলে অত্যাচার আর নির্যাতন কমেছে কি?
এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর ভালো লাগবে না আমাদের গণতান্ত্রিক নেতাদের। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের প্রজন্মের মানুষের কাছে এরশাদ এখনো প্রাসঙ্গিক। এরশাদের অগণতান্ত্রিক শাসনের চেয়ে শ্রেয়তর রাখার মৌলিক ও নৈতিক দায়দায়িত্ব কোনোভাবে পরবর্তী শাসকদলগুলো এড়াতে পারে না। এরশাদের আমলের তুলনায় খালেদা জিয়ার প্রথম আমলটা হয়তো ভালো ছিল। কিন্তু এর পরের সরকারগুলোর ক্রমাবনতি আমরা কি অগ্রাহ্য করতে পারি? খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমল ছিল ভয়াবহ। শেখ হাসিনার দ্বিতীয় আমলও কি ভয়াবহ নয়?
হরতাল নিয়ে তাই বাড়তি উদ্বেগের কিছু নেই। কালেভদ্রে হলে হরতাল কোনো সমস্যা নয়। হরতাল বরং অনেক গভীর সমস্যার সিম্পটম বা লক্ষণ। হরতালে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দুঃশাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরও বেশি। শেয়ার মার্কেটে যাঁরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন, দলীয়করণ-দুর্নীতি আর অনিয়মের বলিতে যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, অব্যবস্থাপনার কারণে যাঁরা প্রতিদিন নিশ্চল হয়ে থাকেন পথঘাটে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যাঁদের থাকতে হয় অর্ধাহারে, তাঁরাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এসব মানুষকে সরকার আর সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীরা যতই জোরেশোরে হরতালের এক দিনের ক্ষতির হিসাব দেন না কেন, আমার মনে হয় না তাঁরা বিচলিত হন এতে। আমাদের মূল সমস্যা সুশাসনের নিদারুণ ঘাটতির। এটি মানুষকে এতই বঞ্চিত, ক্ষুব্ধ আর হতাশ করে রাখে যে কালেভদ্রের হরতালের ক্ষতি আমলে নেওয়ার মানসিকতাও অনেকের নেই এখন আর।
হরতাল তাই হয়তো এখন অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। হরতালের দিন বিরোধী দলকে মাঠে নামতে দেওয়া হয় না, সহিংস পিকেটিং আর হয় না বললেই চলে। হরতালে এখন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে নজিরবিহীনভাবে অনুষ্ঠিত হয় পরীক্ষা, রাস্তায় চলে কিছু সরকারি ব্যবস্থাপনার যান, রাজপথে থাকে পোশাক পরা আর পোশাক ছাড়া সরকারের পেটুয়াবাহিনী। তার পরও হরতাল পালিত হয়। পালিত যে হয়, তার সবচেয়ে দৃশ্যমান প্রমাণ হরতালের দিন রাজধানীর সড়কগুলোর চিত্র। আমি এক হরতালের দিন রিকশায় ধানমন্ডির স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে আসি ১৭ মিনিটে। একই পথে অন্য দিনগুলোতে গাড়িতে আমার সময় লাগে প্রায় তিন গুণ বেশি। অন্যদের নিশ্চয়ই একই অভিজ্ঞতা হয়। হরতাল হচ্ছে কি হচ্ছে না, তা বুঝতে মানুষের আর নেতাদের কথা শুনতে হয় না। কিন্তু শুধু হরতাল পালনই কি আমাদের সমাধান?
৩.
বহুদিন পরে গতকালের হরতাল ডাকা হয়েছিল জনস্বার্থের কথা বলে। বিশ্ববাজারে কমছে জ্বালানির দাম আর বাংলাদেশে ক্রমেই বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়লে আবারও বাড়বে দ্রব্যমূল্য, আরও করুণ পরিস্থিতি হবে সাধারণ মানুষের। তাহলে কেন একতরফাভাবে (এমনকি সংসদ, মন্ত্রিসভা বা দল ও জোটকাঠামোতে আলোচনা না করে) বাড়ানো হচ্ছে জ্বালানির দাম? সরকারের উত্তর নেই। মৃদুকণ্ঠে একবার শোনা গেল, ভারতে দাম আরও বেশি, এটাই নাকি কারণ! কিন্তু ভারতের মানুষের সমান ক্রয়ক্ষমতা কি আছে আমাদের; ভারতের মতো বিস্তৃত ও দক্ষ যোগাযোগব্যবস্থা কি রয়েছে আমাদের; ভারতে কি সমানভাবে সক্রিয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট?
ভারত তো নয়ই, জ্বালানির দাম বাড়ানোর কারণ এমনকি আইএমএফের ‘পরামর্শ’ও নয়। জ্বালানির দাম সরকার বাড়িয়েছে বিভিন্ন অস্বচ্ছ খাতে (২২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ চমৎকারভাবে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন) ভর্তুকির চাপ কমাতে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতার কুফলগুলোকে আড়াল করতে। সহজভাবে বললে, নিজেদের অদক্ষতা, অনিয়ম বা হয়তো দুর্নীতির কারণে যে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, জনগণের পকেট থেকে তা পুষিয়ে নিতে!
বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর অবশ্যই এর প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু তা শুধু মৌসুমি বা বিচ্ছিন্নভাবে হলে হবে না। সরকার এ ধরনের স্বেচ্ছাচারমূলক অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগে। বিএনপি যদি ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ ভিত্তিতে প্রতিবাদ করে, তাহলে তার শ্রেণীস্বার্থ নিয়ে মানুষের প্রশ্ন থেকে যাবে।
আশুগঞ্জ-আখাউড়ায় ভারতকে অস্বচ্ছ ও একতরফাভাবে ট্রানজিট দেওয়া, কনোকোফিলিপসকে সমুদ্রের তেলক্ষেত্র লিজ দেওয়া কিংবা দেশে শেয়ারবাজারে তীব্র সংকটের সময় বিএনপি নীরব বা প্রায়-নীরব ছিল। ফলে দলটির ভূমিকা কতটা জনস্বার্থে আর কতটা ক্ষমতায় যাওয়ার হিসাব-নিকাশ থেকে, সেই সংশয় অব্যাহত থাকবে অনেকের মনে।
আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন বিএনপিকে। বিএনপিকে অবশ্যই সংসদে যেতে হবে। জামায়াতে ইসলামের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার রাজনীতি থেকে সুস্পষ্টভাবে সরে আসতে হবে। পরিবারকেন্দ্রিক কর্মসূচি পরিহার করে দেশকেন্দ্রিক কর্মসূচি প্রদান করতে হবে। বিএনপি যদি সত্যি যোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারে, তাহলেই সরকারের টনক নড়বে। তখন সরকার হয়তো অনেক বেশি জনস্বার্থমুখী হবে।
আমাদের প্রত্যাশা সরকার আর বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ভালো কাজের প্রতিযোগিতা দেখার। এই প্রতিযোগিতা যেদিন দৃশ্যমান হবে, কেবল তখনই হরতাল এবং অন্যান্য রাজনৈতিক বিষবাষ্প থেকে অনেকাংশে মুক্ত হব আমরা।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments