সদরে অন্দরে-কলাপসিবল গেটে মুক্তিযোদ্ধার হাত by মোস্তফা হোসেইন

কলাপসিবল গেটের সামনে একটি হাত। চেহারায় আঁকুতি। ভেতর থেকে কিছু আসবে, এমনই প্রত্যাশা তাঁর। খট খট বুটের শব্দ করে একজন এসে ভ্রু কুঁচকে বলল, এখন যান, পরে আসবেন। যেন ভিক্ষুক বিদায় করার মতোই বাড়ির মালিক ভেতর থেকে বলে দিল।


বড় দুর্ভাগ্য আমাদের। এই কলাপসিবল গেটটি কোনো বাড়ির মালিকের নয়। এটি সরকারি দপ্তর_মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। আর যিনি ভিক্ষুকের মতো আচরণ পেলেন, তাঁকে বলা হয় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান_মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা একাত্তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য। আর যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে আপ্যায়ন (!) করলেন তিনি এই স্বাধীন দেশের একজন সরকারি কর্মকর্তা। দেশ স্বাধীন না হলে, পাকিস্তান থাকলে, যাঁর পক্ষে কেরানির ওপরে ওঠার ভাগ্য হয়তো না-ও হতে পারত।
স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে ক্ষমতায়। সংগত কারণেই তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মান ও শ্রদ্ধা আশা করতে পারেন। কিন্তু এই কি শ্রদ্ধার নমুনা? একজন মুক্তিযোদ্ধা এ শ্রদ্ধা (!) কতবার পাবেন একটি সাধারণ কাজের জন্য? ঢাকার বাড্ডা থানার একজন মুক্তিযোদ্ধা ক্ষোভ প্রকাশ করলেন_এভাবে গলাধাক্কা না দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যদি একটা বুলেট দিয়ে সারা জীবনের প্রাপ্যটা মিটিয়ে দেওয়া হতো তাহলেই বোধ হয় ভালো হতো। ভৈরবের এক নারী মুক্তিযোদ্ধা বললেন, সম্মানবোধ বলতে কি তাদের মধ্যে একবারেই কিছু নেই? নিরাপত্তার কথা বলাতেই তিনি আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁর কথা_একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য অফিসের বারান্দায় একটা বেঞ্চের ব্যবস্থাও করা যায় না? এভাবে বাইরে ভিক্ষুকের মতো না দাঁড়িয়ে থেকে তারা অন্তত নিজেদের অপাঙ্ক্তেয় ভাবা থেকে মুক্তি পেতেন।
কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলার মো. আখতার হোসেন বারবার ধরনা দিয়েও যখন কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা সনদটি পাননি তখন তিনি পত্রিকায় চিঠি লিখে পাঠিয়েছেন। তাঁর ভরসা, এতে যদি কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়ে। তিনি দেড় বছর ধরে ওই কলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আবেদন জানিয়েছেন_ভাই, আমার সার্টিফিকেটটা কি হয়েছে? গেজেট বিজ্ঞপ্তির কপিসহ তিনি সনদপ্রাপ্তির জন্য দরখাস্ত করেছেন ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে। তারপর বারবার তাঁকে সেই কলাপসিবল গেটে গিয়ে আবদার জানাতে হয়েছে। আবেদন জানাতে হয়েছে, 'ভাই আমার সনদটা কি পাব?' ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তাঁকে সেই একই জবাব শুনতে হচ্ছে। তাঁকে বলা হচ্ছে, 'সার্টিফিকেটটি প্রক্রিয়াধীন আছে, আপনি পরে আসেন।' তাঁকে অনুরোধ করতে হয়েছে, কত তারিখে আসব একটু লিখে দেবেন কি দয়া করে? সেই জবাবও লিখিতভাবেই পেয়েছেন। সম্ভাব্য তারিখ তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই তারিখে গেলে আবার আরেকটি তারিখ।
ষাটোর্ধ্ব বয়সের একজন মানুষ ঢাকার গাড়ির জট পেরিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে যদি এ ধরনের হয়রানির মুখে পড়েন তাহলে সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, এই কি তাহলে জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তানের প্রাপ্তি জাতির কাছ থেকে? মোহাম্মদ আখতার হোসেনের মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আজকে এমন আচরণের শিকার। সনদপ্রাপ্তি থেকে বাদ পড়া মুক্তিযোদ্ধাদের আবারও সনদ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগ দেরিতে হলেও অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে তা বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। যদি এই সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে মনে হয় অনেক মানুষ সনদ পাবেন, যাঁরা হয়তো একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শত্রুর বুলেট কিংবা মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন। এমনও যুদ্ধাহত মানুষ এখনো আছেন, যাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বরণ করে নিতে পারলে জাতি হিসেবে গৌরব বোধ করতে পারি আমরা। এমন একাধিক নিরীহ যোদ্ধাহত মানুষের কথা এ মুহূর্তে মনে আসে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বড়ধুশিয়া গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে আবদুল হালিম নামে একজন যুদ্ধাহত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল বছর কয়েক আগে। একইভাবে দেখা হয়েছিল বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের জোবেদ আলীর সঙ্গে। দুজনই ছিলেন একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সহযোগী। গুলির বাঙ্ কাঁধে করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধকালে দুজনই পা হারিয়েছেন। আবদুল হালিম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে একটি কৃত্রিম পা পেয়েছিলেন। ১৫-১৬ বছর পর্যন্ত সেই পা দিয়ে চলাচল করেছেন তিনি। কৃত্রিম পা-টি একসময় ভেঙে গেলে সেই ভাঙা পায়ের অংশবিশেষ তিনি বালিশের পাশে রেখে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি হিসেবে। দুজনকেই হতদরিদ্র বললেও কম বলা হবে। দুজনই নিরক্ষর। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁদের নাম তালিকাভুক্ত হতে পারে, এমন চিন্তাও তাঁরা করতে পারেন না। কিংবা তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য যে আবেদন করার সুযোগ আছে সে কথাও তাঁরা কোনো দিন জানবেন না। এটাই বাস্তবতা। আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলো কালিকাপুর গ্রামে। তিনি নিজে জানেন না তিনি মুক্তিযোদ্ধা। বরং পাল্টা প্রশ্ন করেন, আমি তো যুদ্ধ করি নাই। আমি ইয়ুথ ক্যাম্পের মসজিদে নামাজের ইমামতি করেছি মাত্র। আমি কি মুক্তিযোদ্ধা
হতে পারি?
কালিকাপুরের জোবেদ আলী পাশের গ্রামের জামতলী দোকানের সামনে বসে থাকেন বাঁশের লাঠি নিয়ে। কেউ যদি দুই-চার টাকা ধরিয়ে দেন তাই দিয়ে চলে তাঁর সংসার। তাঁর একটি মেয়ে যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় বিষ খেয়ে জীবন দিয়েছে। আরেকটি মেয়েও আত্মহত্যা করেছে যৌতুকেরই পরোক্ষ কারণে। জোবেদ আলীও গুলি বয়ে এনেছেন দেশের ভেতরে। কিন্তু তিনি কি জানেন, তিনিও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন? যেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যে ব্যক্তি রান্না করে খাইয়েছেন তিনিও মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার দাবি করতে পারেন। নতুন তালিকায় এমন মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ এসেছে।
কথা হচ্ছে, সেই তালিকা যথার্থ করতে হলে যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি করতে হবে সুচারুরূপে। ফাঁকে যাতে অমুক্তিযোদ্ধা কেউ ঢুকে যেতে না পারে তার দায় নিতে হবে যাচাইকারীদের। সততা থাকলে সেই কাজটি হতে পারবে না। অন্তত এটুকু প্রত্যাশা করছেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের পাহাড়সমান সম্পদ প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রয়োজন আছে মুক্তির সৈনিক হিসেবে সামান্য সম্মান। এটুকু কি নিশ্চিত করবে না রাষ্ট্র?
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.