প্রিন্স চার্লস ও আমাদের ইলিশ by শেখ রোকন

বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স চার্লসের ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার হিসেবে ডায়ানা-ক্যামিলা কাণ্ড যতটা প্রকাশ্য, প্রকৃতি নিয়ে তার আগ্রহ যেন ততটাই আড়ালে। অথচ আশির দশক থেকে তিনি পরিবেশ-প্রতিবেশ, বিশেষ করে প্রকৃতিবান্ধব উৎপাদন নিয়ে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন।


নব্বইয়ের দশকে সূচিত তার অর্গানিক ফার্ম 'ডাচি অরিজিনালস' এখন আকার ও খ্যাতিতে অনেক বড়। ২০০৮ সালে এর মুনাফা ৬০ লাখ পাউন্ড ছাড়িয়েছিল। খাদ্য ঘাটতির দেশে কে আর খবর রাখতে যায় যে, কোন খাবার অর্গানিক আর কোনটি সংকর! অস্বীকার করা যাবে না, হাজারো প্রজাতির শস্যদানা, মৎস্যসম্পদ আর গবাদি পশুপাখির স্বর্গভূমি এ দেশ যখন 'সবুজ বিপ্লব'-এর তোড়ে ভেসে যেতে বসেছিল; কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যের আধার এ দেশ যখন জিএমও উদ্ভাবক বহুজাতিক কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাময় বাজারে পরিণত হতে যাচ্ছিল; তখন কেউ কেউ অর্গানিক খাদ্যের কথা বলেছেন। এ নিয়ে সভা-সেমিনারও হয়েছে। কিন্তু ২০০৭-০৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন হুমকিতে পড়ার পর, তা থিতু হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে সরকার বহুল আলোচিত 'গোল্ডেন রাইস' নিয়ে সবুজ (!) সংকেত দিলেও প্রতিবাদ চোখে পড়েনি।
চার্লস অবশ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। যত দিন যাচ্ছে, তার পরিচালিত দাতব্য উদ্যোগগুলোর সবুজ রঙ গাঢ় হচ্ছে। নিজেও গত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনসহ বৈশ্বিক পরিবেশ ইস্যুগুলোতে সোচ্চার হচ্ছেন। ২০০৮ সালে 'জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' শুরুর যে আহ্বান তিনি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে জানিয়েছেন, তা এখনও আলোচিত। কেবল নিজের দেশ বা ইউরো নয়, গোটা পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রাকৃতিক উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন ব্রিটিশ যুবরাজ। ওই প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে তার প্রতিষ্ঠিত দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল সাসটেইনেবিলিটি ইউনিট (আইএসইউ) পৃথিবীর মৎস্য সম্পদ নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে।
অনেকে জানেন, খাদ্য ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ এই খাত নিয়ে এক দশক ধরে কেবল দুঃসংবাদই পাওয়া যাচ্ছে। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) ইতিমধ্যে জানিয়েছে যে, অতিরিক্ত আহরণের কারণে বিশ্ব মৎস্য ভাণ্ডারের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যেই শূন্য হয়ে পড়েছে কিংবা শূন্য হওয়ার পথে। বলাবাহুল্য, ফাও-এর এই প্রতিবেদনের সত্যতা আমাদের চারপাশেই উপস্থিত। মাত্র দুই দশক আগেও নদী-নালা, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-ডোবায় যে পরিমাণ মাছ মিলত, তা এখন গল্পের মতো।
এই প্রেক্ষাপটে প্রিন্স চার্লস আইএসইউর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করতে গিয়ে এ মাসের গোড়ার দিকে লন্ডনের ফিসমঙ্গার'র হলে দাঁড়িয়ে মৎস্য খাতের জন্য সুসংবাদ উচ্চারণ করেছেন। আইএসইউ বিশ্বজুড়ে ৫০টি টেকসই ব্যবস্থাপনামূলক মৎস্যক্ষেত্র যাচাই করে দেখেছে, উন্নত ব্যবস্থাপনাই হচ্ছে ক্রমহ্রাসমান মৎস্যসম্পদের জবাব। ওই সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাময়িক মুনাফার জন্য অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন ও আহরণের নীতি মৎস্যসম্পদের দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করে। কে না জানে, বাংলাদেশে মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনার তো এখন এটাই মূলধারা! কিন্তু চার্লসের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ সেখানেই শেষ নয়।
আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ উৎপাদন এলাকার উদাহরণ দিয়ে আইএসইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি এটা সতর্কতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয়, কেবল এখান থেকেই বছরে ২৬০ মিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব। এটা ঠিক, সরকার ইতিমধ্যে জাটকা রক্ষা কর্মসূচি নিয়েছে। কিন্তু কেবল জাটকা রক্ষার নামে নিরীহ জেলেদের ওপর খৰহস্ত হলেই কি সেটাকে টেকসই ব্যবস্থাপনা বলে? নাকি বিপুল ওই আয় সম্ভব?
ফাঁক হচ্ছে, একদিকে যেমন জাটকা ধরা বন্ধ করা হয়েছে, অন্যদিকে চলছে নদী দূষণ। চলছে নির্বিচার নৌযান চলাচল। কী করলে মৎস্য সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা সম্ভব, ব্রিটিশ কর্তার প্রতিষ্ঠান তাও নির্দেশ করেছে। আমাদের কর্তারা কষ্ট করে দেখে
নিতে পারেন।
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.