চারুশিল্প-বহুমাত্রিক শিল্পী by জাফরীন গুলশান
একজন মানুষের জীবন-কর্ম কেমন হওয়া উচিত কিংবা একজন শিল্পীর কর্ম কি শুধু শিল্পকর্মই সৃষ্টি করা, আরও ব্যাপক ও বিস্তৃত সৃজনী ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার কি আশা করা অনুচিত? কিংবা ঘুরেফিরে মানুষের সমস্ত কাজ, শিল্পীর সমস্ত সত্তা সচেতনভাবেই হোক বা অবচেতনভাবেই হোক স্বদেশচেতনা, দেশপ্রেম সর্বোপরি মানবতার প্রতি এক মূর্তমান শুভ
ফলাফলই ঘোষণা করে না কি? শিল্পী কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮) বাংলাদেশের শিল্পকলার জগতে গুরুত্বপূর্ণ একটি নাম। তিনি একাধারে শিল্পী, সংগঠক, লেখক—সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিসচেতন দেশপ্রেমী একজন ব্যক্তি। মাতৃভূমিকে ভালোবেসে দেশজ মোটিভে প্রকৃতি, সংস্কৃতিকে ধারণ করে অসংখ্য ছবি এঁকেছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নিজেকে ‘পটুয়া’ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এই বহুমাত্রিক শিল্পীর কর্মময় জীবন ও শিল্পকর্ম, তাঁর তথ্যভিত্তিক ঐতিহাসিক দলিলপত্রাদি, খেরোখাতা এবং অন্যান্য ব্যবহূত অনুষঙ্গ সব সময়ই শিল্পবোদ্ধা দর্শকদের আকৃষ্ট করবে। প্রদর্শনী ‘শতাব্দীর কামরুল’ জাতীয় জাদুঘরে পটুয়া কামরুল হাসানের ৯০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে দুই শতাধিক শিল্পকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। পুরো প্রদর্শনীতে কামরুল হাসানকে পড়া যায় সতত নিরীক্ষাধর্মী একজন শিল্পী হিসেবে। তাঁর শিল্পীমানসের দর্শনের কেন্দ্রভূমিতে ঐতিহ্যপ্রিয়তা। লোকঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সংশ্লেষণে তিনি সফলতম। ড্রয়িং, অবয়ব নির্মাণকৌশল ও রং-রেখার ব্যবহার ইত্যাদিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা এর পরিচয় পাই, এর কারণ অনুসন্ধানে মনোযোগী হলে তাঁর আর্ট কলেজে পড়ার সময়ে ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এ সময়ে তাঁর সঙ্গে পটুয়াদের সখ্য গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে পটচিত্র অঙ্কনের রীতিকৌশল তাঁর চিত্রে ব্যবহার করেছেন। অবয়বের পার্শ্বদৃশ্য অঙ্কন, মৌলিক রঙের ব্যবহার, দ্বিমাত্রিক চিত্র বৈশিষ্ট্য, রেখার স্বতঃস্ফূর্ততা, রেখার সরলীকরণ বৈশিষ্ট্য ডিজাইনের প্রবণতা ইত্যাদি বাংলার ঐতিহ্যবাহী পটশিল্পের মতো শিল্পী কামরুল হাসানের চিত্রপটের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। একই সঙ্গে তাঁর ছবিতে কিউবিজমের প্রভাব লক্ষণীয়। কিউবিজমের জটিলতার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং অবয়বের আঙ্গিক অঙ্কন, অঙ্কনের রেখা, রেখার ব্যবহার এমনভাবে হয় যাতে ছবিতে ত্রিমাত্রিকতার সৃষ্টি হয়। ছবিতে সমতলীয় পদ্ধতিতে রং লেপন, রং লেপনের সঙ্গে পরিপ্রেক্ষিতের আবহ সৃষ্টি পাশ্চাত্য শিল্পী হেনরি মাতিসকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু শিল্পী কামরুল হাসানের সমতলের বর্ণ লেপন আবার পটশৈলীরও একটি রীতির বহিঃপ্রকাশ। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, শিল্পী কামরুল হাসানের চিত্রকর্ম একই সঙ্গে দেশীয় পটুয়া ঐতিহ্য ও পাশ্চাত্যে তৎকালীন চর্বিত জনপ্রিয় শিল্পধারার সচেতন ও সুপরিকল্পিত মিশ্রিত ফলাফল। এবং সর্বোপরি দুয়ে মিলে শিল্পী কামরুল হাসান সার্থকভাবে নিজের স্বকীয়তা সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনে। এই প্রদর্শনীতে পুরুষ শিল্পী হিসেবেই নারীকে দেখেছেন। এখানে খুব বেশি বাস্তবানুগ নয় নারীর জীবন। একধরনের সুখী রোমান্টিক আবহ নারীকে নিয়ে। সৌন্দর্যই নারীর বৈশিষ্ট্য তাঁর চিত্রে। শিল্পী কামরুল হাসানের চিত্রকর্মের বিষয় হিসেবে নারী এসেছে অসংখ্যবার। বলা যায়, প্রধানতম বিষয়। নারীকে তিনি এঁকেছেন বাংলাদেশের সমাজচিত্রের অনুরূপে। নারীশরীরের নমনীয়তা, পেলবতা, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য নারীকে কেন্দ্র করে গুরুত্ব পেয়েছে। অপর একটি বিষয় লক্ষণীয়, কামরুল হাসানের ছবির চরিত্রগুলো; রমণী, পুরুষ, প্রকৃতির পশুপাখি যা-ই হোক; সেগুলো যথেষ্ট অভিব্যক্তিময় প্রতিকৃতি ধারণ করেছে। সৃষ্টিতে একধরনের সাবলীল বক্তব্য নিয়ে চিত্রপটে উপস্থিত, যা দর্শককে শিল্পীর নির্মিত ছবির সঙ্গে আরও একাত্মবোধ করতে বাধ্য করে। তাঁর ছবিতে গ্রামীণ সমাজ গুরুত্বপূর্ণ। যেন বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি সমাজব্যবস্থার এক সুচিন্তিত তথ্যসংকলন। নবীন প্রজন্মকে নতুনভাবে শিল্প, সমাজ জীবন, সংস্কৃতি, নিজ কর্তব্য সম্পর্কেও তাঁর ছবি, পোস্টার, যত্নসহকারে বিবিধ রঙিন কলমে লেখা খেরোখাতার দিনপঞ্জির লেখাগুলোতে সুস্পষ্ট।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আঁকা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় শিল্পী কর্মী হিসেবে আঁকা ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’সহ (যেটি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে আঁকা শেষ ছবি) অসংখ্য ড্রয়িং চিত্র ও বেশ কিছু লিনোকাট উডকাট মাধ্যমের কাজ রয়েছে। এই শিল্পীর নিষ্ঠা, সততা, দেশপ্রেম বর্তমান প্রজন্মকে আশান্বিত করবে, যখন আমরা সমাজ রাষ্ট্রের চরম এক বিক্ষিপ্ত, নিয়মনীতিবিহীন সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ অতিক্রম করছি। প্রদর্শনীটি চলবে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
পরিচয়: শিল্পী কামরুল হাসান ২ ডিসেম্বর, কলকাতায়। ১৯৩৮-এ কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯-এ গুরু সদয় দত্তের ‘ব্রতচারী’ শিবিরে যোগ দেন। ১৯৪৮-এ স্থায়ীভাবে ঢাকা আগমন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগদান। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ হিসেবে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ। একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ। বাহাত্তরে জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা অঙ্কন করেন। দেশে ও বিদেশে একক ও দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশ নেন। জাতীয় জাদুঘরসহ ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও দেশের বাইরে তাঁর ছবি সংগৃহীত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আঁকা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় শিল্পী কর্মী হিসেবে আঁকা ‘দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে’সহ (যেটি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে আঁকা শেষ ছবি) অসংখ্য ড্রয়িং চিত্র ও বেশ কিছু লিনোকাট উডকাট মাধ্যমের কাজ রয়েছে। এই শিল্পীর নিষ্ঠা, সততা, দেশপ্রেম বর্তমান প্রজন্মকে আশান্বিত করবে, যখন আমরা সমাজ রাষ্ট্রের চরম এক বিক্ষিপ্ত, নিয়মনীতিবিহীন সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ অতিক্রম করছি। প্রদর্শনীটি চলবে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
পরিচয়: শিল্পী কামরুল হাসান ২ ডিসেম্বর, কলকাতায়। ১৯৩৮-এ কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯-এ গুরু সদয় দত্তের ‘ব্রতচারী’ শিবিরে যোগ দেন। ১৯৪৮-এ স্থায়ীভাবে ঢাকা আগমন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগদান। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ হিসেবে আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ। একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ। বাহাত্তরে জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা অঙ্কন করেন। দেশে ও বিদেশে একক ও দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশ নেন। জাতীয় জাদুঘরসহ ব্যক্তিগত পর্যায়ে ও দেশের বাইরে তাঁর ছবি সংগৃহীত।
No comments