খোলা চোখে-আমাদেরও একটি ‘গ্রিন পার্টি’ চাই by হাসান ফেরদৌস
সম্প্রতি জার্মানিতে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেছে। গ্রিন পার্টি নামের একটি ছোট দল—খুবই ছোট দল—হঠা ৎ করে রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে। রাজ্যপর্যায়ে পর পর কয়েকটি নির্বাচনে তাদের বিজয় এই নজরকাড়ার কারণ। দক্ষিণের বাডেন-ভুরটিংবার্গের মতো বিত্তবানের রাজ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ ভোট পেয়ে তারা এখন সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করেছে। ফলে পৃথিবীতে এই প্রথম কোনো গ্রিন পার্টির সদস্য নিজেকে প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচয় দিতে পারবেন।
না, এ কথা বলছি না যে গ্রিন পার্টি জার্মানিতে ফেডারেল পর্যায়ে একাই সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। তেমন অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি, কিন্তু তাদের বিজয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে কেন্দ্রে মধ্য-বাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে নিয়ে এখন না হোক, দুই দিন পর তারা জোট সরকারের নেতৃত্ব দেবে—এ কথা ভাবা অযৌক্তিক নয়। এর আগেও জশকা ফিশারের নেতৃত্বে গ্রিন পার্টি জার্মানিতে জোট সরকারে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এবারের বিজয় আগের সেসব অর্জনকে ছাপিয়ে গেছে। দক্ষিণের এই রাজ্যে বরাবরই রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতা ধরে রেখেছে। গত ৬০ বছরে এই প্রথম সেই ব্যবস্থায় পরিবর্তন এল। অ্যাঙ্গেলা মেরকেল ও তাঁর দল সে কারণেই মাথা চুলকানো শুরু করেছে। ২০০৯-এর নির্বাচনে জার্মান গ্রিন পার্টি মোট ভোটের প্রায় ১০ শতাংশ জিতে জাতীয় পার্লামেন্টের ৬৮টি আসন দখল করে। তখনো কেউ ভাবেনি, এই দল বড় ধরনের কোনো বিজয় ছিনিয়ে আনবে। কিন্তু এখন সবাইকেই নতুন করে অঙ্ক কষতে হচ্ছে।
গ্রিন পার্টির শুরু সত্তরের দশকে, তখন ইউরোপে পরিবেশবাদী আন্দোলন মাত্র দানা বাঁধতে শুরু করেছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে উন্নয়ন অর্জিত না হলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে—এ কথা একদম নতুন না হলেও রাজনৈতিকভাবে তা কোনো ইস্যু হয়ে ওঠেনি। আশির দশকের মাঝামাঝিতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যু ৎকেন্দ্রে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর এক নতুন পরিস্থিতির শুরু হলো। উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর এই বল্গাহীন অত্যাচার চলতে দেওয়া যায় না, সে কথা নানা মহলে বলা শুরু হলো। নব্বইয়ের দশকে এসে ভূমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির সমস্যা সম্বন্ধে সচেতনতা এক নতুন আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী আন্দোলনের সূচনা করে। শুধু ইউরোপেই নয়, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেও পরিবেশ ও উন্নয়ন একটি রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়। কিন্তু পরিবেশ ও উন্নয়নের প্রশ্নটি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে এমন সরাসরি সম্পৃক্ত করার সাফল্য জার্মান গ্রিনরা যতটা পেরেছে, আর কোথাও ততটা দেখা যায়নি।
শুধু জার্মানি নয়, সারা ইউরোপেই এখন গ্রিন আন্দোলন স্বীকৃত রাজনৈতিক শক্তি। একদম তৃণমূল পর্যায় থেকেই শুরু করে এই আন্দোলন জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছর ইংল্যান্ডে গ্রিন পার্টির একজন সদস্য প্রথমবারের মতো পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন। এর আগে আয়ারল্যান্ডে গ্রিন পার্টির সদস্যরা পার্লামেন্টে ছয়টি আসন দখল করেন। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডেও গ্রিন দলের জয় হয়েছে। ইউরোপের বাইরে ব্রাজিলেও গত বছর গ্রিন ব্যানারে নির্বাচনে নেমে বিজয়ী হয়েছে একটি ছোট দল।
ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানির গ্রিন আন্দোলনের এজেন্ডা খুব সংক্ষিপ্ত। প্রধানত পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের বিরুদ্ধাচরণ করেই এরা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সম্প্রতি জাপানে পারমাণবিক বিপর্যয় তাদের হাতকে আরও শক্তিশালী করেছে। গোড়ার দিকে অবশ্য বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক ইস্যুতেও এরা জোট বাঁধার চেষ্টা করে। সমকামীদের অধিকার, অভিবাসীদের প্রতি নমনীয় আচরণ ও তাদের অধিকারের স্বীকৃতি, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের বৃহত্তর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি ইস্যু গ্রিন আন্দোলনকে সংহত হতে সাহায্য করে। সত্তরের দশকে ছাত্রদের ‘প্রটেস্ট মুভমেন্ট’ পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবে গ্রিন বেগবান হয়ে ওঠে। সে সময় অবশ্য গ্রিন মুখ্যত ক্যাম্পাস-নির্ভর ছিল। একসময় যারা ছাত্র ছিল, পরে তারাই রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ায় গ্রিন আন্দোলন গুণগতভাবে বদলে যায়।
মাত্র ৪০ বছরের গ্রিন আন্দোলন এখন একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক শক্তি। ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই দুই বা তিনদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার চল। সেখানে পুরোনো অব্যাহত ধারা বা স্ট্যাটাস-কো ভেঙে নিজেদের জন্য আলাদা জায়গা করে নেওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু তার পরেও যে এই কঠিন কাজ সম্ভব হয়েছে, তা কেবল পরিবেশবাদী আন্দোলনে বিশ্বাসী রাজনৈতিকভাবে সচেতন একদল কর্মীর লেগে থাকার কারণেই। এক লাফে কেন্দ্রে ক্ষমতার জন্য তাঁরা লড়াই করেননি। সবার আগে চেষ্টা করেছেন যে ইস্যুগুলো নিয়ে তাঁদের লড়াই, মানুষের কাছে তা বুঝিয়ে বলতে। এ কাজটা চলেছে স্থানীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে। ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরাই এই আন্দোলনে সবার আগে যুক্ত হয়েছেন, কিন্তু ক্রমে তা প্রসারিত হয়েছে সমাজের নানা স্তরে। ছাত্রদের থেকে তা ছড়িয়েছে মেয়েদের মধ্যে, সেখান থেকে অভিবাসীদের ভেতর, তারও পরে শ্রমিকশ্রেণী ও মধ্যবিত্ত কর্মজীবীদের ভেতর। এভাবে গড়ে উঠেছে একটি বড় ধরনের জোট বা কোয়ালিশন। ন্যূনতম সম্মতি ও ঐকমত্য অর্জনের ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে আন্দোলনের ভিত্তি।
জার্মানি বা আয়ারল্যান্ডের চেয়ে তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশে পরিবেশ ও উন্নয়নের সংকট অনেক বেশি তীব্র। পরিবেশের ভারসাম্য মাথায় না রেখে অপরিকল্পিত ও লাগামহীন উন্নয়নের ফল কী দাঁড়ায়, আজকের ঢাকার দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল বা পেরু, আফ্রিকার কেনিয়া বা প্রতিবেশী ভারতের সমস্যাও অভিন্ন। অথচ এসব দেশের কোনোটাতেই পরিবেশ একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠেনি। পরিবেশবাদী আন্দোলন যে নেই তা নয়, কিন্তু সেই আন্দোলনকে রাজনৈতিক স্রোতোধারার সঙ্গে অঙ্গীভূত করার কোনো কার্যকর ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। কোথাও কোনো গ্রিন পার্টি গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো হয় পরিবেশ-সংকট বিষয়ে অসচেতন বা এই সমস্যাকে জাতীয় রাজনৈতিক এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করতে অনাগ্রহী।
এই অবস্থা বদলানোর জন্য দরকার আমাদের নিজের গ্রিন পার্টি, তা যে নামেই তাকে ডাকুন না কেন।
‘গ্রিন পার্টি চাই’ বললাম আর সে পার্টি গজিয়ে গেল, তা তো নয়। তবে এ কাজটা ইউরোপে যেভাবে হয়েছে, আমাদের দেশেও তা সম্ভব। এর জন্য সবার আগে দরকার পরিবেশ ও উন্নয়নের ভারসাম্যে বিশ্বাসী সমমনা মানুষের একজোট হওয়া। আমাদের দেশে কিছু করা মানেই লোকজন ডেকে অভিজাত হোটেলে সেমিনার করা। জার্মানির গ্রিন পার্টি তাদের ৪০ বছরের ইতিহাসে কোনো হোটেলে লোক দেখানো একটা সেমিনারও করেনি, কিন্তু ডজন ডজন জমায়েত করেছে, স্কুল-কলেজে ‘টিচ-ইন’ কর্মসূচি পালন করেছে, রাস্তায় নেমেছে মিছিল নিয়ে। লক্ষ্য একটাই, পরিবেশ ও উন্নয়নের প্রশ্নটিকে জাতীয় সংলাপের অংশ হিসেবে দাঁড় করানো। সব রাজনীতির লক্ষ্য ক্ষমতা, সে কথায় কোনো ভুল নেই। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচনের আগে তারা চেষ্টা করেছে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নিতে। ছোট-বড় নানা শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন গ্রিন দলের নেতা-কর্মীরা, আর এভাবেই যোগ্য কর্মীও নেতা হিসেবে নিজেদের জন্য সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। মাত্র ৪০ বছরে তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছেন।
কী, কাজটা কি খুব কঠিন?
কঠিন, যদি লক্ষ্য হয় রাতারাতি কুরসিতে বসা। লক্ষ্য যদি হয় দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন গড়ে তোলা, তাহলে কিন্তু মোটেই কঠিন নয়। সব আন্দোলনের জন্য চাই সংগঠন ও সাংগঠনিক রণকৌশল। সব দেশে সব আন্দোলনের রণকৌশল অভিন্ন নয়, কিন্তু তাদের মধ্যে মোটের ওপর একধরনের মিল রয়েছে, ঐক্য রয়েছে। আমেরিকার সেন্টার ফর কমিউনিটি চেঞ্জের ডেভ বেকউইথ সে কথা মাথায় রেখে তৃণমূল পর্যায়ে কীভাবে সংগঠিত হওয়া যায়, তার একটা মোদ্দা নীলনকশা তৈরি করেছেন। প্রথম কাজ হলো সদস্য বা স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ। দু-চারজন পেশাদার কর্মী চাই সংগঠনকে চালু রাখতে, কিন্তু তাকে সজীব রাখবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেসব স্বেচ্ছাসেবক সে কাজে হাত লাগাবেন। দ্বিতীয় কাজ হলো সুনির্দিষ্ট সার্ভিস পৌঁছে দেওয়া। আইনি পরামর্শ থেকে ভাঙা ঘর মেরামত করা, এমন সম্ভাব্য সব কাজ বিনা মূল্যে বা অল্প খরচে সম্পাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যে সংগঠনের ‘সার্ভিস ডেলিভারি’ যত দক্ষতাপূর্ণ, তার প্রতি নাগরিক সমর্থন তত বেশি। আর তিন নম্বর কাজ হলো স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট রণকৌশল প্রস্তুত করা।
খুব সহজ ও বাস্তবসম্মত আরও কিছু বুদ্ধি বাতলে দিয়েছেন বেকউইথ। তবে যে ফর্মুলাটি তিনি মন্ত্রের মতো বারবার বলেছেন, তা হলো এ রকম, ‘লড়াই, বিজয়, লড়াই, বিজয়, লড়াই, পরাজয়, আরও কঠোর লড়াই।’ অন্য কথায়, লেগে থাকতে হবে, ভেঙে পড়লে চলবে না। আরও একটা কথা—কৌশলগত পরিকল্পনার মানে হচ্ছে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে কর্মসূচি গ্রহণ। সবচেয়ে আশু যা প্রয়োজন তা হলো: বিজয়ের সম্ভাবনা যেখানে সবচেয়ে বেশি, লড়াইয়ের জন্য সেই সব ক্ষেত্র বা বিষয়কেই নির্বাচন করা।
আফ্রিকায় এ রকম একটি প্রবাদ রয়েছে: বৃক্ষরোপণের সেরা সময় ছিল ২০ বছর আগে। কিন্তু দ্বিতীয় সেরা সময় আজ, এখনই। ৪০ বছর আগে আমাদের গ্রিন আন্দোলন দানা বাঁধেনি, তাতে কি। দ্বিতীয় সেরা সময় তো এখনই।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
গ্রিন পার্টির শুরু সত্তরের দশকে, তখন ইউরোপে পরিবেশবাদী আন্দোলন মাত্র দানা বাঁধতে শুরু করেছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে উন্নয়ন অর্জিত না হলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটবে—এ কথা একদম নতুন না হলেও রাজনৈতিকভাবে তা কোনো ইস্যু হয়ে ওঠেনি। আশির দশকের মাঝামাঝিতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিলে পারমাণবিক বিদ্যু ৎকেন্দ্রে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর এক নতুন পরিস্থিতির শুরু হলো। উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর এই বল্গাহীন অত্যাচার চলতে দেওয়া যায় না, সে কথা নানা মহলে বলা শুরু হলো। নব্বইয়ের দশকে এসে ভূমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির সমস্যা সম্বন্ধে সচেতনতা এক নতুন আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী আন্দোলনের সূচনা করে। শুধু ইউরোপেই নয়, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেও পরিবেশ ও উন্নয়ন একটি রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়। কিন্তু পরিবেশ ও উন্নয়নের প্রশ্নটি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে এমন সরাসরি সম্পৃক্ত করার সাফল্য জার্মান গ্রিনরা যতটা পেরেছে, আর কোথাও ততটা দেখা যায়নি।
শুধু জার্মানি নয়, সারা ইউরোপেই এখন গ্রিন আন্দোলন স্বীকৃত রাজনৈতিক শক্তি। একদম তৃণমূল পর্যায় থেকেই শুরু করে এই আন্দোলন জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছর ইংল্যান্ডে গ্রিন পার্টির একজন সদস্য প্রথমবারের মতো পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন। এর আগে আয়ারল্যান্ডে গ্রিন পার্টির সদস্যরা পার্লামেন্টে ছয়টি আসন দখল করেন। ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডেও গ্রিন দলের জয় হয়েছে। ইউরোপের বাইরে ব্রাজিলেও গত বছর গ্রিন ব্যানারে নির্বাচনে নেমে বিজয়ী হয়েছে একটি ছোট দল।
ইউরোপের, বিশেষ করে জার্মানির গ্রিন আন্দোলনের এজেন্ডা খুব সংক্ষিপ্ত। প্রধানত পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারের বিরুদ্ধাচরণ করেই এরা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সম্প্রতি জাপানে পারমাণবিক বিপর্যয় তাদের হাতকে আরও শক্তিশালী করেছে। গোড়ার দিকে অবশ্য বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক ইস্যুতেও এরা জোট বাঁধার চেষ্টা করে। সমকামীদের অধিকার, অভিবাসীদের প্রতি নমনীয় আচরণ ও তাদের অধিকারের স্বীকৃতি, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের বৃহত্তর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি ইস্যু গ্রিন আন্দোলনকে সংহত হতে সাহায্য করে। সত্তরের দশকে ছাত্রদের ‘প্রটেস্ট মুভমেন্ট’ পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম হিসেবে গ্রিন বেগবান হয়ে ওঠে। সে সময় অবশ্য গ্রিন মুখ্যত ক্যাম্পাস-নির্ভর ছিল। একসময় যারা ছাত্র ছিল, পরে তারাই রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়ায় গ্রিন আন্দোলন গুণগতভাবে বদলে যায়।
মাত্র ৪০ বছরের গ্রিন আন্দোলন এখন একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক শক্তি। ইউরোপের অধিকাংশ দেশেই দুই বা তিনদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার চল। সেখানে পুরোনো অব্যাহত ধারা বা স্ট্যাটাস-কো ভেঙে নিজেদের জন্য আলাদা জায়গা করে নেওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু তার পরেও যে এই কঠিন কাজ সম্ভব হয়েছে, তা কেবল পরিবেশবাদী আন্দোলনে বিশ্বাসী রাজনৈতিকভাবে সচেতন একদল কর্মীর লেগে থাকার কারণেই। এক লাফে কেন্দ্রে ক্ষমতার জন্য তাঁরা লড়াই করেননি। সবার আগে চেষ্টা করেছেন যে ইস্যুগুলো নিয়ে তাঁদের লড়াই, মানুষের কাছে তা বুঝিয়ে বলতে। এ কাজটা চলেছে স্থানীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে। ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরাই এই আন্দোলনে সবার আগে যুক্ত হয়েছেন, কিন্তু ক্রমে তা প্রসারিত হয়েছে সমাজের নানা স্তরে। ছাত্রদের থেকে তা ছড়িয়েছে মেয়েদের মধ্যে, সেখান থেকে অভিবাসীদের ভেতর, তারও পরে শ্রমিকশ্রেণী ও মধ্যবিত্ত কর্মজীবীদের ভেতর। এভাবে গড়ে উঠেছে একটি বড় ধরনের জোট বা কোয়ালিশন। ন্যূনতম সম্মতি ও ঐকমত্য অর্জনের ভেতর দিয়ে নির্মিত হয়েছে আন্দোলনের ভিত্তি।
জার্মানি বা আয়ারল্যান্ডের চেয়ে তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশে পরিবেশ ও উন্নয়নের সংকট অনেক বেশি তীব্র। পরিবেশের ভারসাম্য মাথায় না রেখে অপরিকল্পিত ও লাগামহীন উন্নয়নের ফল কী দাঁড়ায়, আজকের ঢাকার দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়। দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল বা পেরু, আফ্রিকার কেনিয়া বা প্রতিবেশী ভারতের সমস্যাও অভিন্ন। অথচ এসব দেশের কোনোটাতেই পরিবেশ একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠেনি। পরিবেশবাদী আন্দোলন যে নেই তা নয়, কিন্তু সেই আন্দোলনকে রাজনৈতিক স্রোতোধারার সঙ্গে অঙ্গীভূত করার কোনো কার্যকর ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। কোথাও কোনো গ্রিন পার্টি গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো হয় পরিবেশ-সংকট বিষয়ে অসচেতন বা এই সমস্যাকে জাতীয় রাজনৈতিক এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করতে অনাগ্রহী।
এই অবস্থা বদলানোর জন্য দরকার আমাদের নিজের গ্রিন পার্টি, তা যে নামেই তাকে ডাকুন না কেন।
‘গ্রিন পার্টি চাই’ বললাম আর সে পার্টি গজিয়ে গেল, তা তো নয়। তবে এ কাজটা ইউরোপে যেভাবে হয়েছে, আমাদের দেশেও তা সম্ভব। এর জন্য সবার আগে দরকার পরিবেশ ও উন্নয়নের ভারসাম্যে বিশ্বাসী সমমনা মানুষের একজোট হওয়া। আমাদের দেশে কিছু করা মানেই লোকজন ডেকে অভিজাত হোটেলে সেমিনার করা। জার্মানির গ্রিন পার্টি তাদের ৪০ বছরের ইতিহাসে কোনো হোটেলে লোক দেখানো একটা সেমিনারও করেনি, কিন্তু ডজন ডজন জমায়েত করেছে, স্কুল-কলেজে ‘টিচ-ইন’ কর্মসূচি পালন করেছে, রাস্তায় নেমেছে মিছিল নিয়ে। লক্ষ্য একটাই, পরিবেশ ও উন্নয়নের প্রশ্নটিকে জাতীয় সংলাপের অংশ হিসেবে দাঁড় করানো। সব রাজনীতির লক্ষ্য ক্ষমতা, সে কথায় কোনো ভুল নেই। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচনের আগে তারা চেষ্টা করেছে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নিতে। ছোট-বড় নানা শহরের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন গ্রিন দলের নেতা-কর্মীরা, আর এভাবেই যোগ্য কর্মীও নেতা হিসেবে নিজেদের জন্য সম্মান আদায় করে নিয়েছেন। মাত্র ৪০ বছরে তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছেন।
কী, কাজটা কি খুব কঠিন?
কঠিন, যদি লক্ষ্য হয় রাতারাতি কুরসিতে বসা। লক্ষ্য যদি হয় দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন গড়ে তোলা, তাহলে কিন্তু মোটেই কঠিন নয়। সব আন্দোলনের জন্য চাই সংগঠন ও সাংগঠনিক রণকৌশল। সব দেশে সব আন্দোলনের রণকৌশল অভিন্ন নয়, কিন্তু তাদের মধ্যে মোটের ওপর একধরনের মিল রয়েছে, ঐক্য রয়েছে। আমেরিকার সেন্টার ফর কমিউনিটি চেঞ্জের ডেভ বেকউইথ সে কথা মাথায় রেখে তৃণমূল পর্যায়ে কীভাবে সংগঠিত হওয়া যায়, তার একটা মোদ্দা নীলনকশা তৈরি করেছেন। প্রথম কাজ হলো সদস্য বা স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ। দু-চারজন পেশাদার কর্মী চাই সংগঠনকে চালু রাখতে, কিন্তু তাকে সজীব রাখবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যেসব স্বেচ্ছাসেবক সে কাজে হাত লাগাবেন। দ্বিতীয় কাজ হলো সুনির্দিষ্ট সার্ভিস পৌঁছে দেওয়া। আইনি পরামর্শ থেকে ভাঙা ঘর মেরামত করা, এমন সম্ভাব্য সব কাজ বিনা মূল্যে বা অল্প খরচে সম্পাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। যে সংগঠনের ‘সার্ভিস ডেলিভারি’ যত দক্ষতাপূর্ণ, তার প্রতি নাগরিক সমর্থন তত বেশি। আর তিন নম্বর কাজ হলো স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট রণকৌশল প্রস্তুত করা।
খুব সহজ ও বাস্তবসম্মত আরও কিছু বুদ্ধি বাতলে দিয়েছেন বেকউইথ। তবে যে ফর্মুলাটি তিনি মন্ত্রের মতো বারবার বলেছেন, তা হলো এ রকম, ‘লড়াই, বিজয়, লড়াই, বিজয়, লড়াই, পরাজয়, আরও কঠোর লড়াই।’ অন্য কথায়, লেগে থাকতে হবে, ভেঙে পড়লে চলবে না। আরও একটা কথা—কৌশলগত পরিকল্পনার মানে হচ্ছে নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে কর্মসূচি গ্রহণ। সবচেয়ে আশু যা প্রয়োজন তা হলো: বিজয়ের সম্ভাবনা যেখানে সবচেয়ে বেশি, লড়াইয়ের জন্য সেই সব ক্ষেত্র বা বিষয়কেই নির্বাচন করা।
আফ্রিকায় এ রকম একটি প্রবাদ রয়েছে: বৃক্ষরোপণের সেরা সময় ছিল ২০ বছর আগে। কিন্তু দ্বিতীয় সেরা সময় আজ, এখনই। ৪০ বছর আগে আমাদের গ্রিন আন্দোলন দানা বাঁধেনি, তাতে কি। দ্বিতীয় সেরা সময় তো এখনই।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments