দূরদেশ-ওবামার কূটকৌশল ও স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন by আলী রীয়াজ
জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ তথা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির জন্য ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আবেদন এখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিবেচনাধীন। যেমনটি আশা করা হয়েছিল, সেভাবেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেওয়ার আগে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের হাতে
আবেদনপত্র তুলে দিয়েছেন। এক অর্থে আবেদন করার আগেই এর পরিণতি কী হবে, কমবেশি সবাই তা বুঝতে পেরেছেন। বিশেষ করে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন এ প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটি কোনো অবস্থাতেই নিরাপত্তা পরিষদের সম্মতি পাবে না। কিন্তু এর পরও পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ অধীরভাবে অপেক্ষা করেছে এ মুহূর্তটির জন্য। এখনো ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ করছে, এই প্রক্রিয়ার পরিণতি কী হয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ফিলিস্তিনিদের বহু কাঙ্ক্ষিত, ন্যায্য ও আইনসংগত এ দাবির বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি ও পদক্ষেপে অধিকাংশ মানুষ কেবল দুঃখিতই নয়, ক্ষুব্ধও বটে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যদিও মোটেই নতুন নয়, তথাপি এই ক্ষোভের মাত্রা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ, অনেকেই আশা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এই নীতিতে পরিবর্তন আনবেন। তদুপরি ফিলিস্তিনিদের এই ন্যায়সংগত দাবি নাকচ করে দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রেসিডেন্ট ওবামা যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, তা অতীতের যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি একপেশে ও ইসরায়েলপন্থী। ওবামা গত আড়াই বছরে মধ্যপ্রাচ্য-পরিস্থিতি নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, বিশেষ করে ফিলিস্তিন প্রশ্নে যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, এর সঙ্গে এই বক্তৃতা অসংগতিপূর্ণ। এসবের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের জন্য সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও আত্মদানের যে ঘটনাবলি কয়েক মাস ধরে সবাই প্রত্যক্ষ করছেন, তার পটভূমিকায় এ ধরনের ভূমিকা ও বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতিকর। অনেকেরই আশা ছিল, ওবামা পরিবর্তনশীল এই পটভূমিকায় হয়তো কমপক্ষে চেষ্টা করবেন কী করে ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং কী করে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করা যায়। ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে এই আবেদন জমা দেওয়ার ঘোষণার পর গত কয়েক মাসে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এখন ওবামার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর ছোট হলেও উদারপন্থীদের একাংশ মর্মাহত হয়েছে। গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের গত দুই বছরের সামান্য যে অর্জন, তার প্রায় পুরোটাই এখন এই ভূমিকার জন্য খরচের খাতায় জমা পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ওবামা প্রশাসন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির বিরোধিতা কেন করছে, তার বিস্তারিত ইতিমধ্যেই বহুবার শোনা হয়েছে। এসব কথা ইসরায়েলি সরকারের চেয়ে মোটেই আলাদা নয়। জাতিসংঘের প্রস্তাব শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে না, রাষ্ট্র তৈরি করে দেবে না, ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করেই এসবের নিষ্পত্তি করতে হবে; এই আবেদন দুই পক্ষের সম্পর্ক আরও খারাপ করবে—এসব বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। কিন্তু সত্য হলেও এগুলো নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। ফলে এসব কথা বলে ফিলিস্তিনিদের নিরস্ত্র করার চেষ্টার মধ্যে ফিলিস্তিনি জনগণ ও নেতৃত্বকে নির্বোধ ভাবার লক্ষণ স্পষ্ট। ফিলিস্তিনি নেতারা এসব বোঝেন না বা বিবেচনায় নেননি, এমন মনে করা সংগত নয়। কিন্তু এর পরও তাঁরা জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছেন। অন্যদিকে যাঁরা এই কথা বলছেন যে এই আবেদন প্রতীকী বিষয় মাত্র, তাঁরা এই প্রচেষ্টার মর্মার্থ বুঝতে পারছেন না। ফিলিস্তিনি নেতারা একটি প্রতীকী কাজের জন্য এতটা উৎসাহী হবেন মনে করাটাও ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
এই পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা দরকার, তার মধ্যে অন্যতম হলো ওবামা প্রশাসনের এই ভূমিকার কারণ কী? প্রথমত, ওবামা প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অনুসৃত নীতির বাইরে কিছু করেনি। দ্বিতীয়ত, ওবামা আরও কঠোর অবস্থানের ভঙ্গি করেছেন, কেননা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের চাপের মুখে আছেন তিনি। ২০১২ সালে পুনর্নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি ভোটার ও ইসরায়েল-লবির সমর্থনে সামান্য ঘাটতির ঝুঁকি নেওয়া তাঁর জন্য সম্ভব নয়। তৃতীয়ত যে কারণটি এই ভূমিকার পেছনে কাজ করেছে বলে আমার ধারণা, সেটি যুক্ত এই আবেদন-পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে তার সঙ্গে। সে বিষয়ে একটু পরে আলোকপাত করব।
ফিলিস্তিনি নেতারা জানেন, তাঁদের আবেদন এই মুহূর্তেই নিরাপত্তা পরিষদে বিবেচিত হবে না। তাঁরা আরও জানেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদান নয় যে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের আবেদন গৃহীত হবে। নিরাপত্তা পরিষদের যে ১৫টি সদস্য-দেশ আছে, তার নয়টি দেশের সমর্থন প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ছয়টি ভোটের নিশ্চয়তা থাকলেও বাকি তিনটি ভোটের বিষয়ে এখনো কোনো নিশ্চয়তা নেই। ব্রাজিল, চীন, ভারত, লেবানন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়ার জোর সমর্থনের পাশাপাশি অন্য দেশ যেন তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে, যুক্তরাষ্ট্র সে জন্য সক্রিয় থাকবে। এ সবই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো-ক্ষমতা প্রয়োগের আগের কথা। শেষাবধি নয়টি দেশের সমর্থন পেলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর মুখে অকার্যকর হয়ে যাবে।
এসব অঙ্ক সত্ত্বেও মাহমুদ আব্বাস ও ফিলিস্তিনি নেতারা জাতিসংঘে এসে হাজির হয়েছেন। কেননা, এর ফলে এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক আইনগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা কেবল নৈতিক বিষয় নয়। গত দুই বছরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে সরাসরি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আলোচনা সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে গেছে। এই আলোচনার আর কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই। কেননা, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইসরায়েলের কট্টরপন্থীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ফলে এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে কিংবা যতক্ষণ না পর্যন্ত কট্টরপন্থীরা দুর্বল হচ্ছে, ততক্ষণ শান্তিপ্রক্রিয়া, আলোচনা এক কদমও এগোতে পারবে না। তার আশু কোনো সম্ভাবনাও নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর ওবামা প্রশাসন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। রিপাবলিকান পার্টির ভেতর কট্টরপন্থীদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুনর্নির্বাচন নিয়ে ওবামা-সমর্থকেরা এখন শঙ্কিত বলে প্রশাসনের পক্ষে পররাষ্ট্রনীতিতে জোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে হামাস ও ফাতাহ গোষ্ঠীর সাময়িক সমঝোতা হলেও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একচ্ছত্র নেতৃত্ব কোনো গোষ্ঠীর হাতে নেই। ফিলিস্তিনি নেতারা জানেন যে আলাপ-আলোচনা করে প্রধান বিরোধগুলো নিষ্পত্তি না করে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে অবস্থা, যে কাঠামোগত অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা ভাঙার জন্য অন্য পথ বেছে নেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। ফিলিস্তিনি নেতারা এ ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁদের আবেদনের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, ফিলিস্তিনি নেতারা অচলাবস্থা ভেঙে দিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে; আর সেটাই হচ্ছে এখনকার সাফল্য। ১৯৭৪ সালের পর জাতিসংঘে ফিলিস্তিন-প্রসঙ্গ এমনভাবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেনি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আজ-কালই এই আবেদন নিয়ে ভোট নেবে, এমন মনে করার কারণ নেই। বিশেষ করে, যখন এ বিষয়ে একটি ভেটোর হুমকি খড়্গের মতো মাথার ওপর ঝুলছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা চালাচ্ছে এ বিষয়ে আলোচনা স্থগিত রাখতে। তদুপরি নিরাপত্তা পরিষদ এই বিষয়ে আলোচনা ও ভোট স্থগিত রাখতে পারে যে পরিষদের বাইরে এ নিয়ে কূটনৈতিক চেষ্টা চলছে। তদুপরি এটিকে বিবেচনার জন্য ১৫ সদস্যের একটি কমিটির কাছে পাঠানো হতে পারে, যেখানে এ নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি বিচার-বিবেচনা করা হবে। এ কমিটি ৩৫ দিন সময় নিতে পারে। জাতিসংঘের নিয়মকানুনের এসব ঘুরপ্যাঁচ তখনই প্রয়োজন হয়, যখন এ নিয়ে অন্য উদ্যোগ চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়াকে নিয়ে যে ‘কোয়ার্টেট’ বা ‘চার পক্ষ’ রয়েছে, তারা যদি চটজলদি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়, তবেই পদ্ধতিগত ব্যবস্থার অজুহাতে নিরাপত্তা পরিষদের ভোট পিছিয়ে রাখা যাবে।
পদ্ধতিগত কারণে নিরাপত্তা পরিষদের ভোট পেছানো হোক অথবা না হোক, ইতিমধ্যেই একটা বড় রকমের কূটনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর তা হলো, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও আধিপত্য ছিল, তা কার্যত শেষ হয়ে গেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি তাঁর বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে ব্যর্থ বলে বর্ণনা করেছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর সমর্থন শর্তহীন নয় বলেই মনে হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির জন্য নেতৃত্বের সুযোগই কেবল সৃষ্টি হয়েছে, তা নয়; জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাদের একটি ভূমিকা নিতে হবে বলেও এখন তাদের এগিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র খোলামেলাভাবে একপেশে ভূমিকা নিলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, ওবামা প্রশাসন তা আঁচ করতে পারেনি বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ফলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশ্ব-অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের মুখে ওবামা প্রশাসনের মধ্যে এ ধারণা থাকাও বিচিত্র নয় যে শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবং ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য অন্যান্য শক্তিকে এই প্রক্রিয়ায় জায়গা ছেড়ে দেওয়া। এটাকে একেবারে নিছক কল্পনা বলে গোড়াতেই যাঁরা খারিজ করে দিতে চাইবেন, তাঁদের লিবিয়া প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও পদক্ষেপের দিকে ভালো করে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেব।
এসব নতুন কূটনৈতিক সমীকরণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি খুব শিগগির নিশ্চিত করবে—আমি এত আশাবাদী নই। তবে এখন গোটা দৃশ্যপটই বদলে গেছে বলে আগের চেয়ে আশাবাদের মাত্রা সামান্য বেশি।
ইলিনয়, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা যদিও মোটেই নতুন নয়, তথাপি এই ক্ষোভের মাত্রা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ, অনেকেই আশা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি এই নীতিতে পরিবর্তন আনবেন। তদুপরি ফিলিস্তিনিদের এই ন্যায়সংগত দাবি নাকচ করে দিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রেসিডেন্ট ওবামা যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে কথা বলেছেন, তা অতীতের যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের চেয়ে বেশি একপেশে ও ইসরায়েলপন্থী। ওবামা গত আড়াই বছরে মধ্যপ্রাচ্য-পরিস্থিতি নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, বিশেষ করে ফিলিস্তিন প্রশ্নে যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, এর সঙ্গে এই বক্তৃতা অসংগতিপূর্ণ। এসবের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের জন্য সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও আত্মদানের যে ঘটনাবলি কয়েক মাস ধরে সবাই প্রত্যক্ষ করছেন, তার পটভূমিকায় এ ধরনের ভূমিকা ও বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই ক্ষতিকর। অনেকেরই আশা ছিল, ওবামা পরিবর্তনশীল এই পটভূমিকায় হয়তো কমপক্ষে চেষ্টা করবেন কী করে ইসরায়েলিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং কী করে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করা যায়। ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে এই আবেদন জমা দেওয়ার ঘোষণার পর গত কয়েক মাসে তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। এখন ওবামার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর ছোট হলেও উদারপন্থীদের একাংশ মর্মাহত হয়েছে। গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের গত দুই বছরের সামান্য যে অর্জন, তার প্রায় পুরোটাই এখন এই ভূমিকার জন্য খরচের খাতায় জমা পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ওবামা প্রশাসন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির বিরোধিতা কেন করছে, তার বিস্তারিত ইতিমধ্যেই বহুবার শোনা হয়েছে। এসব কথা ইসরায়েলি সরকারের চেয়ে মোটেই আলাদা নয়। জাতিসংঘের প্রস্তাব শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে না, রাষ্ট্র তৈরি করে দেবে না, ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করেই এসবের নিষ্পত্তি করতে হবে; এই আবেদন দুই পক্ষের সম্পর্ক আরও খারাপ করবে—এসব বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক। কিন্তু সত্য হলেও এগুলো নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। ফলে এসব কথা বলে ফিলিস্তিনিদের নিরস্ত্র করার চেষ্টার মধ্যে ফিলিস্তিনি জনগণ ও নেতৃত্বকে নির্বোধ ভাবার লক্ষণ স্পষ্ট। ফিলিস্তিনি নেতারা এসব বোঝেন না বা বিবেচনায় নেননি, এমন মনে করা সংগত নয়। কিন্তু এর পরও তাঁরা জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছেন। অন্যদিকে যাঁরা এই কথা বলছেন যে এই আবেদন প্রতীকী বিষয় মাত্র, তাঁরা এই প্রচেষ্টার মর্মার্থ বুঝতে পারছেন না। ফিলিস্তিনি নেতারা একটি প্রতীকী কাজের জন্য এতটা উৎসাহী হবেন মনে করাটাও ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক।
এই পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা দরকার, তার মধ্যে অন্যতম হলো ওবামা প্রশাসনের এই ভূমিকার কারণ কী? প্রথমত, ওবামা প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অনুসৃত নীতির বাইরে কিছু করেনি। দ্বিতীয়ত, ওবামা আরও কঠোর অবস্থানের ভঙ্গি করেছেন, কেননা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের চাপের মুখে আছেন তিনি। ২০১২ সালে পুনর্নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি ভোটার ও ইসরায়েল-লবির সমর্থনে সামান্য ঘাটতির ঝুঁকি নেওয়া তাঁর জন্য সম্ভব নয়। তৃতীয়ত যে কারণটি এই ভূমিকার পেছনে কাজ করেছে বলে আমার ধারণা, সেটি যুক্ত এই আবেদন-পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে তার সঙ্গে। সে বিষয়ে একটু পরে আলোকপাত করব।
ফিলিস্তিনি নেতারা জানেন, তাঁদের আবেদন এই মুহূর্তেই নিরাপত্তা পরিষদে বিবেচিত হবে না। তাঁরা আরও জানেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দক্ষিণ সুদান নয় যে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের আবেদন গৃহীত হবে। নিরাপত্তা পরিষদের যে ১৫টি সদস্য-দেশ আছে, তার নয়টি দেশের সমর্থন প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে ছয়টি ভোটের নিশ্চয়তা থাকলেও বাকি তিনটি ভোটের বিষয়ে এখনো কোনো নিশ্চয়তা নেই। ব্রাজিল, চীন, ভারত, লেবানন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও রাশিয়ার জোর সমর্থনের পাশাপাশি অন্য দেশ যেন তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে, যুক্তরাষ্ট্র সে জন্য সক্রিয় থাকবে। এ সবই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো-ক্ষমতা প্রয়োগের আগের কথা। শেষাবধি নয়টি দেশের সমর্থন পেলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর মুখে অকার্যকর হয়ে যাবে।
এসব অঙ্ক সত্ত্বেও মাহমুদ আব্বাস ও ফিলিস্তিনি নেতারা জাতিসংঘে এসে হাজির হয়েছেন। কেননা, এর ফলে এখন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক আইনগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা কেবল নৈতিক বিষয় নয়। গত দুই বছরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে সরাসরি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আলোচনা সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে গেছে। এই আলোচনার আর কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনা নেই। কেননা, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ইসরায়েলের কট্টরপন্থীদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ফলে এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে কিংবা যতক্ষণ না পর্যন্ত কট্টরপন্থীরা দুর্বল হচ্ছে, ততক্ষণ শান্তিপ্রক্রিয়া, আলোচনা এক কদমও এগোতে পারবে না। তার আশু কোনো সম্ভাবনাও নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর ওবামা প্রশাসন দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। রিপাবলিকান পার্টির ভেতর কট্টরপন্থীদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুনর্নির্বাচন নিয়ে ওবামা-সমর্থকেরা এখন শঙ্কিত বলে প্রশাসনের পক্ষে পররাষ্ট্রনীতিতে জোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে হামাস ও ফাতাহ গোষ্ঠীর সাময়িক সমঝোতা হলেও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একচ্ছত্র নেতৃত্ব কোনো গোষ্ঠীর হাতে নেই। ফিলিস্তিনি নেতারা জানেন যে আলাপ-আলোচনা করে প্রধান বিরোধগুলো নিষ্পত্তি না করে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পাওয়া যাবে না। কিন্তু ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে অবস্থা, যে কাঠামোগত অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা ভাঙার জন্য অন্য পথ বেছে নেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না। ফিলিস্তিনি নেতারা এ ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা নিয়েছেন। তাঁদের আবেদনের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, ফিলিস্তিনি নেতারা অচলাবস্থা ভেঙে দিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে; আর সেটাই হচ্ছে এখনকার সাফল্য। ১৯৭৪ সালের পর জাতিসংঘে ফিলিস্তিন-প্রসঙ্গ এমনভাবে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেনি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আজ-কালই এই আবেদন নিয়ে ভোট নেবে, এমন মনে করার কারণ নেই। বিশেষ করে, যখন এ বিষয়ে একটি ভেটোর হুমকি খড়্গের মতো মাথার ওপর ঝুলছে এবং যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা চালাচ্ছে এ বিষয়ে আলোচনা স্থগিত রাখতে। তদুপরি নিরাপত্তা পরিষদ এই বিষয়ে আলোচনা ও ভোট স্থগিত রাখতে পারে যে পরিষদের বাইরে এ নিয়ে কূটনৈতিক চেষ্টা চলছে। তদুপরি এটিকে বিবেচনার জন্য ১৫ সদস্যের একটি কমিটির কাছে পাঠানো হতে পারে, যেখানে এ নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি বিচার-বিবেচনা করা হবে। এ কমিটি ৩৫ দিন সময় নিতে পারে। জাতিসংঘের নিয়মকানুনের এসব ঘুরপ্যাঁচ তখনই প্রয়োজন হয়, যখন এ নিয়ে অন্য উদ্যোগ চলতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়াকে নিয়ে যে ‘কোয়ার্টেট’ বা ‘চার পক্ষ’ রয়েছে, তারা যদি চটজলদি এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়, তবেই পদ্ধতিগত ব্যবস্থার অজুহাতে নিরাপত্তা পরিষদের ভোট পিছিয়ে রাখা যাবে।
পদ্ধতিগত কারণে নিরাপত্তা পরিষদের ভোট পেছানো হোক অথবা না হোক, ইতিমধ্যেই একটা বড় রকমের কূটনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর তা হলো, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও আধিপত্য ছিল, তা কার্যত শেষ হয়ে গেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি তাঁর বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে ব্যর্থ বলে বর্ণনা করেছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর সমর্থন শর্তহীন নয় বলেই মনে হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন ও জার্মানির জন্য নেতৃত্বের সুযোগই কেবল সৃষ্টি হয়েছে, তা নয়; জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তাদের একটি ভূমিকা নিতে হবে বলেও এখন তাদের এগিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র খোলামেলাভাবে একপেশে ভূমিকা নিলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, ওবামা প্রশাসন তা আঁচ করতে পারেনি বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। ফলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিশ্ব-অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনের মুখে ওবামা প্রশাসনের মধ্যে এ ধারণা থাকাও বিচিত্র নয় যে শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবং ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য অন্যান্য শক্তিকে এই প্রক্রিয়ায় জায়গা ছেড়ে দেওয়া। এটাকে একেবারে নিছক কল্পনা বলে গোড়াতেই যাঁরা খারিজ করে দিতে চাইবেন, তাঁদের লিবিয়া প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও পদক্ষেপের দিকে ভালো করে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেব।
এসব নতুন কূটনৈতিক সমীকরণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি খুব শিগগির নিশ্চিত করবে—আমি এত আশাবাদী নই। তবে এখন গোটা দৃশ্যপটই বদলে গেছে বলে আগের চেয়ে আশাবাদের মাত্রা সামান্য বেশি।
ইলিনয়, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments