সরল গরল-প্যাকেজ নদী চুক্তি বনাম প্যাকেজ ট্রানজিট by মিজানুর রহমান খান
শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দিয়েই যে সব সমস্যার সুরাহা করা সম্ভব হয় না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ তিস্তা চুক্তি না হওয়া। আরেকটি বড় শিক্ষা, আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে বিশ্বাস বা আশ্বাস কখনো ঠুনকো বলে প্রমাণিত হতে পারে। তাই হাতের প্যাঁচ ছাড়তে নেই। ভারতীয় নিরাপত্তা-উদ্বেগ প্রশমিত করতে বাংলাদেশ অবশ্যই কার্যকর ভূমিকা রেখে যাবে। এটা দর-কষাকষি থেকে দূরেই থাক। কিন্তু তিস্তা তিক্ততার পর বাংলাদেশ কী করবে?
সরকার করিডর বা ট্রানজিটের সঙ্গে তিস্তা চুক্তিকে যুক্ত করেছে। করতে বাধ্য হয়েছে। এখন কি আমরা কোনোমতে তিস্তা চুক্তি পেলেই ট্রানজিট-সংক্রান্ত প্রস্তাবিত সম্মতিপত্র সই করব? একটা সরল প্রশ্নের জবাব দরকার। গ্যারান্টিক্লজবিহীন এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী তিস্তা চুক্তি পাওয়ার জন্য যদি আমাদের ট্রানজিট ও বন্দরগুলো ব্যবহারের প্যাকেজ ভারতকে দিতে হয়, তাহলে অবশিষ্ট নদীর পানি আমরা কিসের বিনিময়ে পাব? গঙ্গা চুক্তি নবায়নের সময় আমরা ভারতকে কী দেব? পানি পাওয়া আমাদের অধিকার, কিন্তু ট্রানজিট বা করিডর ভারতের অধিকার নয়।
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম ভারতকে ট্রানজিট দিতে তিন স্তরবিশিষ্ট একটি পরিকল্পনার কথা বলেছেন। প্রথমে নৌ, পরে রেল, সবশেষে সড়ক। একটি পর্যায়ের যত রকম সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে, তা সর্বোত্তমরূপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নিঃশেষ করেই তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে যেতে হবে। এটাই যৌক্তিক। কিন্তু আমরা বাস্তবে তেমন কিছু অনুসরণের প্রস্তুতি দেখি না।
ভারতের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত একজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম, আপনারা যে সম্মতিপত্র সই করতে যাচ্ছিলেন, তা কি অন্তর্বর্তীকালীন ছিল? তিনি বললেন, যেকোনো পক্ষ নোটিশ দিয়ে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এই শর্ত যদি আমরা পানিচুক্তির শর্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, তাহলে আমরা কী দেখি?
গঙ্গার পানিচুক্তি তিনটি ‘যদি’র ওপর দাঁড়িয়ে। অকাট্য হলো, যদি ফারাক্কা পয়েন্টে পানি গড়িয়ে আসে, তাহলে তার ভাগ পাবে বাংলাদেশ। কখনো না এলে পাবে না। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই গঙ্গা চুক্তির আক্ষরিক লঙ্ঘন ঘটবে না। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সালিস আদালতে যেতে পারবে না। তিস্তা চুক্তির শর্তাদি এর চেয়ে উত্তম কিছু হবে বলে তো মনে করা যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গক্রমে, কয়েক দিন আগে আমি একটি বণিকসভায় বাংলা-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে বললাম, দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট চালু হলে বণিকগোষ্ঠী সরাসরি উপকৃত হবে। কিন্তু তাদের যে প্রভাব আছে, সেটা পানির জন্য ব্যবহার করতে হবে। কথাটা তাদের কতটা মনে ধরেছে, বুঝতে পারিনি। তবে একজন মোক্ষম কথাটা বললেন, শুধু তিস্তা নয়, অন্যান্য নদীকেও প্যাকেজের আওতায় আনার প্রস্তাব কি দেওয়া যায় না? সত্যি বলতে কি, আগে থেকেই বাংলাদেশের সেই অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল। তিস্তার বিনিময়ে করিডর দেওয়ার প্রস্তুতি সঠিক ছিল না। সুতরাং তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় আমরা হাপিত্যেশ করছি ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিক দিক থেকে ভাবলে সেটা শাপে বর হয়েছে।
বাংলাদেশকে এখন নতুন করে পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকেই শুরু করলে চলবে না। দিল্লিতে পররাষ্ট্রসচিবের ঘোষণার পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রসচিব তিস্তা চুক্তি নিয়ে জবরদস্তি আশাবাদের ফানুস সৃষ্টি করেছিলেন। সেই ধারা এখনো চলছে। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের মুখপাত্ররা ভারতের চেয়ে উঁচুগলায় ‘শিগগিরই’ তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের যে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, তা বন্ধ করা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে গিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অস্থায়ী তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাঁর একটি উক্তি অসমীচীন মনে হয়। তিনি বলেছেন, One way or another, we will be able to solve this problem. অর্থাৎ ‘একভাবে কিংবা অন্য উপায়ে আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হব।’ প্রধানমন্ত্রীর এ উক্তির মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর সরকারের যেনতেন হলেও একটা চুক্তি করার মনোভাব লক্ষ করি। কিন্তু তার তো দরকার নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে রয়েছে। চুক্তি না করায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে। এখন সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাস্তবের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ আশাবাদ ভারতকে একটু স্বস্তি দেয়—এ ছাড়া ঢাকার কোনো লাভ থাকার কথা নয়।
উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন নিশ্চিত করা ভারত শাসনের অন্যতম বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে ভারতের সব রকমের স্পর্শকাতরতা জড়িত। সুতরাং অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি প্যাকেজ চুক্তি করা এবং প্রস্তাবিত ট্রানজিট ও করিডর ব্যবহারের সঙ্গে একে সম্পর্কযুক্ত করা অপরিহার্য। এফবিসিসিআই ও এমসিসিআইয়ের মতো সংগঠনগুলোকে এটা বুঝতে হবে। একজন বণিকনেতা আমাকে বলেন, ব্যবসায়ের বাইরে কথা বলা তাঁদের সনদে নেই। তাঁরা বিবেচনায় নেবেন, কেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতায় এসে বণিকনেতাদের সঙ্গে তিস্তা প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁরা আরও মনে রাখবেন, বাংলাদেশ পানির স্বার্থে আপস করে পণ্যে শূন্য শুল্ক ও ট্রানজিট শুল্ক নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে বাঁচতে পারবে না।
পি চিদাম্বরমের কথায় আসি। ২১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় ভারত চেম্বার অব কমার্সে (বিসিসি) চিদাম্বরম বলেন, ‘বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি তিস্তার পানি বণ্টনের মতোই অনিষ্পন্ন থেকে গেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে সময়, ধৈর্য, সমঝোতা ও একই পর্যায়ের রাষ্ট্রনায়কত্ব এসব সমস্যার সুরাহা দেবে।’ তাঁর এ মন্তব্য থেকেও ইঙ্গিত মেলে যে ভারত তিস্তা চুক্তির বিনিময়েই ওই ট্রানজিট-সুবিধা আশা করছে; এবং বাংলাদেশেও গণমাধ্যমের প্রচারণা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, যাতে কোনোমতে একটা তিস্তা চুক্তি পেলেই তখন নৌ, রেল, সড়ক ও সমুদ্রবন্দর একবারে দেওয়া জায়েজ হয়ে যাবে। কিন্তু এটা হবে আত্মঘাতী। ভিনদেশে বিশাল বাণিজ্যের মওকা সব সময়ই প্রহেলিকা। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বহুমুখী ট্রানজিট বা করিডর চালু হলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের বর্তমান বাজারও কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে।
দুই দেশের মধ্যকার অচিহ্নিত সমস্যা, যা চিদাম্বরমের ভাষায় ‘আনডিমারকেটেড প্রভিন্সেস’, কীভাবে ভবিষ্যতে সুরাহা হবে, তার উপায় বাতলেছেন চিদাম্বরম। কলকাতার ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলা তাঁর ফর্মুলাটি হলো, ‘জাস্ট এ লিটল গিভ অ্যান্ড জাস্ট এ লিটল টেক।’ এটাই আসলে আন্তরাষ্ট্র দূতিয়ালির সর্বজনীন ও টেকসই মন্ত্র। তাই বাংলাদেশকেও ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ মানতে হবে। যেকোনো মূল্যে তিস্তা চুক্তির কোনো মানে নেই। মমতা-মৈত্রী কাজ দেবে না; বরং চিদাম্বরম-মন্ত্র মেনেই ট্রানজিটের সঙ্গে নদীর প্যাকেজ চুক্তি করুন।
তিস্তার পানি ভাগাভাগির প্রশ্নে এর আগের লেখায় যা বলেছিলাম, তা এরই মধ্যে ফলতে শুরু করেছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের পর সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীও এখন মমতার পাশে। ভূমিকম্প-দুর্গত সিকিমে গিয়ে মমতা সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা ২২ সেপ্টেম্বর লিখেছে, চামলিং মমতাকে বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান প্রকারান্তরে সিকিমকেও বাঁচিয়ে দিয়েছে।’ বামফ্রন্ট ২৫ শতাংশ পানি দিতে চেয়েছিল, মমতা এখন তা-ও দিতে পারবেন না বলে মত দিচ্ছেন। সত্যিই তো, পানি না থাকলে ২৫ শতাংশ কেন, ৫ শতাংশই বা আসবে কোথা থেকে!
বাংলাদেশকে তিস্তার ন্যায্য হিস্যাই পেতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ভাটির অববাহিকার একটি দেশ হিসেবে যা তার প্রাপ্য, তা-ই তাকে নিতে হবে। উজানের মানুষ পানির ন্যায্য হিস্যা পাবে না। ন্যায্য হিস্যা পাবে শুধু বাংলাদেশের মানুষ, সেটা তো হয় না। তবে ভারতের জন্য ন্যায্য কী, সেটাই বিচার্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বলছেন, ‘তিস্তায় এমনিতেই এখন জল নেই। তার ওপর সিকিমে জলসেচ ও জলবিদ্যুতের জন্য নদীর ওপরে দুটি বড় বাঁধ তৈরি হচ্ছে। সেই বাঁধ তৈরি হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গে জল সরবরাহ আরও কমে যাবে। সুতরাং সব দিক খতিয়ে না দেখে চুক্তি করা উচিত নয়।’ (২২ সেপ্টেম্বর, আনন্দবাজার)
এর আগে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী চামলিং বলেন, তিস্তার পানি দিয়ে মোট ২৭টি বিদ্যুৎ প্রকল্প (এর মধ্যে তিনটিই দেবে দেড় হাজার মেগাওয়াট) বাস্তবায়নে তিনি আপস করবেন না। অবশ্য গত সপ্তাহে যে ভূমিকম্পে বাংলাদেশও কাঁপল, তার ‘হেতু ও ব্যাপকতার’ জন্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা আঙুল তুলেছেন তিস্তার ওপর নির্মিত বাঁধের দিকেই। ২১ সেপ্টেম্বর হিন্দুস্তান টাইমস আরও জানাচ্ছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মহাপরিকল্পনায় ভবিষ্যতে উত্তর-পূর্ব ভারতে ১৬৮টি বাঁধ (আমরা শুধু টিপাইমুখে ভরসা পেয়েছি) তৈরির কথা আছে। সে কারণেই বলি, বাংলাদেশ যদি তার মাথার চুল না ছিঁড়তে চায়, তাহলে তাকে অবশিষ্ট নদীর সঙ্গে ট্রানজিটের প্যাকেজ এখনই যুক্ত করতে হবে।
উভয় দেশ একান্তই সমঝোতায় আসতে না পারলে সালিস আদালতের বিকল্পও মাথায় রাখতে হবে। সাগরের পানি ভাগে তো কোনো মমতার অমমতা ছিল না। তদুপরি বন্ধুত্ব নিয়েই কিন্তু বাংলাদেশকে সালিস মানতে হয়েছে। ভারত যে এটাকে সুনজরে দেখছে, এটাও দৃশ্যত একটা অর্জন।
বাংলাদেশকে হিস্যা না দিয়েই তিস্তা কীভাবে শুকিয়ে গেল, সে তথ্য দিদির বিলক্ষণ জানার কথা। সেটা প্রকাশ না করে দিদির শর্তে বাংলাদেশের কাছে নতুন করে দিল্লির তিস্তার পানির তথ্য চাওয়া কিন্তু আমাদের কাছে ভীষণ গোলমেলে মনে হয়। ১৯৮৩ সালের তিস্তা-সমঝোতা এ ধরনের তথ্যবিনিময় নিয়েই ভেস্তে গিয়েছিল।
তিস্তা নিয়ে কালিকা পুরাণের গল্প দিয়ে শেষ করি। তিস্তা মানে তৃষ্ণা। হিমালয়দুহিতা। ভগবান শিব অপদেবতাদের কঠিন অনুশোচনায় সন্তুষ্ট হলেন; বর দিলেন। কিন্তু শিবের অনুরাগী এক অপদেবতার অপছন্দ ছিলেন দেবী পার্বতী। পার্বতী শিবের স্ত্রী। রুষ্ট পার্বতীর সঙ্গে যুদ্ধ হলো অপদেবতার। আহত হলেন অপদেব। রণক্ষেত্রে হলেন তৃষ্ণার্ত। শিবের কাছে তৃষ্ণা নিবারণে আকুতি জানালেন। মন গলল শিবের। তিনি সৃষ্টি করলেন এক অপূর্ব ঝরনাধারার, প্রাচীন গ্রিক গল্পের পুষ্পমধুর মতোই সে পানীয়ের স্বাদ দুধালো। সেই ঝরনার উৎস কিনা পার্বতীর স্তন! সেই ঝরনাই আজকের তিস্তা।
তিস্তা সূত্রে বাংলাদেশ যদি তার ট্রানজিটনীতি বদলায়, সেটা বিরাট বাঁক নেবে। তবে তা নিশ্চয়ই পুরাণের ওই বৈপরীত্য, বৈচিত্র্য ও বিস্ময়কে হার মানাবে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম ভারতকে ট্রানজিট দিতে তিন স্তরবিশিষ্ট একটি পরিকল্পনার কথা বলেছেন। প্রথমে নৌ, পরে রেল, সবশেষে সড়ক। একটি পর্যায়ের যত রকম সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে, তা সর্বোত্তমরূপে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নিঃশেষ করেই তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে যেতে হবে। এটাই যৌক্তিক। কিন্তু আমরা বাস্তবে তেমন কিছু অনুসরণের প্রস্তুতি দেখি না।
ভারতের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত একজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলাম, আপনারা যে সম্মতিপত্র সই করতে যাচ্ছিলেন, তা কি অন্তর্বর্তীকালীন ছিল? তিনি বললেন, যেকোনো পক্ষ নোটিশ দিয়ে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এই শর্ত যদি আমরা পানিচুক্তির শর্তের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, তাহলে আমরা কী দেখি?
গঙ্গার পানিচুক্তি তিনটি ‘যদি’র ওপর দাঁড়িয়ে। অকাট্য হলো, যদি ফারাক্কা পয়েন্টে পানি গড়িয়ে আসে, তাহলে তার ভাগ পাবে বাংলাদেশ। কখনো না এলে পাবে না। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই গঙ্গা চুক্তির আক্ষরিক লঙ্ঘন ঘটবে না। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সালিস আদালতে যেতে পারবে না। তিস্তা চুক্তির শর্তাদি এর চেয়ে উত্তম কিছু হবে বলে তো মনে করা যাচ্ছে না।
প্রসঙ্গক্রমে, কয়েক দিন আগে আমি একটি বণিকসভায় বাংলা-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে বললাম, দুই দেশের মধ্যে ট্রানজিট চালু হলে বণিকগোষ্ঠী সরাসরি উপকৃত হবে। কিন্তু তাদের যে প্রভাব আছে, সেটা পানির জন্য ব্যবহার করতে হবে। কথাটা তাদের কতটা মনে ধরেছে, বুঝতে পারিনি। তবে একজন মোক্ষম কথাটা বললেন, শুধু তিস্তা নয়, অন্যান্য নদীকেও প্যাকেজের আওতায় আনার প্রস্তাব কি দেওয়া যায় না? সত্যি বলতে কি, আগে থেকেই বাংলাদেশের সেই অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল। তিস্তার বিনিময়ে করিডর দেওয়ার প্রস্তুতি সঠিক ছিল না। সুতরাং তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় আমরা হাপিত্যেশ করছি ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিক দিক থেকে ভাবলে সেটা শাপে বর হয়েছে।
বাংলাদেশকে এখন নতুন করে পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকেই শুরু করলে চলবে না। দিল্লিতে পররাষ্ট্রসচিবের ঘোষণার পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রসচিব তিস্তা চুক্তি নিয়ে জবরদস্তি আশাবাদের ফানুস সৃষ্টি করেছিলেন। সেই ধারা এখনো চলছে। এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের মুখপাত্ররা ভারতের চেয়ে উঁচুগলায় ‘শিগগিরই’ তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের যে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, তা বন্ধ করা দরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে গিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অস্থায়ী তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কিন্তু তাঁর একটি উক্তি অসমীচীন মনে হয়। তিনি বলেছেন, One way or another, we will be able to solve this problem. অর্থাৎ ‘একভাবে কিংবা অন্য উপায়ে আমরা এ সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হব।’ প্রধানমন্ত্রীর এ উক্তির মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর সরকারের যেনতেন হলেও একটা চুক্তি করার মনোভাব লক্ষ করি। কিন্তু তার তো দরকার নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশের জনগণ নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে রয়েছে। চুক্তি না করায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ভাবমূর্তি ম্লান হয়েছে। এখন সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাস্তবের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ আশাবাদ ভারতকে একটু স্বস্তি দেয়—এ ছাড়া ঢাকার কোনো লাভ থাকার কথা নয়।
উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন নিশ্চিত করা ভারত শাসনের অন্যতম বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে ভারতের সব রকমের স্পর্শকাতরতা জড়িত। সুতরাং অভিন্ন নদীর পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি প্যাকেজ চুক্তি করা এবং প্রস্তাবিত ট্রানজিট ও করিডর ব্যবহারের সঙ্গে একে সম্পর্কযুক্ত করা অপরিহার্য। এফবিসিসিআই ও এমসিসিআইয়ের মতো সংগঠনগুলোকে এটা বুঝতে হবে। একজন বণিকনেতা আমাকে বলেন, ব্যবসায়ের বাইরে কথা বলা তাঁদের সনদে নেই। তাঁরা বিবেচনায় নেবেন, কেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতায় এসে বণিকনেতাদের সঙ্গে তিস্তা প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করেন। তাঁরা আরও মনে রাখবেন, বাংলাদেশ পানির স্বার্থে আপস করে পণ্যে শূন্য শুল্ক ও ট্রানজিট শুল্ক নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে বাঁচতে পারবে না।
পি চিদাম্বরমের কথায় আসি। ২১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় ভারত চেম্বার অব কমার্সে (বিসিসি) চিদাম্বরম বলেন, ‘বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি তিস্তার পানি বণ্টনের মতোই অনিষ্পন্ন থেকে গেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে সময়, ধৈর্য, সমঝোতা ও একই পর্যায়ের রাষ্ট্রনায়কত্ব এসব সমস্যার সুরাহা দেবে।’ তাঁর এ মন্তব্য থেকেও ইঙ্গিত মেলে যে ভারত তিস্তা চুক্তির বিনিময়েই ওই ট্রানজিট-সুবিধা আশা করছে; এবং বাংলাদেশেও গণমাধ্যমের প্রচারণা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, যাতে কোনোমতে একটা তিস্তা চুক্তি পেলেই তখন নৌ, রেল, সড়ক ও সমুদ্রবন্দর একবারে দেওয়া জায়েজ হয়ে যাবে। কিন্তু এটা হবে আত্মঘাতী। ভিনদেশে বিশাল বাণিজ্যের মওকা সব সময়ই প্রহেলিকা। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বহুমুখী ট্রানজিট বা করিডর চালু হলে উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের বর্তমান বাজারও কিন্তু তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়বে।
দুই দেশের মধ্যকার অচিহ্নিত সমস্যা, যা চিদাম্বরমের ভাষায় ‘আনডিমারকেটেড প্রভিন্সেস’, কীভাবে ভবিষ্যতে সুরাহা হবে, তার উপায় বাতলেছেন চিদাম্বরম। কলকাতার ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলা তাঁর ফর্মুলাটি হলো, ‘জাস্ট এ লিটল গিভ অ্যান্ড জাস্ট এ লিটল টেক।’ এটাই আসলে আন্তরাষ্ট্র দূতিয়ালির সর্বজনীন ও টেকসই মন্ত্র। তাই বাংলাদেশকেও ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ মানতে হবে। যেকোনো মূল্যে তিস্তা চুক্তির কোনো মানে নেই। মমতা-মৈত্রী কাজ দেবে না; বরং চিদাম্বরম-মন্ত্র মেনেই ট্রানজিটের সঙ্গে নদীর প্যাকেজ চুক্তি করুন।
তিস্তার পানি ভাগাভাগির প্রশ্নে এর আগের লেখায় যা বলেছিলাম, তা এরই মধ্যে ফলতে শুরু করেছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমারের পর সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীও এখন মমতার পাশে। ভূমিকম্প-দুর্গত সিকিমে গিয়ে মমতা সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা ২২ সেপ্টেম্বর লিখেছে, চামলিং মমতাকে বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান প্রকারান্তরে সিকিমকেও বাঁচিয়ে দিয়েছে।’ বামফ্রন্ট ২৫ শতাংশ পানি দিতে চেয়েছিল, মমতা এখন তা-ও দিতে পারবেন না বলে মত দিচ্ছেন। সত্যিই তো, পানি না থাকলে ২৫ শতাংশ কেন, ৫ শতাংশই বা আসবে কোথা থেকে!
বাংলাদেশকে তিস্তার ন্যায্য হিস্যাই পেতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ভাটির অববাহিকার একটি দেশ হিসেবে যা তার প্রাপ্য, তা-ই তাকে নিতে হবে। উজানের মানুষ পানির ন্যায্য হিস্যা পাবে না। ন্যায্য হিস্যা পাবে শুধু বাংলাদেশের মানুষ, সেটা তো হয় না। তবে ভারতের জন্য ন্যায্য কী, সেটাই বিচার্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বলছেন, ‘তিস্তায় এমনিতেই এখন জল নেই। তার ওপর সিকিমে জলসেচ ও জলবিদ্যুতের জন্য নদীর ওপরে দুটি বড় বাঁধ তৈরি হচ্ছে। সেই বাঁধ তৈরি হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গে জল সরবরাহ আরও কমে যাবে। সুতরাং সব দিক খতিয়ে না দেখে চুক্তি করা উচিত নয়।’ (২২ সেপ্টেম্বর, আনন্দবাজার)
এর আগে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী চামলিং বলেন, তিস্তার পানি দিয়ে মোট ২৭টি বিদ্যুৎ প্রকল্প (এর মধ্যে তিনটিই দেবে দেড় হাজার মেগাওয়াট) বাস্তবায়নে তিনি আপস করবেন না। অবশ্য গত সপ্তাহে যে ভূমিকম্পে বাংলাদেশও কাঁপল, তার ‘হেতু ও ব্যাপকতার’ জন্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা আঙুল তুলেছেন তিস্তার ওপর নির্মিত বাঁধের দিকেই। ২১ সেপ্টেম্বর হিন্দুস্তান টাইমস আরও জানাচ্ছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মহাপরিকল্পনায় ভবিষ্যতে উত্তর-পূর্ব ভারতে ১৬৮টি বাঁধ (আমরা শুধু টিপাইমুখে ভরসা পেয়েছি) তৈরির কথা আছে। সে কারণেই বলি, বাংলাদেশ যদি তার মাথার চুল না ছিঁড়তে চায়, তাহলে তাকে অবশিষ্ট নদীর সঙ্গে ট্রানজিটের প্যাকেজ এখনই যুক্ত করতে হবে।
উভয় দেশ একান্তই সমঝোতায় আসতে না পারলে সালিস আদালতের বিকল্পও মাথায় রাখতে হবে। সাগরের পানি ভাগে তো কোনো মমতার অমমতা ছিল না। তদুপরি বন্ধুত্ব নিয়েই কিন্তু বাংলাদেশকে সালিস মানতে হয়েছে। ভারত যে এটাকে সুনজরে দেখছে, এটাও দৃশ্যত একটা অর্জন।
বাংলাদেশকে হিস্যা না দিয়েই তিস্তা কীভাবে শুকিয়ে গেল, সে তথ্য দিদির বিলক্ষণ জানার কথা। সেটা প্রকাশ না করে দিদির শর্তে বাংলাদেশের কাছে নতুন করে দিল্লির তিস্তার পানির তথ্য চাওয়া কিন্তু আমাদের কাছে ভীষণ গোলমেলে মনে হয়। ১৯৮৩ সালের তিস্তা-সমঝোতা এ ধরনের তথ্যবিনিময় নিয়েই ভেস্তে গিয়েছিল।
তিস্তা নিয়ে কালিকা পুরাণের গল্প দিয়ে শেষ করি। তিস্তা মানে তৃষ্ণা। হিমালয়দুহিতা। ভগবান শিব অপদেবতাদের কঠিন অনুশোচনায় সন্তুষ্ট হলেন; বর দিলেন। কিন্তু শিবের অনুরাগী এক অপদেবতার অপছন্দ ছিলেন দেবী পার্বতী। পার্বতী শিবের স্ত্রী। রুষ্ট পার্বতীর সঙ্গে যুদ্ধ হলো অপদেবতার। আহত হলেন অপদেব। রণক্ষেত্রে হলেন তৃষ্ণার্ত। শিবের কাছে তৃষ্ণা নিবারণে আকুতি জানালেন। মন গলল শিবের। তিনি সৃষ্টি করলেন এক অপূর্ব ঝরনাধারার, প্রাচীন গ্রিক গল্পের পুষ্পমধুর মতোই সে পানীয়ের স্বাদ দুধালো। সেই ঝরনার উৎস কিনা পার্বতীর স্তন! সেই ঝরনাই আজকের তিস্তা।
তিস্তা সূত্রে বাংলাদেশ যদি তার ট্রানজিটনীতি বদলায়, সেটা বিরাট বাঁক নেবে। তবে তা নিশ্চয়ই পুরাণের ওই বৈপরীত্য, বৈচিত্র্য ও বিস্ময়কে হার মানাবে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments