ধর নির্ভয় গান-ফিরে দেখি একবার by আলী যাকের
রাজনীতি নাটকে থাকতেই পারে। রাজনীতি তো সমাজেরই ব্যাপার। তবে রাজনীতি যদি মঞ্চে আসে তবে তা আসবে নাটকেরই প্রয়োজনে। যে নাটক জীবনের কথা বলে, জীবনবোধের কথা বলে। আমার জানা মতে, নাটকের দুঃসময় শুরু হয়েছিল আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে।
ঠিক যখন প্রত্যক্ষ এবং দলীয় রাজনীতি নাটকের ওপরে ভর করেছিল একবার পেছনে ফিরে দেখি! বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৪০ বছর পর কত কিছু নিয়েই তো ভাবা যায়। রাজনীতি, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য এমন অনেক কিছুই। কিন্তু আমি অতীত থেকে, সুদূর অতীত নয়, কেবল সেই একাত্তরের নিকট অতীত থেকে যে স্বতঃস্ফূর্ত ফল্গুধারা উন্মত্ত সাগরের ঢেউয়ের মতো গর্জন তুলে ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হয়েছিল_ সেই অতীতের আলোকে আজকের বাংলাদেশের সামগ্রিক চরিত্র নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আশা করি, সেটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তার আগে আমি মনে করি, প্রাসঙ্গিকভাবেই একটা কথা বলে নেওয়া ভালো যেমন অনেকে বলে থাকেন গত চার দশকে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে এমন স্তরে যে, আমরা গর্বিত হতে পারি। এ ব্যাপারটি সম্বন্ধে আমি অতটা নিশ্চিত নই।
আমাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই যুদ্ধটা প্রথম শুরু_ পাকিস্তানের বিপক্ষে। সেই ১৯৪৮-এ যখন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বললেন, উর্দুই হবে আমাদের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আমরা সেই ঔদ্ধত্যকে প্রতিহত করেছি। যে কারণে ঢাকার রাস্তায় ভাষার প্রশ্নে নিরস্ত্র, নিরীহ প্রতিবাদীকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। এই যে প্রতিবাদ_ এর নিশ্চয়ই একটা তাৎপর্য আছে, একটা সুদূরপ্রসারী, সর্বব্যাপী তাৎপর্য। এই তাৎপর্য আমাদের অনুধাবন করতে হবে। না হলে আমাদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে যে কোনো আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই প্রতিবাদের ব্যাপারটিকে বুঝতে হলে আমাদের বেশ কিছু আপাত অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের দিকে দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন।
আমার সবসময়ই মনে হয় প্রকৃতির সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে। যেমন বাংলার বসন্তে গ্রামবাংলার পথে, ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মাটির ওপর অথবা চারপাশে দৃষ্টিপাত করলে নানা বর্ণের ফুল চোখে পড়ে। আর দেখার ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও নাক যদি খোলা থাকে কিছু সুগন্ধ কিন্তু এড়ানো অসম্ভব। এ গন্ধ বসন্তকালে গ্রামবাংলার পথে পথে প্রাণ উতলা করে দেয়। নাগরিক প্রচেষ্টায় বাড়ির আঙিনায় ফুল বাগানের গন্ধ এটা নয়। এটা নানাবিধ খাদ্যশস্যের ফুলের গন্ধ। যেমন এসব ফুলের রূপ, তেমন এর গন্ধ। সাদা ধনেফুল, বেগুনি খেসারি ফুল, হালকা বেগুনি ফুল তিসির, শিমের সাদা এবং বেগুনি ফুল, শর্ষের হলুদ ফুল আগে কখনও এত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করিনি। সম্প্রতি বিভিন্ন গ্রামে ঘন ঘন যাতায়াতের ফলে এ বিষয়গুলো মূর্ত হয়ে আসছে। আমি উল্লসিত হয়ে পড়ছি। প্রকৃতিতে এমন বৈচিত্র্য এই বাংলাদেশে। প্রতিটি ঋতু একেবারে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়।
যেমন পেলব, বর্ণময়, সুঘ্রাণে ভরপুর আমাদের প্রকৃতি, যেমন দৃশ্যমান ঋতুবৈচিত্র্য, ঠিক তেমনি বৈচিত্র্যে সিক্ত আমাদের সংস্কৃতি। এমন এই সংস্কৃতি যা হৃদয় অতিক্রম করে প্রায় দেহ দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। সংস্কৃতির এই চরিত্রটি অনুধাবন করতে না পারলে বুঝি দেশকে, দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিকে অনুধাবন করাও প্রায় অসাধ্য হয়ে পড়ে। কেননা সংস্কৃতিরই অন্তর্গত রাজনীতি-অর্থনীতি, ধর্ম, সামাজিক আচার, ভাষা, প্রায়োগিক অথবা চারুশিল্পকর্ম এসব কিছুই।
নিসর্গের সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতির যে ঘনিষ্ঠ যোগ, এই যোগের মধ্যে আমি আমাদের সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য দেখতে পাই। এমন কেউ কেউ আছেন যারা বুঝতে পারেন না কুড়ি শতকের চলি্লশের দশকে এই পূর্ববঙ্গের বাঙালি যে হৈ-হৈ করে জিন্নাহ সাহেবের আহ্বানে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়েছিল সেই বাঙালি কী করে দু'চার বছরের ব্যবধানেই ভাষার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে এলো। অবলীলায় প্রাণ উৎসর্গ করল। চুয়ান্নতে পাকিস্তান সৃষ্টিকারী দল মুসলিম লীগকে ভোটের মাধ্যমে উৎখাত করল। ঊনসত্তরে এমন এক গণআন্দোলন করল যে, পাকিস্তানের ভিত কেঁপে উঠল। সত্তরে আবারও নির্বাচনের মাধমে বস্তুতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যই ভোট দিল। তারপর নয় মাসের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম হলো বাংলাদেশের। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। না বোঝার ভান করারও কিছু নেই। পাকিস্তানের পক্ষে গণভোট দিলে যে একটা সোনার দেশ পাবে বাঙালি মুসলমান, যেখানে মধুর নহর বইবে, সবাই নিদেনপক্ষে লাখপতি হয়ে যাবে, এসব কথা যে দুর্বৃত্ত মুসলিম লীগ নেতারা বলেছিল; তারা মিথ্যা বলেছিল। ভাঁওতা দিয়েছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই বাঙালি মুসলমান সচকিত হয়ে আবিষ্কার করল যে, সে উদয়াস্ত পরিশ্রম শেষে পেট ভরে খেতে পায় না, উপরন্তু পাকিস্তান নামক তথাকথিত স্বর্গরাজ্য তার আবহমান বাঙালিত্ব থেকেও তাকে বঞ্চিত করেছে। অর্থাৎ তার পূর্বপুরুষ এবং ইতিহাসপ্রদত্ত সংস্কৃতিটাও ছিনতাই হয়ে গেছে। লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, 'আমার পেটে ভাত নেই', এর অনেক আগেই স্লোগান উঠেছে, 'ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।' এত অল্প আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন যে, একজন অভুক্ত মাঝি ভরা বর্ষায় বিপদসংকুল বিল পাড়ি দেওয়ার সময়ও ক্ষুধা ভুলে গিয়ে প্রাণ খুলে গান ধরে।
এই একটি প্রশ্নে, অন্তরের বারতার প্রশ্নে, বাঙালি বড় স্পর্শকাতর। আমি নিশ্চিত সব জাতিই তাই। আমরা যদি তামিল, সিন্ধি কি বেলুচিদের ওপর আমাদের ভাষা, আমাদের মূল্যবোধ কিংবা আমাদের সংস্কৃতিকে আরোপ করতে চাই তাহলে তারাও আমাদের মতোই প্রতিবাদ করবে এবং এমন হীন একটি কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। কাজেই আমাদের প্রকৃতি, প্রকৃতিলালিত জনগোষ্ঠী তার মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এমনকি আমাদের ধর্ম চর্চাও আমাদর স্বাতন্ত্র্যের পরিচয়বাহী। এটি যারা বুঝতে পারেন না অথবা বোঝার চেষ্টা করেন না তারা বাঙালি হয়েও অনেকটা একাত্তরের পাকিস্তানিদের মতোই অদূরদর্শীর মতো ব্যবহার করেন।
আমাদের বোধ উন্মেষের কাল থেকেই আমরা ধর্ম সম্বন্ধে নানাবিধ বচসার কথা শুনে আসছি। এর মধ্যে এ অঞ্চলের প্রধান দুই ধর্ম ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মের বচসা তো আছেই তার চেয়ে বেশি তর্ক-বিতর্ক বোধ করি শুনে আসছি ইসলামেরই সঠিক ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। এটি আবার বেশি ঘটে এবং ঘটেছে আমাদেরই অর্থাৎ তথাকথিত শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত এবং উচ্চশ্রেণীর মানুষের মধ্যে। প্রসঙ্গত, আমার প্রয়াত বাবার বলা একটি গল্প মনে পড়ে। গল্পটি বলার আগে বলে নিই যে, আমার জানা মতে, আমার বোধোদয়ের পর আমি কখনও আমার বাবাকে নামাজ 'কাজা' করতে দেখিনি। তিনি বলতেন, আমাদের গ্রাম রতনপুরে রমজান নামে এক কৃষক ছিলেন। সেই কৃষক সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন; কিন্তু তিনি ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন না। তিনি আরবিও শেখেননি। দিন শেষে খালের পানিতে স্নান করে পূতপবিত্র হয়ে তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে বলতেন_
'ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব, এশা_
পাঁচ ওয়াক্তের নিয়ত বান্ধলাম
আমি রমজাইন্যা চাষা।'
বাবা বলতেন, রমজান যদি বেহেশতে না যায় তাহলে তিনি নিজেও বেহেশতে যেতে আগ্রহী নন। আজকের আনুষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব ধর্মপিতাদের কাছে রমজাইন্যা চাষার ইসলাম অগ্রহণযোগ্য হতে পারে, তবে জীবন এবং সততার বৃহত্তর স্বার্থে রমজান যে কোনো মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষের কাছে একজন বড় মানুষ।
আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্গত যে ধর্মবোধ তা ওই কৃষক রমজান চর্চিত মানুষের ধর্ম। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মব্যবসায়ী কর্তৃক ব্যবহৃত ধর্ম নয়। 'মানুষের ধর্ম' আনুষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব লোক দেখানো ধর্ম নয়। অথচ আমরা অবলীলায় ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে চলেছি। আমার ধারণা, কেবল এই কারণেই আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের ধর্মের দূরত্ব বাড়ছে। বাড়ছে সংঘাত।
একবার, বেশ কিছুদিন আগে, ঢাকার একটি বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার একটি ক্যাসেটে রবীন্দ্রসঙ্গীতে একটি শব্দের ভুল উচ্চারণ নিয়ে অনেক চিঠিপত্র লেখা হয়েছিল। বন্যা এ সম্বন্ধে একটি দীর্ঘ জবাবও লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, গানটি দূরদর্শন থেকে ক্যাসেটে ট্রান্সফার করার সময় নিম্নমান হেতু উচ্চারণের হেরফের ঘটেছে। বন্যার ব্যাখ্যায় আমার প্রত্যয় আছে। যে শিল্পী এত বছর ধরে স্বদেশ এবং বিদেশে এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন তিনি একটি শ্রুত শব্দের উচ্চারণ নিয়ে আলোচনায় এমন বিশদ একটি ব্যাখ্যা লিখবেন না। লিখেছেন_ কেননা, তিনি প্রায় উপাসনার ভক্তি নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করেন। কাজেই ওই সঙ্গীতের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা তার আছে। তার চিঠিতে তিনি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন_ তার গানের এই কথিত ত্রুটি নিয়ে যে এত এত পত্র লেখা হয়েছে একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায়; এ থেকে স্পষ্টতই এ কথা প্রমাণিত হয় যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত দেশবাসীর কাছে কত প্রিয় এবং রবীন্দ্রনাথ আমাদের হৃদয়ের কত কাছের মানুষ। দেশবাসীর প্রতি বন্যার এ কৃতজ্ঞতাবোধের প্রসঙ্গ টেনে আমিও এই বিষয়টি থেকে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতাম। যাওয়ার ইচ্ছেও ছিল যদি না শেষ দিকে দু'একটি চিঠি এইরকমও থাকত যে, দেশের অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাকার পরিস্থিতি যখন এমন শোচনীয় তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এ কালক্ষেপণ অত্যন্ত অন্যায়। হায়, যে মানুষ হার্দিক, মানসিক এবং মানবিক দিক দিয়ে খর্বকায় এবং অক্ষম সে মানুষই কেবল এ ধরনের অশিক্ষিত উচ্চারণ করতে পারে। আমার এক সুহৃদের কাছে শুনেছিলাম, বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত আমাদের কোনো এক মন্ত্রী নাকি সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' দেখে মন্তব্য করেছিলেন, 'এমন দারিদ্র্য দেখিয়ে কী করে কেউ অত বিখ্যাত হতে পারে?'
আমার বিষয় নাটক। আমাদের স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে এসে আজ আমরা কি বুকে হাত রেখে বলতে পারি যে, আমাদের চর্চিত মাধ্যমে আমরা যেখানে পেঁৗছানোর জন্য যাত্রা শুরু করেছিলাম সেই সত্তরের দশকের গোড়ায়, সেখানে কি পৌঁছতে পেরেছি? হ্যাঁ আজ সন্ধ্যায় দর্শনীর বিনিময়ে অন্ততপক্ষে দুটি নাটক দেখতে পাওয়া যায়। এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পেরেছেন নাট্যজনেরা। আমি প্রায়ই বলে থাকি, একজন নাট্যকর্মী হিসেবে কেবল এই গৌরবই যথেষ্ট একটি জীবনে। এই সাফল্য, এই গৌরবকে কি আমরা আরও এগিয়ে নিতে পেরেছি?
প্রসঙ্গত কিছু সত্যি কথা বলার লোভ সংবরণ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। নাটক একটি শিল্পমাধ্যম। এ মাধ্যম সম্বন্ধে বিভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া হয়ে থাকে। অত্যন্ত প্রচলিত এবং জনপ্রিয় একটি সংজ্ঞা হচ্ছে, 'নাটক জীবনের কথা বলে'। এই 'জীবন' শব্দটি একটি ভীষণ বিমূর্ত শব্দ। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে জীবনের অর্থ আলাদা। একজন টোকাইয়ের কাছে জীবন হলো দিন শেষে ভরা পেটে নিদ্রায় ঢলে পড়া। আবার বুদ্ধদেব বসুর কাছে জীবনের অর্থ ছিল দিন শেষে কয়েক পাতা সাদা কাগজকে শিল্প-সুষমাময় কালো অক্ষরে ভরিয়ে তোলা। নাট্যকর্মীদের কাছে জীবন কী হবে তা তারাই নির্ধারণ করবেন। এখানে কিছু ইঙ্গিতের উল্লেখ করতে পারি। যেমন, নাট্যকর্মীরা প্রায়শই বলে থাকেন, 'মঞ্চ সমাজের দর্পণ'। কাজেই সমাজে যা ঘটে, সমাজে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বা দুর্ঘটনার জন্য কোনো কর্মকাণ্ড যদি চিহ্নিত হয় তা হতে পারে নাটকের উপজীব্য। আবার এই মূর্ত ব্যাখ্যা থেকে একটু বিযুক্ত হয়ে এ কথাও বলা যায় যে, একটি যুদ্ধ যদি সামগ্রিকভাবে একটি জনগোষ্ঠীর মানসিকতাকে প্রভাবিত করে তবে সেটাও হতে পারে নাটকের বিষয়।
ঠিক এইভাবে রাজনীতিও আসতে পারে নাটকে। তবে একটি সমাজ বা দেশের সব রাজনৈতিক উদ্বেলতা কিংবা কর্মকাণ্ডের বাহন কখনোই হতে পারে না নাটক। অবশ্যই একজন নাট্যকর্মীর রাজনীতি থাকতে পারে, নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ থাকতে পারে, তবে তিনি প্রথমে একজন নাট্যকর্মী এবং শেষ পর্যন্ত একজন নাট্যকর্মীই। তিনি রাজনীতিবিদও নন, রাজনীতিবিদের 'হাতিয়ার'ও নন; কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি, আমরা অতীতে নাটককে রাজনীতিবিদদের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে দেখেছি। আমরা দেখেছি, নাটককে 'স্বৈরাচারী'র শোবার ঘরে অবলীলায় ঢুকে পড়তে। আমরা দেখেছি, ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিবিদের শারীরিক অক্ষমতা নিয়ে মঞ্চে 'ল্যাম্পুন' করতে।
রাজনীতি নাটকে থাকতেই পারে। রাজনীতি তো সমাজেরই ব্যাপার। তবে রাজনীতি যদি মঞ্চে আসে তবে তা আসবে নাটকেরই প্রয়োজনে। যে নাটক জীবনের কথা বলে, জীবনবোধের কথা বলে। আমার জানা মতে, নাটকের দুঃসময় শুরু হয়েছিল আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে। ঠিক যখন প্রত্যক্ষ এবং দলীয় রাজনীতি নাটকের ওপরে ভর করেছিল।
এ তো গেল রাজনীতির কথা। এ ছাড়াও নাটকের শরীরে বিনোদনের প্রলেপ চড়াতে চড়াতে আমাদের অনেকেই নাটককে এমন জায়গায় নিয়ে গেছি যে, এখন নাটকে সূক্ষ্ম রস বোঝা দর্শকের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। লঘু আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন তো আছেই; কিন্তু তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে আমরা যদি মঞ্চকে 'ইডিয়ট বক্সে' পরিণত করায় উদ্যোগী হই, তাহলে নাটকের কিছু তো অবশিষ্ট থাকবেই না, নাটকও থাকে কি-না সে বিষয়েও আমার সন্দেহ আছে। অবশ্য আমার মনে হয়, মঞ্চনাটকের বন্ধ্যত্ব অতি সম্প্রতি ঘুচতে শুরু করেছে। গুহার শেষ প্রান্তে আলোকচ্ছটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক শিল্পসম্মত নাটক মঞ্চে আসতে শুরু করেছে সম্প্রতি।
উপসংহারে বলতে হয়, কিছু তরুণ নাট্যজনের ঐকান্তিক পরিশ্রম এবং দূরদৃষ্টির ফলে মঞ্চে সুবাতাস বইছে আবার। ঠিক যেমন কিছু উদ্যোগী এবং মেধাবী তরুণের চেষ্টায় নাট্যপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার পরপরই। তখনকার সেই তরুণরা এখন প্রবীণ। তাদের যোগ্য উত্তরসূরিরা আবার শক্ত হাতে ধরেছেন নাটককে, এটা বড় আশার কথা। তবে ধর্মোন্মাদ, সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠী দ্বিগুণ উৎসাহে আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে স্বাধীনতার ঠিক পরে যে অবস্থা ছিল, তার চেয়ে কঠিন সময় উপস্থিত এখন। তাই আজকের তরুণকে অনেক বেশি উদ্যোগী হতে হবে। হতে হবে আরও বেশি প্রত্যয়ী এবং সাহসী।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments