জন্মদিন-আমাদের নায়ক মিশুক মুনীর
মিশুক ভাইকে প্রথম দেখে যে বিষয়টি আমার মাথায় ঢুকেছিল, তা হলো, তিনি আমাদের নায়ক। তাঁর চেহারা, সাদা-কালো চুল, গুন্টার গ্রাস-মার্কা গোঁফ, কথাবার্তা, শব্দচয়ন—সবকিছুর মধ্যে কী যেন একটা ছিল। কোনো দিন মিশুক ভাই কেতাদুরস্ত কাপড়চোপড় পরতেন না, স্যুট-টাই তো জীবনেও না।
তবু সবচেয়ে স্মার্ট, সবার চেয়ে আকর্ষণীয় ছিলেন মিশুক ভাই।
একটা ঘটনা বলি: ২০০০ সালের মাঝামাঝি যশোর অঞ্চলে প্রবল বন্যা। একুশে টিভি থেকে আমি আর হুমায়ুন (বর্তমানে এনটিভির প্রধান ক্যামেরাম্যান) গেলাম সেই বন্যার সংবাদ সংগ্রহের জন্য। মিশুক ভাই তখন আমাদের ডিরেক্টর, নিউজ অপারেশনস আর আমি নবীন রিপোর্টার। সেই ট্যুরের একপর্যায়ে আমার জ্বর এসেছিল এবং মাইগ্রেনের মাথাব্যথায় আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মনে আছে, সেই রাতে মিশুক ভাই যে কতবার ফোন করে আমার খবর নিয়েছিলেন!
আমরা তখন একুশে টিভিতে, আর একুশে মানেই খবর। খবরের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়েছিল একুশে। সেই খবরের ভিত্তি রচনার উদ্যোক্তা ছিলেন একুশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এ এস মাহমুদ আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। একুশের খবরের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য তাঁরা তখন এমন একজনকে খুঁজছিলেন, যিনি সাংবাদিকতা ছাড়াও টেলিভিশনের কারিগরি দিক সম্পর্কে ভালো জানেন। এই ধারার একজনকেই তাঁরা তখন খুঁজে পেয়েছিলেন, তিনি মিশুক মুনীর। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এ এস মাহমুদের ছেলে, ইটিভির আরেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরহাদ মাহমুদ মিশুক ভাইয়ের বন্ধু। যতটুকু জানি, ফরহাদ ভাই-ই তখন মিশুক ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন ইটিভিতে। একুশের ব্যাপারে মিশুক ভাই এতটাই উ ৎসাহী হয়েছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবেই যোগ দেন সেখানে। মনে পড়ে, ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল একুশের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনে প্রচারের জন্য ‘একুশের গল্প’ নামে একটি ছোট তথ্যচিত্র বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে। আমার জীবনের প্রথম তথ্যচিত্র, সেটিতে প্রথম যে শটটি ব্যবহার করেছিলাম, সেটি মিশুক মুনীরের তোলা।
টিভি রিপোর্টার হিসেবে মিশুক ভাইয়ের কাছে আমার অনেক ঋণ। ক্যামেরার ব্যবহার, শট ডিভিশন, এডিটিং, সিকোয়েন্স—এগুলো তো বটেই, রিপোর্ট বা স্ক্রিপ্ট লেখার ক্ষেত্রেও। বার্তা সম্পাদকদের দেখে দেওয়া একটা ভালো স্ক্রিপ্টও যখন মিশুক ভাইকে দেখতে দিতাম, তিনি একটা-দুটো শব্দ এদিক-সেদিক করে, দু-একটা শব্দ যোগ-বিয়োগ করে সেটি করে তুলতেন অসাধারণ। রিপোর্ট শেষে পিটিসিতে (রিপোর্টাররা ক্যামেরার সমানে যে কথাগুলো বলেন) কী বলব, তা নিয়ে অনেক সময়ই সংশয় থাকত। তখন মিশুক ভাইকে ফোন করে রিপোর্ট সম্পর্কে একটু ধারণা দিলেই তিনি চম ৎকার সব পিটিসির ধারণা দিতেন। প্রচারের পর লোকে আমাকে বাহবা দিত। সেই বাহবাও তো মিশুক ভাইয়ের জন্যই।
শুধু রিপোর্টারদের নয়, ক্যামেরাম্যান, ভিডিও এডিটর থেকে শুরু করে যে কারও যেকোনো সমস্যার তা ৎক্ষণিক সমাধানের নাম ছিল মিশুক। তখনো ফোনো (টেলিফোন রিপোর্ট) রেকর্ড করার যন্ত্রপাতি আমাদের ছিল না। একুশের প্রথম ফোনো সম্ভব হয়েছিল মিশুক ভাইয়ের উদ্ভাবনী ক্ষমতায়। তিনি ল্যান্ডফোনের রিসিভারের সঙ্গে লেপেল মাইক্রোফোন স্কচ টেপ দিয়ে এমনভাবে আটকালেন, যাতে রিপোর্টারের কথা ক্যামেরায়
রেকর্ড করা যায়। কিন্তু বাইরের শব্দ যাতে না ঢোকে, সে জন্য অফিসের ওয়াশরুম থেকে টয়লেট পেপার এনে তা দিয়ে মাইক্রোফোন টেলিফোনের রিসিভারের সঙ্গে পেঁচিয়ে সাউন্ডপ্রুফ করলেন মিশুক ভাই। রেকর্ড করার পর মনে হলো, কোনো আধুনিক যন্ত্রে রেকর্ড করা ফোনো!
মিশুক ভাই খুব মেধাবী কাজের মানুষ, তা সবাই জানে। কিন্তু তিনি যে কতটা আত্মভোলা ছিলেন! তিনি কোমরে একটা খাপে (পাউচ) মোবাইল ফোন রাখতেন। একদিন অফিসে দেখি মিশুক ভাইয়ের পাউচে টিভির রিমোট। তিনি মোবাইল ফোনসেট মনে করে বাসা থেকে রিমোট নিয়ে চলে এসেছেন!
আরেক দিনের কথা। তখনো শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একুশে টিভির উদ্বোধনী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর একটা শুভেচ্ছাবাণী রেকর্ড করা হবে। সায়মনসহ ইটিভির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা গণভবনে হাজির নির্ধারিত সময়ের আগেই। দুই ক্যামেরা নিয়ে তৈরি প্রযোজকও। সময়মতো প্রধানমন্ত্রীও এলেন, কিন্তু ক্যামেরাম্যান মিশুকের খবর নেই। প্রধানমন্ত্রী রেকর্ডিং শুরু করতে বললেন। তখন কেউ একজন তাঁকে জানালেন যে মিশুক অন দ্য ওয়ে। প্রধানমন্ত্রী বসেই থাকলেন। আধা ঘণ্টা পরে সেখানে পৌঁছান মিশুক ভাই। শেখ হাসিনা স্বভাবসুলভ আদুরে ধমক দিলেন মিশুক ভাইকে, আর তিনি মাথা চুলকিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও সেদিন রাগ করতে পারেননি তাঁর ওপর।
কোনো অহংকার বা গরিমা মিশুক মুনীরের ছিল না। নিজেকে জাহির করারও কোনো চেষ্টা করতেন না। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে তিনি, কিন্তু বাবার নাম বলে কোথাও কোনো সুবিধা নেওয়া তো দূরের কথা, কোনো দিন বাবার পরিচয় দিতেও শুনিনি তাঁকে। আপন মনে কাজ করতেন, আর মাঝে মাঝে কোথাও যেন হারিয়ে যেতেন, ফোন করলে বলতেন, ‘আই অ্যাম অন দ্য ওয়ে।’
সেই মিশুক ভাই নেই। আজ শুধু মনে হচ্ছে, মিশুক মুনীর একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠান শুধু নন, তিনি একাই ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা যাঁরা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, আমরা ভাগ্যবান। কিন্তু তাঁর আরও অনেক কিছু ছিল দেওয়ার, আমরা নিতে পারলাম না।
শুভ জন্মদিন, মিশুক ভাই।
জ ই মামুন
বার্তাপ্রধান, এটিএন বাংলা
mamunzi@gmail.com
একটা ঘটনা বলি: ২০০০ সালের মাঝামাঝি যশোর অঞ্চলে প্রবল বন্যা। একুশে টিভি থেকে আমি আর হুমায়ুন (বর্তমানে এনটিভির প্রধান ক্যামেরাম্যান) গেলাম সেই বন্যার সংবাদ সংগ্রহের জন্য। মিশুক ভাই তখন আমাদের ডিরেক্টর, নিউজ অপারেশনস আর আমি নবীন রিপোর্টার। সেই ট্যুরের একপর্যায়ে আমার জ্বর এসেছিল এবং মাইগ্রেনের মাথাব্যথায় আমি অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মনে আছে, সেই রাতে মিশুক ভাই যে কতবার ফোন করে আমার খবর নিয়েছিলেন!
আমরা তখন একুশে টিভিতে, আর একুশে মানেই খবর। খবরের ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়েছিল একুশে। সেই খবরের ভিত্তি রচনার উদ্যোক্তা ছিলেন একুশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এ এস মাহমুদ আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। একুশের খবরের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য তাঁরা তখন এমন একজনকে খুঁজছিলেন, যিনি সাংবাদিকতা ছাড়াও টেলিভিশনের কারিগরি দিক সম্পর্কে ভালো জানেন। এই ধারার একজনকেই তাঁরা তখন খুঁজে পেয়েছিলেন, তিনি মিশুক মুনীর। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। এ এস মাহমুদের ছেলে, ইটিভির আরেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরহাদ মাহমুদ মিশুক ভাইয়ের বন্ধু। যতটুকু জানি, ফরহাদ ভাই-ই তখন মিশুক ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন ইটিভিতে। একুশের ব্যাপারে মিশুক ভাই এতটাই উ ৎসাহী হয়েছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবেই যোগ দেন সেখানে। মনে পড়ে, ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল একুশের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনে প্রচারের জন্য ‘একুশের গল্প’ নামে একটি ছোট তথ্যচিত্র বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে। আমার জীবনের প্রথম তথ্যচিত্র, সেটিতে প্রথম যে শটটি ব্যবহার করেছিলাম, সেটি মিশুক মুনীরের তোলা।
টিভি রিপোর্টার হিসেবে মিশুক ভাইয়ের কাছে আমার অনেক ঋণ। ক্যামেরার ব্যবহার, শট ডিভিশন, এডিটিং, সিকোয়েন্স—এগুলো তো বটেই, রিপোর্ট বা স্ক্রিপ্ট লেখার ক্ষেত্রেও। বার্তা সম্পাদকদের দেখে দেওয়া একটা ভালো স্ক্রিপ্টও যখন মিশুক ভাইকে দেখতে দিতাম, তিনি একটা-দুটো শব্দ এদিক-সেদিক করে, দু-একটা শব্দ যোগ-বিয়োগ করে সেটি করে তুলতেন অসাধারণ। রিপোর্ট শেষে পিটিসিতে (রিপোর্টাররা ক্যামেরার সমানে যে কথাগুলো বলেন) কী বলব, তা নিয়ে অনেক সময়ই সংশয় থাকত। তখন মিশুক ভাইকে ফোন করে রিপোর্ট সম্পর্কে একটু ধারণা দিলেই তিনি চম ৎকার সব পিটিসির ধারণা দিতেন। প্রচারের পর লোকে আমাকে বাহবা দিত। সেই বাহবাও তো মিশুক ভাইয়ের জন্যই।
শুধু রিপোর্টারদের নয়, ক্যামেরাম্যান, ভিডিও এডিটর থেকে শুরু করে যে কারও যেকোনো সমস্যার তা ৎক্ষণিক সমাধানের নাম ছিল মিশুক। তখনো ফোনো (টেলিফোন রিপোর্ট) রেকর্ড করার যন্ত্রপাতি আমাদের ছিল না। একুশের প্রথম ফোনো সম্ভব হয়েছিল মিশুক ভাইয়ের উদ্ভাবনী ক্ষমতায়। তিনি ল্যান্ডফোনের রিসিভারের সঙ্গে লেপেল মাইক্রোফোন স্কচ টেপ দিয়ে এমনভাবে আটকালেন, যাতে রিপোর্টারের কথা ক্যামেরায়
রেকর্ড করা যায়। কিন্তু বাইরের শব্দ যাতে না ঢোকে, সে জন্য অফিসের ওয়াশরুম থেকে টয়লেট পেপার এনে তা দিয়ে মাইক্রোফোন টেলিফোনের রিসিভারের সঙ্গে পেঁচিয়ে সাউন্ডপ্রুফ করলেন মিশুক ভাই। রেকর্ড করার পর মনে হলো, কোনো আধুনিক যন্ত্রে রেকর্ড করা ফোনো!
মিশুক ভাই খুব মেধাবী কাজের মানুষ, তা সবাই জানে। কিন্তু তিনি যে কতটা আত্মভোলা ছিলেন! তিনি কোমরে একটা খাপে (পাউচ) মোবাইল ফোন রাখতেন। একদিন অফিসে দেখি মিশুক ভাইয়ের পাউচে টিভির রিমোট। তিনি মোবাইল ফোনসেট মনে করে বাসা থেকে রিমোট নিয়ে চলে এসেছেন!
আরেক দিনের কথা। তখনো শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একুশে টিভির উদ্বোধনী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর একটা শুভেচ্ছাবাণী রেকর্ড করা হবে। সায়মনসহ ইটিভির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা গণভবনে হাজির নির্ধারিত সময়ের আগেই। দুই ক্যামেরা নিয়ে তৈরি প্রযোজকও। সময়মতো প্রধানমন্ত্রীও এলেন, কিন্তু ক্যামেরাম্যান মিশুকের খবর নেই। প্রধানমন্ত্রী রেকর্ডিং শুরু করতে বললেন। তখন কেউ একজন তাঁকে জানালেন যে মিশুক অন দ্য ওয়ে। প্রধানমন্ত্রী বসেই থাকলেন। আধা ঘণ্টা পরে সেখানে পৌঁছান মিশুক ভাই। শেখ হাসিনা স্বভাবসুলভ আদুরে ধমক দিলেন মিশুক ভাইকে, আর তিনি মাথা চুলকিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও সেদিন রাগ করতে পারেননি তাঁর ওপর।
কোনো অহংকার বা গরিমা মিশুক মুনীরের ছিল না। নিজেকে জাহির করারও কোনো চেষ্টা করতেন না। শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে তিনি, কিন্তু বাবার নাম বলে কোথাও কোনো সুবিধা নেওয়া তো দূরের কথা, কোনো দিন বাবার পরিচয় দিতেও শুনিনি তাঁকে। আপন মনে কাজ করতেন, আর মাঝে মাঝে কোথাও যেন হারিয়ে যেতেন, ফোন করলে বলতেন, ‘আই অ্যাম অন দ্য ওয়ে।’
সেই মিশুক ভাই নেই। আজ শুধু মনে হচ্ছে, মিশুক মুনীর একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠান শুধু নন, তিনি একাই ছিলেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা যাঁরা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, আমরা ভাগ্যবান। কিন্তু তাঁর আরও অনেক কিছু ছিল দেওয়ার, আমরা নিতে পারলাম না।
শুভ জন্মদিন, মিশুক ভাই।
জ ই মামুন
বার্তাপ্রধান, এটিএন বাংলা
mamunzi@gmail.com
No comments