বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম-নীতিমালা নয়, প্রয়োজন সম্প্রচার আইন by মশিউল আলম
সরকার দেশের বেসরকারি বেতার-টেলিভিশনগুলোর জন্য একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেল, বেসরকারি সম্প্রচার নীতিমালা ২০০১ নামে চূড়ান্ত খসড়াটি তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটি তা আবার মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে।
কমিটির সভাপতি ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য অনুসারে, সংবিধান ও তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিমার্জিত একটি নীতিমালা তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, খসড়া নীতিমালাটি ‘গণমাধ্যমবান্ধব’ হয়নি।
খসড়াটির প্রস্তাবনায় বলা হচ্ছে, ‘প্রতিটি বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশনের কার্যক্রম তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য নীতিমালা করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়। সকল বেসরকারি রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলকে নিজ নিজ দায়িত্বে এই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।’
এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কার্যক্রম চালাচ্ছে। পরের দিকে কয়েকটি এফএম বেতারও চালু হয়েছে। বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সরব উপস্থিতির ফলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। বিশেষ করে, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে এ দেশে যে বৈদ্যুতিন সাংবাদিকতা (ইলেকট্রনিক জার্নালিজম) শুরু হয়েছে, তা উন্নত না হলেও প্রভাব সৃষ্টির বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় টিভির সাংবাদিকতাকে পিছে ফেলে দিয়েছে। বেসরকারি এফএম বেতারকেন্দ্রগুলোর খবরও এখন প্রচুর মানুষ শোনে; গ্রহণযোগ্যতায় সেগুলো বাংলাদেশ বেতারকে ছাড়িয়ে গেছে এবং বিবিসি বাংলার বিকল্পের ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটলে তা ৎক্ষণিকভাবে সে খবর পাওয়ার জন্য মানুষ হয় বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দেখে, অথবা বেসরকারি এফএম বেতারকেন্দ্রগুলো শোনে। মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের আগেই নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার জন্য বেসরকারি বেতার-টিভির ওপর জনগণের এই নির্ভরশীলতা এ দেশের বৈদ্যুতিন সাংবাদিকতার দিগন্ত ক্রমেই প্রসারিত করছে।
কিন্তু এ বিষয়ে দেশে কোনো আইন বা নীতি এখন পর্যন্ত নেই। সরকারের নির্বাহী বিভাগের মর্জিমাফিক চলছে আমাদের বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম (ইলেকট্রনিক মিডিয়া)। বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় মূলত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে; যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের নিজেদের লোকজনই শুধু লাইসেন্স পান, অন্যরা পান না। তাঁদের অনেকেই সরাসরি সরকারি দলের নেতা। নির্বাহী ক্ষমতার এমনই জোর যে ইচ্ছা করলেই সরকার যেকোনো বেসরকারি বেতারকেন্দ্র বা টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স বাতিল করে দিতে পারে। সিএসবি ও চ্যানেল ওয়ান দুটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। যমুনা টিভির ভাগ্য ঝুলে আছে নির্বাহী ক্ষমতার অনুগ্রহের ঘাটতির কারণে।
কোনো গণতান্ত্রিক দেশের বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম এমনভাবে চলে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে যুক্তরাজ্যের কথা বলা যায়, সে দেশে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম পরিচালিত হয় ব্রডকাস্টিং অ্যাক্ট ও কমিউনিকেশনস অ্যাক্টের অধীনে। আইনের বিধানগুলো তাদের অনুসরণ করতে হয়, আবার তাদের সুরক্ষাও দেয় আইনই। দেশটির সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক টিভি চ্যানেলগুলো, স্যাটেলাইট টিভিগুলোর একটি অংশ, কেব্ল টিভিগুলো এবং বাণিজ্যিক বেতারকেন্দ্রগুলো পরিচালিত হয় ইনডিপেনডেন্ট ব্রডকাস্টিং অথরিটি (আইবিএ) ও ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন অথরিটি—এই দুটি স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে। বাংলাদেশে বেসরকারি বেতার-টিভির জন্য নীতি নয়, প্রথমেই প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট আইন। আইন নেই বলে বেসরকারি টেলিভিশন ক্ষেত্রটি বড্ড অস্থির। কোনো চ্যানেল অনেক বেশি বেতন দেয়, কোনোটি বেতন দেয় খুব কম। চাকরির নিশ্চয়তা নেই; বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলোও বড়ই অনিশ্চিত। এই অঙ্গনে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা বলেন, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের জগতে চলছে এক নৈরাজ্যকর পরিবেশ। মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের জন্য দেশে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট আছে, ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ আছে; খুব শক্তিশালী না হলেও একটি প্রেস কাউন্সিলও আছে। কিন্তু বেতার-টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য এসবের কিছুই নেই।
তাই প্রথমেই একটি সম্প্রচার আইন দরকার। নীতিমালাও তৈরি করতে আপত্তি নেই; কিন্তু নীতিমালা বাস্তবায়নের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা থাকে না বলে এর নির্দেশনাগুলো কেউ না মানলে আইনি পদক্ষেপও নেওয়া যায় না। অর্থা ৎ সরকার নীতিমালা করলেও তা বাস্তবায়নে সফল হবে এমন কথা বলা যায় না। বেসরকারি টিভি-রেডিওর লাইসেন্স প্রদান-প্রক্রিয়াটি যে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল—এই অবস্থারও কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
খসড়া নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, অবৈষম্যমূলক ও জবাবদিহিমূলক হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে লাইসেন্সের সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে। লাইসেন্সের আবেদন মূল্যায়নের জন্য সরকার পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করবে। এ কমিটি আবেদনের শেষ তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রদান করবে। এ ক্ষেত্রে কারিগরি সামর্থ্য, আর্থিক সংগতি, মানবসম্পদের দক্ষতা, উন্নত মানের ও সৃজনশীল অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষমতা, বাজারের বিস্তার, সাংস্কৃতিক প্রয়োজনীয়তা এবং জনগণের প্রয়োজন ও আগ্রহ বিবেচনা করে লাইসেন্স প্রদান করা হবে।’
বলা বাহুল্য, এই রকম নীতিমালা যদি আগেই তৈরি করা হতো এবং তা মেনে চলা হতো, তাহলে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সচল বেসরকারি বেতার-টিভিগুলোর যাঁরা মালিক, তাঁদের সবাই লাইসেন্স পেতেন না; আবার অনেকেই পেতেন, যাঁরা সরকারি দলের নিজের বা কাছের লোক নন বলে পাননি। এ রকম বিধান রেখে আইন করা দরকার, যেন লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ এ বিধান মেনে লাইসেন্স দিতে বাধ্য থাকে। নীতিমালা মানার তো কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না।
সম্প্রচার আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে সরকার তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াটির দৃষ্টান্ত নিতে পারে। তথ্য অধিকার আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছিল মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, তথ্য মন্ত্রণালয় সেটি নিয়েছিল; তারপর সরকারের লোকজন সেটি নিয়ে কাজ করেছেন। খসড়া সম্পর্কে নাগরিক সমাজের মতামত জানা ও সুপারিশ গ্রহণের জন্য সেটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমসহ নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে একাধিক সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক হয়েছিল। সবার মিলিত উদ্যোগে আইনটির খসড়া তৈরি হয়েছিল। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নবম জাতীয় সংসদের অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইন পাস করেছে। সম্প্রচার আইনের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত। আমরা শুনেছি, এশিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের পরামর্শে ও অর্থানুকূল্যে আর্টিকেল থার্টিনাইন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশের জন্য একটি সম্প্রচার আইনের খসড়া তৈরি করে তথ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কখনো কোনো আগ্রহের প্রকাশ দেখা যায়নি। এখন তথ্য মন্ত্রণালয় সে খসড়াটি নিয়ে কাজ করতে পারে, বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের লোকজনের সঙ্গেও প্রথমে পরামর্শ করে নিতে পারে। যে খাতের জন্য আইন তৈরি করা হয়, আইন প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় সেই খাতে কর্মরত মানুষের সম্পৃক্ত করা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর স্বাভাবিক রীতি। যুক্তরাজ্যে সংবাদমাধ্যমকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না, আইনের বিধানগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম নিজে থেকেই আচরণবিধি তৈরি করে নেয়।
আইনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা নয়, বরং সুরক্ষা দেওয়া। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকে সাংবাদিকতা। বাংলাদেশে কয়েকটি ‘সংবাদ চ্যানেলের’ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যারা চব্বিশ ঘণ্টাই সংবাদ ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করবে। ‘এটিএন নিউজ’ ইতিমধ্যে তা করছে। কথা উঠেছে, সরকার বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর টক শো নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাদের সংবাদ প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায়। সম্প্রচার নীতিমালা তৈরির উদ্যোগের ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের যে কজন ব্যক্তি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই মনে করেন, সরকার একটি নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিতে চায় বলেই এই উদ্যোগ শুরু করেছে। তথ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও বলেছেন, ‘গণমাধ্যমের জন্য হুমকি হবে, এমন কোনো নীতিমালা চাই না।’
বৈদ্যুতিন সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণের ভাবনা যদি সরকারের থেকে থাকে, তবে তা পরিহার করাই ভালো। সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা কখনোই সুফল এনে দেয় না। গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই বরং একটি আইন প্রণয়ন করা দরকার।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
খসড়াটির প্রস্তাবনায় বলা হচ্ছে, ‘প্রতিটি বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশনের কার্যক্রম তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য নীতিমালা করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়। সকল বেসরকারি রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলকে নিজ নিজ দায়িত্বে এই নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।’
এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কার্যক্রম চালাচ্ছে। পরের দিকে কয়েকটি এফএম বেতারও চালু হয়েছে। বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সরব উপস্থিতির ফলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। বিশেষ করে, বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে এ দেশে যে বৈদ্যুতিন সাংবাদিকতা (ইলেকট্রনিক জার্নালিজম) শুরু হয়েছে, তা উন্নত না হলেও প্রভাব সৃষ্টির বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় টিভির সাংবাদিকতাকে পিছে ফেলে দিয়েছে। বেসরকারি এফএম বেতারকেন্দ্রগুলোর খবরও এখন প্রচুর মানুষ শোনে; গ্রহণযোগ্যতায় সেগুলো বাংলাদেশ বেতারকে ছাড়িয়ে গেছে এবং বিবিসি বাংলার বিকল্পের ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটলে তা ৎক্ষণিকভাবে সে খবর পাওয়ার জন্য মানুষ হয় বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দেখে, অথবা বেসরকারি এফএম বেতারকেন্দ্রগুলো শোনে। মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের আগেই নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়ার জন্য বেসরকারি বেতার-টিভির ওপর জনগণের এই নির্ভরশীলতা এ দেশের বৈদ্যুতিন সাংবাদিকতার দিগন্ত ক্রমেই প্রসারিত করছে।
কিন্তু এ বিষয়ে দেশে কোনো আইন বা নীতি এখন পর্যন্ত নেই। সরকারের নির্বাহী বিভাগের মর্জিমাফিক চলছে আমাদের বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম (ইলেকট্রনিক মিডিয়া)। বেতার-টিভির লাইসেন্স দেওয়া বা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় মূলত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে; যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তাদের নিজেদের লোকজনই শুধু লাইসেন্স পান, অন্যরা পান না। তাঁদের অনেকেই সরাসরি সরকারি দলের নেতা। নির্বাহী ক্ষমতার এমনই জোর যে ইচ্ছা করলেই সরকার যেকোনো বেসরকারি বেতারকেন্দ্র বা টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স বাতিল করে দিতে পারে। সিএসবি ও চ্যানেল ওয়ান দুটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। যমুনা টিভির ভাগ্য ঝুলে আছে নির্বাহী ক্ষমতার অনুগ্রহের ঘাটতির কারণে।
কোনো গণতান্ত্রিক দেশের বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম এমনভাবে চলে না। দৃষ্টান্ত হিসেবে যুক্তরাজ্যের কথা বলা যায়, সে দেশে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম পরিচালিত হয় ব্রডকাস্টিং অ্যাক্ট ও কমিউনিকেশনস অ্যাক্টের অধীনে। আইনের বিধানগুলো তাদের অনুসরণ করতে হয়, আবার তাদের সুরক্ষাও দেয় আইনই। দেশটির সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক টিভি চ্যানেলগুলো, স্যাটেলাইট টিভিগুলোর একটি অংশ, কেব্ল টিভিগুলো এবং বাণিজ্যিক বেতারকেন্দ্রগুলো পরিচালিত হয় ইনডিপেনডেন্ট ব্রডকাস্টিং অথরিটি (আইবিএ) ও ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন অথরিটি—এই দুটি স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে। বাংলাদেশে বেসরকারি বেতার-টিভির জন্য নীতি নয়, প্রথমেই প্রয়োজন একটি সুনির্দিষ্ট আইন। আইন নেই বলে বেসরকারি টেলিভিশন ক্ষেত্রটি বড্ড অস্থির। কোনো চ্যানেল অনেক বেশি বেতন দেয়, কোনোটি বেতন দেয় খুব কম। চাকরির নিশ্চয়তা নেই; বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলোও বড়ই অনিশ্চিত। এই অঙ্গনে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা বলেন, বেসরকারি টিভি চ্যানেলের জগতে চলছে এক নৈরাজ্যকর পরিবেশ। মুদ্রিত সংবাদমাধ্যমের জন্য দেশে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট আছে, ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ আছে; খুব শক্তিশালী না হলেও একটি প্রেস কাউন্সিলও আছে। কিন্তু বেতার-টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য এসবের কিছুই নেই।
তাই প্রথমেই একটি সম্প্রচার আইন দরকার। নীতিমালাও তৈরি করতে আপত্তি নেই; কিন্তু নীতিমালা বাস্তবায়নের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা থাকে না বলে এর নির্দেশনাগুলো কেউ না মানলে আইনি পদক্ষেপও নেওয়া যায় না। অর্থা ৎ সরকার নীতিমালা করলেও তা বাস্তবায়নে সফল হবে এমন কথা বলা যায় না। বেসরকারি টিভি-রেডিওর লাইসেন্স প্রদান-প্রক্রিয়াটি যে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল—এই অবস্থারও কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
খসড়া নীতিমালায় প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, অবৈষম্যমূলক ও জবাবদিহিমূলক হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে লাইসেন্সের সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে। লাইসেন্সের আবেদন মূল্যায়নের জন্য সরকার পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করবে। এ কমিটি আবেদনের শেষ তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রদান করবে। এ ক্ষেত্রে কারিগরি সামর্থ্য, আর্থিক সংগতি, মানবসম্পদের দক্ষতা, উন্নত মানের ও সৃজনশীল অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষমতা, বাজারের বিস্তার, সাংস্কৃতিক প্রয়োজনীয়তা এবং জনগণের প্রয়োজন ও আগ্রহ বিবেচনা করে লাইসেন্স প্রদান করা হবে।’
বলা বাহুল্য, এই রকম নীতিমালা যদি আগেই তৈরি করা হতো এবং তা মেনে চলা হতো, তাহলে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সচল বেসরকারি বেতার-টিভিগুলোর যাঁরা মালিক, তাঁদের সবাই লাইসেন্স পেতেন না; আবার অনেকেই পেতেন, যাঁরা সরকারি দলের নিজের বা কাছের লোক নন বলে পাননি। এ রকম বিধান রেখে আইন করা দরকার, যেন লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ এ বিধান মেনে লাইসেন্স দিতে বাধ্য থাকে। নীতিমালা মানার তো কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না।
সম্প্রচার আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে সরকার তথ্য অধিকার আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াটির দৃষ্টান্ত নিতে পারে। তথ্য অধিকার আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছিল মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, তথ্য মন্ত্রণালয় সেটি নিয়েছিল; তারপর সরকারের লোকজন সেটি নিয়ে কাজ করেছেন। খসড়া সম্পর্কে নাগরিক সমাজের মতামত জানা ও সুপারিশ গ্রহণের জন্য সেটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমসহ নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে একাধিক সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক হয়েছিল। সবার মিলিত উদ্যোগে আইনটির খসড়া তৈরি হয়েছিল। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর নবম জাতীয় সংসদের অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইন পাস করেছে। সম্প্রচার আইনের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত। আমরা শুনেছি, এশিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের পরামর্শে ও অর্থানুকূল্যে আর্টিকেল থার্টিনাইন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশের জন্য একটি সম্প্রচার আইনের খসড়া তৈরি করে তথ্য মন্ত্রণালয়কে দিয়েছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কখনো কোনো আগ্রহের প্রকাশ দেখা যায়নি। এখন তথ্য মন্ত্রণালয় সে খসড়াটি নিয়ে কাজ করতে পারে, বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের লোকজনের সঙ্গেও প্রথমে পরামর্শ করে নিতে পারে। যে খাতের জন্য আইন তৈরি করা হয়, আইন প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় সেই খাতে কর্মরত মানুষের সম্পৃক্ত করা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর স্বাভাবিক রীতি। যুক্তরাজ্যে সংবাদমাধ্যমকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে না, আইনের বিধানগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম নিজে থেকেই আচরণবিধি তৈরি করে নেয়।
আইনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা নয়, বরং সুরক্ষা দেওয়া। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকে সাংবাদিকতা। বাংলাদেশে কয়েকটি ‘সংবাদ চ্যানেলের’ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যারা চব্বিশ ঘণ্টাই সংবাদ ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করবে। ‘এটিএন নিউজ’ ইতিমধ্যে তা করছে। কথা উঠেছে, সরকার বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর টক শো নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাদের সংবাদ প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায়। সম্প্রচার নীতিমালা তৈরির উদ্যোগের ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের যে কজন ব্যক্তি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই মনে করেন, সরকার একটি নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নিতে চায় বলেই এই উদ্যোগ শুরু করেছে। তথ্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিও বলেছেন, ‘গণমাধ্যমের জন্য হুমকি হবে, এমন কোনো নীতিমালা চাই না।’
বৈদ্যুতিন সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণের ভাবনা যদি সরকারের থেকে থাকে, তবে তা পরিহার করাই ভালো। সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা কখনোই সুফল এনে দেয় না। গণতন্ত্রের অপরিহার্য অঙ্গ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই বরং একটি আইন প্রণয়ন করা দরকার।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments