চরাচর-মানুষ বিক্রির হাটে একদিন by ফখরে আলম
১৪ আগস্ট ১৯৯৪। সারা দিন আমি আর সাংবাদিক বন্ধু ফকির সওকত নড়াইলের গ্রামগঞ্জে কাজ করে বাড়ি ফিরছি। যশোর-নড়াইল সড়ক প্রায় ফাঁকা। সন্ধ্যা কেবল নামবে। যশোরের বাঘারপাড়া থানার চাড়াভিটা বাজার সড়কের পাশেই। মোটরসাইকেল চালিয়ে এলেও এদিক-ওদিক তাকাই।
চাড়াভিটায় দেখতে পাই, বিরাট রেইনট্রি গাছের নিচে কয়েক শ মানুষ। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে, কেউ শুয়ে আছে। আমি মোটরসাইকেল থামিয়ে হেঁটে লোকারণ্যে যাই। জানার চেষ্টা করি, এত মানুষ জমায়েতের কারণ কী? জানতে পারি, এটি মানুষ বিক্রির হাট। প্রতি বুধ ও শনিবার এখানে মানুষ বিক্রি হয়। আমি নোটবুক বের করি। ছবি তুলি। হাটের ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলি। জানতে পারি, সাতক্ষীরা, মাগুরা, যশোর, ফরিদপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহসহ আশপাশের এলাকার ক্রেতারা এখান থেকে ধান কাটা, মাড়াইসহ অন্যান্য কৃষি ও গৃহস্থালি কাজের জন্য মানুষ কিনে নিয়ে যায়। মানুষ বিক্রি হয় সপ্তাহ ও মাসিক ভিত্তিতে। এ সময় কাজ বাবদ পারিশ্রমিক ও খাবার দেওয়া হয়। বৃদ্ধ, কমজোরি মানুষের এখানে দাম কম। কিন্তু শক্তিধর মানুষের দাম বেশি। আমি লক্ষ করি, মানুষ বিক্রির হাটের পাশে গরুও বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারা গরুর মতোই পরখ করে মানুষ কিনছে। হাটে কথা বলি সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার দুরমুজখালি গ্রামের বৃদ্ধ সামসুদ্দিনের সঙ্গে। সে ১০০ মাইল দূর থেকে বিক্রি হতে এসেছে। কিন্তু শরীরে শক্তি কম বলে তার কোনো দাম কেউ বলেনি। সে বলল, এলাকায় চিংড়ি চাষ হয়। কোনো কাজ নেই। সংসারে পাঁচজন লোক। ভাতের বড় অভাব। কেউ যদি আমাকে না কেনে তাহলেও আর বাড়ি ফিরব না। নড়াইলের কালিয়া থানার রঘুনাথপুর গ্রামের আবদুস সারোম (৪৬) বলল, ২৫ টাকা দাম উঠেছে। কম দামে বিক্রি হতে মন চাইছে না। হাটে কথা হয় ফরিদপুরের আলোকদার গ্রামের সিরাজের সঙ্গে। সে নিজেকে বিকোতে এসেছে। কথা হয় ক্রেতা বাঘারপাড়ার বন্নামুখ গ্রামের শাজাহান মোল্লার সঙ্গে। তিনি বললেন, দীর্ঘদিন এ হাট থেকে মানুষ কিনছি। সপ্তাহে ২০০ টাকা আর পেটে-ভাতে চারজন কিনেছি। তিনি ব্যস্ত হয়ে কেনা মানুষ নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন। আমি ছবিসহ রিপোর্ট লিখে পাঠাই। ১৯ আগস্ট বাংলাবাজার পত্রিকায় ছবিসহ প্রথম পাতায় মানুষ বিক্রির হাটের রিপোর্ট ছাপা হয়। বার্তা সম্পাদক আহমেদ ফারুক হাসান আমাকে ধন্যবাদ জানান। কিছুদিন পর ঢাকা অফিসে গেলে তিনি আমার হাতে একটি বই ধরিয়ে দেন। ড. মোহাম্মদ হান্নানের লেখা ঘটনাপঞ্জি ১৯৯৪। কী আশ্চর্য! গ্রন্থটিতে বছরের সেরা রিপোর্টের একটি সংবাদপত্র থেকে আমার মানুষ বিক্রির হাটের রিপোর্টটিই তুলে ধরা হয়েছে।
ফখরে আলম
ফখরে আলম
No comments