জাতীয় নির্বাচন-ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে! by বদিউল আলম মজুমদার
জি এলিয়ট জেনেটের একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘আমরা যে ইতিহাস জানি তার সাধারণত পুনরাবৃত্তি ঘটে।’ কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি যেন আবশ্যম্ভাবী সত্য। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর গত এক দশকের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালেই এ বক্তব্যের সত্যতা মিলবে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে গৃহীত সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর কথা অনেকেরই স্মরণ আছে। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ করা হয়। বয়স বৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তের পেছনে মূলত কাজ করেছে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান কে হবেন সে বিষয়ে হিসাব-নিকাশ। সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে, যিনি একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, প্রধান উপদেষ্টা করাই ছিল এ সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য।
পরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। চারদলীয় জোটের অপচেষ্টা সফল হয়নি। মহাজোটের প্রবল আন্দোলন এবং চারদলীয় জোট সরকারের সব অপকর্মের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে বিচারপতি কে এম হাসান সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিজ নাম প্রত্যাহার করে নেন। চারদলীয় জোট এতে হাল না ছেড়ে, সাংবিধানিক পদ্ধতি পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টা হওয়া নিশ্চিত করে। ড. ইয়াজউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের সিদ্ধান্তের আদালতের চ্যালেঞ্জ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের হস্তক্ষেপে ভন্ডুল হয়ে যায়।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলের এসব কারসাজি এবং আরও কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে আমাদের পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অবশেষে ভেঙে পড়ে এবং সৃষ্টি হয় এক-এগারোর। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের কিছু বাড়াবাড়ির কারণে দুই নেত্রী এখন সর্বক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা, উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী যার উদ্যোক্তা ছিলেন মূলত তাঁদের দলীয় সহকর্মীরা, পরবর্তী সময়ে প্লাস-প্লাসে পরিণত হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে অনৈতিক খেলার দিক থেকে বর্তমান সরকার চারদলীয় জোট সরকারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। তারা পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাদ দিয়ে দিয়েছে, যাতে পরবর্তী নির্বাচনের সময় নিজেরাই ক্ষমতায় থাকে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অজুহাতে, যদিও পূর্ণ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। এ ছাড়া আদালতের রায়ে ভবিষ্যতের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপরন্তু আদালতের পর্যবেক্ষণে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগামী দুই টার্মের জন্য বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে দলীয় সরকারের অধীনে স্বাধীন বাংলাদেশে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার কোনোটাই নিরপেক্ষ হয়নি, যার ফলে ক্ষমতাসীন দলই সব সময় নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। পক্ষান্তরে গত তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সবগুলোতেই ক্ষমতাসীনেরা হেরেছে। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী দল ক্রমাগতভাবে অধিকসংখ্যক আসন নিয়ে জয় লাভ করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যত আসন নিয়ে বিজয়ী হয়েছিল, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট তার চেয়ে বেশি এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে মহাজোট আরও অনেক বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল। অর্থাৎ ভোটাররা ক্রমাগতভাবে আরও জোরালোভাবে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
আমাদের আশঙ্কা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভবিষ্যতে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কারণ চরম পক্ষপাতদুষ্ট ও ফায়দাপুষ্ট প্রশাসন তাদের নিজেদের স্বার্থেই, অবৈধ কর্মের শাস্তি এড়াতে এবং অন্যায় সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখতে, ক্ষমতাসীন সরকারের বিজয় নিশ্চিত করবে। এর জন্য ক্ষমতাসীনদের ইশারারও প্রয়োজন পড়বে না।
আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কারণে বিএনপি ও তার শরিকেরা ইতিমধ্যেই আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে। তাই আগামী নির্বাচন হবে একদলীয় বা একজোটীয় অথবা এরশাদ ও বিএনপির দলছুটদের নিয়ে গঠিত পাতানো বিরোধী দলকে নিয়ে, যা দেশি-বিদেশি কোনো মহলেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে খেলা মঞ্চস্থ হয়েছে তার নগ্নতম প্রতিফলন দেখা যায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্লজ্জ ডিগবাজিতে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনেরই ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সে আন্দোলনের সময় বিএনপি ছিল এর ঘোর বিরোধী। এখন জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য দলগুলোর অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। ক্ষমতার লোভে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যেকোনো অবস্থান নিতে দ্বিধাহীন।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের নিরপেক্ষতার সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণও নয়। তবু প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণ এবং রাজনৈতিক দল ও তাদের প্রার্থীদের অসদাচরণের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। তাই আমরা আগামী দু্ই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পক্ষে। আমাদের প্রত্যাশা যে এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যথাযথ পরিবর্তন ঘটাবে, যাতে পরবর্তী নির্বাচনগুলো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। চারদলীয় জোট সরকার নির্বাচন কমিশনকে নিয়েও ভয়াবহ অনৈতিক খেলা খেলেছে। তারা গোটা কমিশনকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিণতিও আমরা জানি। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশনের সব সদস্যকেই অমর্যাদাকরভাবে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার ঘোষণা দিলেও কমিশনকে নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সময় সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে কমিশনের ব্যয়কে সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত করা হয়নি। কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষা করে কমিশনের সদস্যসংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচে উন্নীত করা হয়েছে। সর্বোপরি, কয়েক মাস আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় কমিশন যে কটি আইনের খসড়া উত্থাপন করেছে, সেগুলো সম্পর্কে দলের প্রতিনিধিরা সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করেছে এবং কমিশনকে পরবর্তী সময়ে দলের মতামত প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে, যা এখনো ঘটেনি।
কমিশন প্রস্তাবিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো, কমিশনে নিয়োগ প্রদানসংক্রান্ত। কমিশন একটি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের সুপারিশ করে, যাতে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিরা কমিশনে নিয়োগ পান। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কোনো মতামত তো দেয়ইনি, বরং গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী সরকার আরও দুজন নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে (যায়যায়দিন, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১), যে উদ্যোগ সম্পর্কে কমিশন কিছুই জানে না।
আশঙ্কা হয় যে চারদলীয় জোটের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মহাজোট সরকার অনুসন্ধান/বাছাই কমিটি ছাড়াই সরকারি দলের প্রতি দুর্বলতা আছে এমন ব্যক্তিদেরই কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবে। আর বাছাই কমিটি করা হলেও, কমিটি গঠনসংক্রান্ত কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষা করেই তা করা হবে।
প্রসঙ্গত, দলীয় সরকারের অধীনে বাছাই কমিটির মাধ্যমে সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে এ পর্যন্ত যত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দলীয় পরিচিতি রয়েছে। তাই অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করে সেই সরকারকেই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের দায়িত্ব প্রদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান দুই কমিশনারের একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে, বর্তমান সরকারের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত, এককভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে স্বাধীন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও এককভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর নয়। এ জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষভাবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালন এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সদাচরণ। আর এর পাহারাদার হিসেবে কাজ করতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। আর এটি তাদের সংবিধানপ্রদত্ত দায়িত্বের অংশও নয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো অনেক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রেই কমিশনের কথার প্রতি কর্ণপাত করে না, বরং কমিশনকে দলের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হতে হয়। যেমন, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিলুপ্তি, দলের বিদেশি শাখা না রাখা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত হলেও আমাদের প্রধান দলগুলোর প্রতিরোধের মুখে কমিশনের পক্ষে এসব শর্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
আরেকটি ক্ষেত্রেও যেন অতীতের অনৈতিক খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। খেলাটি হলো জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে। গত চারদলীয় জোট আমলের শেষ দিকে এরশাদকে দিয়ে বিরোধী দল সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়, এবারও সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি অতীতে তাঁকে জোটে টানার জন্য দর-কষাকষি হয়। এ ছাড়া এরশাদকে কাছে টানার জন্য অতীতের সরকার তার মামলা প্রত্যাহার করেছিল। বর্তমান সরকারও তাঁকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা এবং তাঁর দলকে আরও মন্ত্রীর পদ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বলে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন বেরিয়েছে। উপরন্তু অতীতের মতো বর্তমানে দল ভাঙার পাঁয়তারাও চলছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এটি সুস্পষ্ট যে বর্তমান সরকার চারদলীয় জোট সরকারের অতীতের অনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোই বহুলাংশে অনুসরণ করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে অতীতের কারসাজির পরিবর্তে মহাজোট সরকার পুরো ব্যবস্থাকেই বাতিল করে দিয়েছে, যা নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের পথই রুদ্ধ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মূল্য রয়েছে, যে মূল্য ক্রমাগতভাবে বেড়েই ুযায়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
পরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। চারদলীয় জোটের অপচেষ্টা সফল হয়নি। মহাজোটের প্রবল আন্দোলন এবং চারদলীয় জোট সরকারের সব অপকর্মের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে বিচারপতি কে এম হাসান সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিজ নাম প্রত্যাহার করে নেন। চারদলীয় জোট এতে হাল না ছেড়ে, সাংবিধানিক পদ্ধতি পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টা হওয়া নিশ্চিত করে। ড. ইয়াজউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণের সিদ্ধান্তের আদালতের চ্যালেঞ্জ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের হস্তক্ষেপে ভন্ডুল হয়ে যায়।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলের এসব কারসাজি এবং আরও কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণে আমাদের পুরো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অবশেষে ভেঙে পড়ে এবং সৃষ্টি হয় এক-এগারোর। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের কিছু বাড়াবাড়ির কারণে দুই নেত্রী এখন সর্বক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের তথাকথিত ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা, উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী যার উদ্যোক্তা ছিলেন মূলত তাঁদের দলীয় সহকর্মীরা, পরবর্তী সময়ে প্লাস-প্লাসে পরিণত হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে অনৈতিক খেলার দিক থেকে বর্তমান সরকার চারদলীয় জোট সরকারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। তারা পুরো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাদ দিয়ে দিয়েছে, যাতে পরবর্তী নির্বাচনের সময় নিজেরাই ক্ষমতায় থাকে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অজুহাতে, যদিও পূর্ণ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। এ ছাড়া আদালতের রায়ে ভবিষ্যতের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। উপরন্তু আদালতের পর্যবেক্ষণে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগামী দুই টার্মের জন্য বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে দলীয় সরকারের অধীনে স্বাধীন বাংলাদেশে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার কোনোটাই নিরপেক্ষ হয়নি, যার ফলে ক্ষমতাসীন দলই সব সময় নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। পক্ষান্তরে গত তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সবগুলোতেই ক্ষমতাসীনেরা হেরেছে। শুধু তা-ই নয়, বিরোধী দল ক্রমাগতভাবে অধিকসংখ্যক আসন নিয়ে জয় লাভ করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যত আসন নিয়ে বিজয়ী হয়েছিল, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট তার চেয়ে বেশি এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে মহাজোট আরও অনেক বেশি আসনে জয়ী হয়েছিল। অর্থাৎ ভোটাররা ক্রমাগতভাবে আরও জোরালোভাবে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যাখ্যান করেছে।
আমাদের আশঙ্কা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ফলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ভবিষ্যতে ক্ষমতার হস্তান্তর প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। কারণ চরম পক্ষপাতদুষ্ট ও ফায়দাপুষ্ট প্রশাসন তাদের নিজেদের স্বার্থেই, অবৈধ কর্মের শাস্তি এড়াতে এবং অন্যায় সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখতে, ক্ষমতাসীন সরকারের বিজয় নিশ্চিত করবে। এর জন্য ক্ষমতাসীনদের ইশারারও প্রয়োজন পড়বে না।
আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কারণে বিএনপি ও তার শরিকেরা ইতিমধ্যেই আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে। তাই আগামী নির্বাচন হবে একদলীয় বা একজোটীয় অথবা এরশাদ ও বিএনপির দলছুটদের নিয়ে গঠিত পাতানো বিরোধী দলকে নিয়ে, যা দেশি-বিদেশি কোনো মহলেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে যে খেলা মঞ্চস্থ হয়েছে তার নগ্নতম প্রতিফলন দেখা যায় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্লজ্জ ডিগবাজিতে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনেরই ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সে আন্দোলনের সময় বিএনপি ছিল এর ঘোর বিরোধী। এখন জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য দলগুলোর অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। ক্ষমতার লোভে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যেকোনো অবস্থান নিতে দ্বিধাহীন।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের নিরপেক্ষতার সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণও নয়। তবু প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দলীয়করণ এবং রাজনৈতিক দল ও তাদের প্রার্থীদের অসদাচরণের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই। তাই আমরা আগামী দু্ই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পক্ষে। আমাদের প্রত্যাশা যে এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যথাযথ পরিবর্তন ঘটাবে, যাতে পরবর্তী নির্বাচনগুলো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। চারদলীয় জোট সরকার নির্বাচন কমিশনকে নিয়েও ভয়াবহ অনৈতিক খেলা খেলেছে। তারা গোটা কমিশনকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিণতিও আমরা জানি। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কমিশনের সব সদস্যকেই অমর্যাদাকরভাবে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার ঘোষণা দিলেও কমিশনকে নিয়ে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সময় সংবিধানের ৮৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে কমিশনের ব্যয়কে সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায়যুক্ত করা হয়নি। কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষা করে কমিশনের সদস্যসংখ্যা সর্বোচ্চ পাঁচে উন্নীত করা হয়েছে। সর্বোপরি, কয়েক মাস আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় কমিশন যে কটি আইনের খসড়া উত্থাপন করেছে, সেগুলো সম্পর্কে দলের প্রতিনিধিরা সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করেছে এবং কমিশনকে পরবর্তী সময়ে দলের মতামত প্রদানের আশ্বাস দিয়েছে, যা এখনো ঘটেনি।
কমিশন প্রস্তাবিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হলো, কমিশনে নিয়োগ প্রদানসংক্রান্ত। কমিশন একটি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের সুপারিশ করে, যাতে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিরা কমিশনে নিয়োগ পান। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কোনো মতামত তো দেয়ইনি, বরং গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী সরকার আরও দুজন নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের উদ্যোগ নিচ্ছে (যায়যায়দিন, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১), যে উদ্যোগ সম্পর্কে কমিশন কিছুই জানে না।
আশঙ্কা হয় যে চারদলীয় জোটের পদাঙ্ক অনুসরণ করে মহাজোট সরকার অনুসন্ধান/বাছাই কমিটি ছাড়াই সরকারি দলের প্রতি দুর্বলতা আছে এমন ব্যক্তিদেরই কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবে। আর বাছাই কমিটি করা হলেও, কমিটি গঠনসংক্রান্ত কমিশনের সুপারিশ উপেক্ষা করেই তা করা হবে।
প্রসঙ্গত, দলীয় সরকারের অধীনে বাছাই কমিটির মাধ্যমে সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে এ পর্যন্ত যত নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবারই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দলীয় পরিচিতি রয়েছে। তাই অনেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করে সেই সরকারকেই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের দায়িত্ব প্রদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এ ক্ষেত্রে বর্তমান দুই কমিশনারের একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে, বর্তমান সরকারের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া পর্যন্ত, এককভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে।
মনে রাখা প্রয়োজন যে স্বাধীন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও এককভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর নয়। এ জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষভাবে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব পালন এবং রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সদাচরণ। আর এর পাহারাদার হিসেবে কাজ করতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। আর এটি তাদের সংবিধানপ্রদত্ত দায়িত্বের অংশও নয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো অনেক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রেই কমিশনের কথার প্রতি কর্ণপাত করে না, বরং কমিশনকে দলের রক্তচক্ষুর সম্মুখীন হতে হয়। যেমন, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা, দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিলুপ্তি, দলের বিদেশি শাখা না রাখা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের শর্ত হলেও আমাদের প্রধান দলগুলোর প্রতিরোধের মুখে কমিশনের পক্ষে এসব শর্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
আরেকটি ক্ষেত্রেও যেন অতীতের অনৈতিক খেলার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। খেলাটি হলো জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে। গত চারদলীয় জোট আমলের শেষ দিকে এরশাদকে দিয়ে বিরোধী দল সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়, এবারও সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি অতীতে তাঁকে জোটে টানার জন্য দর-কষাকষি হয়। এ ছাড়া এরশাদকে কাছে টানার জন্য অতীতের সরকার তার মামলা প্রত্যাহার করেছিল। বর্তমান সরকারও তাঁকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা এবং তাঁর দলকে আরও মন্ত্রীর পদ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বলে সংবাদপত্রে প্রতিবেদন বেরিয়েছে। উপরন্তু অতীতের মতো বর্তমানে দল ভাঙার পাঁয়তারাও চলছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এটি সুস্পষ্ট যে বর্তমান সরকার চারদলীয় জোট সরকারের অতীতের অনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলোই বহুলাংশে অনুসরণ করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে অতীতের কারসাজির পরিবর্তে মহাজোট সরকার পুরো ব্যবস্থাকেই বাতিল করে দিয়েছে, যা নিরপেক্ষ ও সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদলের পথই রুদ্ধ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মূল্য রয়েছে, যে মূল্য ক্রমাগতভাবে বেড়েই ুযায়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments