বাড়ির কাছে আরশিনগর by শান্তনু কায়সার
অসমের বাঙালি কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী ‘উনিশে মে ১৯৬১ শিলচর’ কবিতায় লিখেছেন: দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল, ‘এই যে ঈশান কোণ— কোন্ ভাষাতে হাসে কাঁদে কান পেতে তা শোন্।’
কবিতার ইঙ্গিত ওই বছরে শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া ১১ শহীদের দিকে।
কবিতার ইঙ্গিত ওই বছরে শিলচরে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া ১১ শহীদের দিকে।
আমাদের পরে ভাষার জন্য রক্তদানের দ্বিতীয় এই ঘটনা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ও বিশ্বের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। এখন যে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে, তাতে আমাদের দৃষ্টি বিশ্বের দিকে যাচ্ছে বটে; কিন্তু প্রথমেই তার চোখে পড়া দরকার আমাদের নিজের দেশ, বাংলাদেশের দিকে, তারপর প্রতিবেশী দেশ বা অঞ্চলের দিকে।
সে হিসেবে আমরা প্রথমে তাকাব বাংলাদেশের দিকে। তাতে প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা ছাড়াও আমরা দেখব, এখানে নানা জাতি, গোষ্ঠী ও ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময় আমরা যেসব ভাষার সমান মর্যাদা দাবি করেছি, তা শুধু ঐতিহাসিকই ছিল না, ছিল বৈজ্ঞানিকও। কোনো ভাষা বা তার সংস্কৃতির প্রতি আমাদের কোনো বৈরিতা অথবা বিদ্বেষ ছিল না। ছিল না বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমরা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছি; চেয়েছি অন্যান্য ভাষাও যেন গণতান্ত্রিকভাবে তাদের মর্যাদা লাভ করে ও বিকশিত হতে পারে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনে যখন মাতৃভাষাসহ সব রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হারাতে বসেছি, তখনো আমরা কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ কিংবা অপরের অধিকার হরণের অপচেষ্টা করিনি; বরং ওই বৈরিতার মধ্যেও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেছি। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীরই ‘উদ্বাস্তুর ডায়েরি’ কবিতার প্রথম দুটি পঙিক্ত থেকে তার ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে:
যে কেড়েছে বাস্তুভিটে, সে-ই কেড়েছে ভয়,
আকাশজুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়।
বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের জীবন ছিল নানা বৈরিতায় ভরা। অসমেরই কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য তাঁর ‘বরাকভূমির লোক এভাবেই চলে’য় যে জীবনের চিত্র এঁকেছেন, তা বলে দেয় মাতৃভাষার জন্য জীবনদান তাঁদের জীবনযাপনেরই অংশ:
নীচে নদী লোভা, খরস্রোতা পাড়ে ধস
পাহাড়ে, ধসের দুদিকে গাড়ি, কিছু প্রাণ
তবু হাতে প্রাণ নিয়ে জুতো ব্যাগ নিয়ে ওদের
পেরোতে হয়
জীবনের সব কাজ ভীষণ জরুরি আজকাল।
মেয়েটা পেরিয়ে গেল, এবং ছেলেটা
ধস পাড়ি দেয়, নদী লোভা কলকল হাসে।
দুই পাহাড়ের খাঁজে, তার জিভ লকলক করে
অদৃশ্য সুতোটি ধরে ওরা তো পেরোল দেখি ধস।
এভাবে অসমে ভাষা আন্দোলনের যে সূচনা হয়, তা শুধু বাংলা ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরাকে বসবাসকারী অন্যান্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীও তাদের অস্তিত্ব ও ভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসে। যেমন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা আন্দোলনে নিজের মাতৃভাষা রক্ষায় শহীদ হন সুদেষ্ণা সিংহ।১
অতএব, বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানকারী প্রথম জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদেরও উচিত অন্যান্য জাতিসত্তা ও ভাষা-সংস্কৃতির অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষায় তাদের হাতে হাত ধরা। গত ২৩ জানুয়ারি মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ, আসামের হাইলাকান্দি জেলা কমিটি ও লালা শাখার যৌথ উদ্যোগে চেংবিল এন বাচা এমই স্কুলে মণিপুরি এক সাহিত্য আসরে মণিপুরি দুই কবি ও লেখক সালমচা সিংহ ও লীলা দেবীকে সম্মাননা দেওয়া হয়।
এর আগে ১৩ জানুয়ারি বঙ্গভবন মিলনায়তনে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের শিলচরের কাছাড় জেলা সমিতি ‘আমাদের প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর লোকসংস্কৃতি’ শীর্ষ এক আলোচনার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন লোকসংস্কৃতিবিদ অমলেন্দু ভট্টাচার্য। তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে এ অঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর যে গবেষণা শুরু হয়েছিল, বিভাগ-উত্তরকালে এর ধারা আর তেমনভাবে অক্ষুণ্ন থাকেনি।
তবে এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি রতনকুমার থিয়ামের নাট্যবিষয়ক অর্জনের কথাও বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান, মণিপুরি সংস্কৃতির বিভিন্ন মোটিফ, আঙ্গিক শব্দ, ধ্বনি ও সংগীতের ওপর ভিত্তি করে রতনকুমার যে নাট্যভাষা তৈরি করেছেন, প্রকৃত অর্থে তা ভারতের সীমান্ত ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। ঢাকায় আমরা যাঁরা তাঁর প্রযোজনা দেখেছি, তাঁদের পক্ষে এ কথা বোঝা তেমন কঠিন নয়।
এই আলোচনাচক্রে মণিধন সিংহ লোকসংস্কৃতির ভার্বাল, মৌখিক ও নন-ভার্বাল, বস্তুগত সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরেন। তাতে ডিমাগা, মণিপুরি ও স্থানীয় অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির পারস্পরিক যোগাযোগ ও লেনদেনের প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়।
দুই.
বাংলাদেশেও আমাদের প্রতিবেশী জাতিসত্তা ও ভাষা-সংস্কৃতির বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হওয়া ও তার মধ্যে যতটা সম্ভব প্রবেশ করা দরকার। বর্তমান বিশ্ব ও দেশজ বাস্তবতায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেয়ে পরস্পরকে জানা ও বোঝা অধিকতর প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ হিসেবে সান্তালি ভাষার বর্ণমালা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি-সম্পর্কিত এসসি আলবার্ট সরেনের প্রবন্ধটির কথা বলা যায়। এই প্রবন্ধে তিনি যেমন বলেছেন, ‘হরফ বা লিপিভিত্তিক বিভক্তির কারণে মৌখিক ব্যবহার ও শ্রুতির নির্ভরশীলতার কারণে’ সান্তালি ভাষা এখনো সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, তেমনি আবার এও বলেছেন, ‘এই প্রাচীন আন্তর্জাতিক জাতির বিশাল জনসংখ্যার বর্ণমালা প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিবাচকভাবে কাজ করার বড় ক্ষেত্র রয়েছে। সান্তাল-অসান্তাল সব অগ্রণী গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানীর উচিত সান্তালি ভাষার জন্য উপমহাদেশে একটিমাত্র প্রমিত হরফ বা লিপি ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করা। একটি জাতিসত্তার ভাষাসাহিত্য চর্চার জন্য একটিমাত্র লিপিই বাঞ্ছনীয়, সে জাতির সদস্য বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, তিনি যেন তাঁর ভাষার বর্ণমালার সুনির্দিষ্ট পরিচয় দিতে পারেন, ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করতে পারেন।’
এ বিষয়গুলো নিয়ে যত আলোচনা হবে, তত আমাদের ভূখণ্ডে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিসত্তা ও ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারব। যারা নিকট প্রতিবেশী, তাদের বিষয়ে অজ্ঞতা তাদের জন্যই শুধু নয়, আমাদের জন্যও যথেষ্ট ক্ষতিকর।
উর্দু ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব যেমন তাদের বিভিন্ন সময় বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করেছে, তেমনি আমরাও এতে কম ক্ষতিগ্রস্ত হইনি। যে ভিন্ন ভাষায় সাহিত্যচর্চা হচ্ছে একই ভূখণ্ডে থেকেও, সে ভাষা ও তার সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে অনবহিত বা দূরে থাকা কোনো যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। এই ভাষায় যাঁরা প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চা করেছেন তাঁরা ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রবিতর্ক ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রতি তাঁদের সমর্থনই শুধু ব্যক্ত করেননি, এ বিষয়ে তাঁদের যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা নওশাদ নূরীর কবিতা এ ক্ষেত্রে দৃষ্টি-উন্মোচক বলে বিবেচিত হতে পারে।
পঞ্চাশের মধ্যভাগে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মণিপুরি গল্পলেখক সুরেন্দ্র কুমার সিংহের যে গল্পটি আমরা এখানে অন্তর্ভুক্ত করেছি, তার চরিত্রগুলোর নাম পাল্টে ফেলে একে সমতলভূমি বা বাঙালিদের গল্প বলেও চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে আমরা এক হয়েও ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে স্বতন্ত্র। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এই সুরের সন্ধানের জন্যও আমাদের পরস্পরের কাছাকাছি আসা দরকার।
তিন.
ভারতীয় তিস্তা নদীর জলপথে নাইয়া বা মাঝিবৃত্তির একটা সুপ্রাচীন প্রথা ছিল, যেমন আমরা তা পাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি অথবা অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম-এ। মাঝির অন্য অর্থ অবশ্য জেলে। তিস্তাপাড়ের জনপদ জলপাইগুড়ি। এর পূর্ব দিকে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। এই শহর গড়ে ওঠার আদিপূর্বে বহু মানুষ ‘পূর্ববঙ্গ থেকে নৌকা করে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র হয়ে তিস্তা দিয়ে করলা নদীতে ঢুকে জলপাইগুড়ির দিনবাজারের কালীবাড়ির ঘাটে এসে নামতেন’।২
সীমান্তের এপারে-ওপারে এভাবে আমরা নিজেদের আবিষ্কার করতে পারি। আবিষ্কার করতে পারি আমাদের ভূগোল, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও সংস্কৃতির নানা শাখা-প্রশাখা। লালন ফকির তাঁর গানে নিকটতম প্রতিবেশী যে আরশিনগরের কথা বলেছেন, তাকে এড়িয়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়; বরং তা হোক আমাদের আবিষ্কারের নিত্যনতুন ভূমি, যাতে কূপমণ্ডূকতামুক্ত হয়ে আমাদের লোককবি যেমন বলেছেন, নানান বরণ গাভির মধ্যে একই বরণ দুধের সন্ধান পাই। সেটা অবশ্য ইংরেজি তথা পশ্চিমি সাহিত্যেরও কথা। শেলির ভাষায়, ‘লাইফ লাইক এ ডোম অব মেনি-কালারড গ্লাস/স্টেইনস দ্য হোয়াইট রেডিয়েন্স অব ইটার্নিটি।’
তথ্যসূত্র
১. উনিশের শহীদ ও আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা
আশুতোষ দাস, হাইলাকান্দি, অসম
২. নদীকথা: তিস্তা
রণজিৎ কুমার মিত্র
দ্যোতনা—প্রধান সম্পাদক: গৌতম গুহ রায়
জুলাই, ২০১১, জলপাইগুড়ি
সে হিসেবে আমরা প্রথমে তাকাব বাংলাদেশের দিকে। তাতে প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা ছাড়াও আমরা দেখব, এখানে নানা জাতি, গোষ্ঠী ও ভাষা-সংস্কৃতির মানুষ রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময় আমরা যেসব ভাষার সমান মর্যাদা দাবি করেছি, তা শুধু ঐতিহাসিকই ছিল না, ছিল বৈজ্ঞানিকও। কোনো ভাষা বা তার সংস্কৃতির প্রতি আমাদের কোনো বৈরিতা অথবা বিদ্বেষ ছিল না। ছিল না বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমরা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছি; চেয়েছি অন্যান্য ভাষাও যেন গণতান্ত্রিকভাবে তাদের মর্যাদা লাভ করে ও বিকশিত হতে পারে। পাকিস্তানি স্বৈরশাসনে যখন মাতৃভাষাসহ সব রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার হারাতে বসেছি, তখনো আমরা কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ কিংবা অপরের অধিকার হরণের অপচেষ্টা করিনি; বরং ওই বৈরিতার মধ্যেও শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেছি। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীরই ‘উদ্বাস্তুর ডায়েরি’ কবিতার প্রথম দুটি পঙিক্ত থেকে তার ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে:
যে কেড়েছে বাস্তুভিটে, সে-ই কেড়েছে ভয়,
আকাশজুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়।
বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের জীবন ছিল নানা বৈরিতায় ভরা। অসমেরই কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য তাঁর ‘বরাকভূমির লোক এভাবেই চলে’য় যে জীবনের চিত্র এঁকেছেন, তা বলে দেয় মাতৃভাষার জন্য জীবনদান তাঁদের জীবনযাপনেরই অংশ:
নীচে নদী লোভা, খরস্রোতা পাড়ে ধস
পাহাড়ে, ধসের দুদিকে গাড়ি, কিছু প্রাণ
তবু হাতে প্রাণ নিয়ে জুতো ব্যাগ নিয়ে ওদের
পেরোতে হয়
জীবনের সব কাজ ভীষণ জরুরি আজকাল।
মেয়েটা পেরিয়ে গেল, এবং ছেলেটা
ধস পাড়ি দেয়, নদী লোভা কলকল হাসে।
দুই পাহাড়ের খাঁজে, তার জিভ লকলক করে
অদৃশ্য সুতোটি ধরে ওরা তো পেরোল দেখি ধস।
এভাবে অসমে ভাষা আন্দোলনের যে সূচনা হয়, তা শুধু বাংলা ভাষাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরাকে বসবাসকারী অন্যান্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীও তাদের অস্তিত্ব ও ভাষার মর্যাদা রক্ষায় এগিয়ে আসে। যেমন বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষা আন্দোলনে নিজের মাতৃভাষা রক্ষায় শহীদ হন সুদেষ্ণা সিংহ।১
অতএব, বাংলা ভাষার জন্য রক্তদানকারী প্রথম জনগোষ্ঠী হিসেবে আমাদেরও উচিত অন্যান্য জাতিসত্তা ও ভাষা-সংস্কৃতির অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষায় তাদের হাতে হাত ধরা। গত ২৩ জানুয়ারি মণিপুরি সাহিত্য পরিষদ, আসামের হাইলাকান্দি জেলা কমিটি ও লালা শাখার যৌথ উদ্যোগে চেংবিল এন বাচা এমই স্কুলে মণিপুরি এক সাহিত্য আসরে মণিপুরি দুই কবি ও লেখক সালমচা সিংহ ও লীলা দেবীকে সম্মাননা দেওয়া হয়।
এর আগে ১৩ জানুয়ারি বঙ্গভবন মিলনায়তনে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের শিলচরের কাছাড় জেলা সমিতি ‘আমাদের প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর লোকসংস্কৃতি’ শীর্ষ এক আলোচনার আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন লোকসংস্কৃতিবিদ অমলেন্দু ভট্টাচার্য। তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে এ অঞ্চলের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর যে গবেষণা শুরু হয়েছিল, বিভাগ-উত্তরকালে এর ধারা আর তেমনভাবে অক্ষুণ্ন থাকেনি।
তবে এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে গিয়ে তিনি রতনকুমার থিয়ামের নাট্যবিষয়ক অর্জনের কথাও বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান, মণিপুরি সংস্কৃতির বিভিন্ন মোটিফ, আঙ্গিক শব্দ, ধ্বনি ও সংগীতের ওপর ভিত্তি করে রতনকুমার যে নাট্যভাষা তৈরি করেছেন, প্রকৃত অর্থে তা ভারতের সীমান্ত ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। ঢাকায় আমরা যাঁরা তাঁর প্রযোজনা দেখেছি, তাঁদের পক্ষে এ কথা বোঝা তেমন কঠিন নয়।
এই আলোচনাচক্রে মণিধন সিংহ লোকসংস্কৃতির ভার্বাল, মৌখিক ও নন-ভার্বাল, বস্তুগত সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরেন। তাতে ডিমাগা, মণিপুরি ও স্থানীয় অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির পারস্পরিক যোগাযোগ ও লেনদেনের প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়।
দুই.
বাংলাদেশেও আমাদের প্রতিবেশী জাতিসত্তা ও ভাষা-সংস্কৃতির বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হওয়া ও তার মধ্যে যতটা সম্ভব প্রবেশ করা দরকার। বর্তমান বিশ্ব ও দেশজ বাস্তবতায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেয়ে পরস্পরকে জানা ও বোঝা অধিকতর প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণ হিসেবে সান্তালি ভাষার বর্ণমালা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি-সম্পর্কিত এসসি আলবার্ট সরেনের প্রবন্ধটির কথা বলা যায়। এই প্রবন্ধে তিনি যেমন বলেছেন, ‘হরফ বা লিপিভিত্তিক বিভক্তির কারণে মৌখিক ব্যবহার ও শ্রুতির নির্ভরশীলতার কারণে’ সান্তালি ভাষা এখনো সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, তেমনি আবার এও বলেছেন, ‘এই প্রাচীন আন্তর্জাতিক জাতির বিশাল জনসংখ্যার বর্ণমালা প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিবাচকভাবে কাজ করার বড় ক্ষেত্র রয়েছে। সান্তাল-অসান্তাল সব অগ্রণী গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানীর উচিত সান্তালি ভাষার জন্য উপমহাদেশে একটিমাত্র প্রমিত হরফ বা লিপি ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করা। একটি জাতিসত্তার ভাষাসাহিত্য চর্চার জন্য একটিমাত্র লিপিই বাঞ্ছনীয়, সে জাতির সদস্য বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, তিনি যেন তাঁর ভাষার বর্ণমালার সুনির্দিষ্ট পরিচয় দিতে পারেন, ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করতে পারেন।’
এ বিষয়গুলো নিয়ে যত আলোচনা হবে, তত আমাদের ভূখণ্ডে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিসত্তা ও ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারব। যারা নিকট প্রতিবেশী, তাদের বিষয়ে অজ্ঞতা তাদের জন্যই শুধু নয়, আমাদের জন্যও যথেষ্ট ক্ষতিকর।
উর্দু ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব যেমন তাদের বিভিন্ন সময় বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করেছে, তেমনি আমরাও এতে কম ক্ষতিগ্রস্ত হইনি। যে ভিন্ন ভাষায় সাহিত্যচর্চা হচ্ছে একই ভূখণ্ডে থেকেও, সে ভাষা ও তার সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে অনবহিত বা দূরে থাকা কোনো যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে না। এই ভাষায় যাঁরা প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চা করেছেন তাঁরা ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্রবিতর্ক ও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রতি তাঁদের সমর্থনই শুধু ব্যক্ত করেননি, এ বিষয়ে তাঁদের যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা নওশাদ নূরীর কবিতা এ ক্ষেত্রে দৃষ্টি-উন্মোচক বলে বিবেচিত হতে পারে।
পঞ্চাশের মধ্যভাগে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী মণিপুরি গল্পলেখক সুরেন্দ্র কুমার সিংহের যে গল্পটি আমরা এখানে অন্তর্ভুক্ত করেছি, তার চরিত্রগুলোর নাম পাল্টে ফেলে একে সমতলভূমি বা বাঙালিদের গল্প বলেও চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে আমরা এক হয়েও ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির দিক থেকে স্বতন্ত্র। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এই সুরের সন্ধানের জন্যও আমাদের পরস্পরের কাছাকাছি আসা দরকার।
তিন.
ভারতীয় তিস্তা নদীর জলপথে নাইয়া বা মাঝিবৃত্তির একটা সুপ্রাচীন প্রথা ছিল, যেমন আমরা তা পাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি অথবা অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম-এ। মাঝির অন্য অর্থ অবশ্য জেলে। তিস্তাপাড়ের জনপদ জলপাইগুড়ি। এর পূর্ব দিকে বয়ে চলেছে তিস্তা নদী। এই শহর গড়ে ওঠার আদিপূর্বে বহু মানুষ ‘পূর্ববঙ্গ থেকে নৌকা করে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র হয়ে তিস্তা দিয়ে করলা নদীতে ঢুকে জলপাইগুড়ির দিনবাজারের কালীবাড়ির ঘাটে এসে নামতেন’।২
সীমান্তের এপারে-ওপারে এভাবে আমরা নিজেদের আবিষ্কার করতে পারি। আবিষ্কার করতে পারি আমাদের ভূগোল, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ও সংস্কৃতির নানা শাখা-প্রশাখা। লালন ফকির তাঁর গানে নিকটতম প্রতিবেশী যে আরশিনগরের কথা বলেছেন, তাকে এড়িয়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়; বরং তা হোক আমাদের আবিষ্কারের নিত্যনতুন ভূমি, যাতে কূপমণ্ডূকতামুক্ত হয়ে আমাদের লোককবি যেমন বলেছেন, নানান বরণ গাভির মধ্যে একই বরণ দুধের সন্ধান পাই। সেটা অবশ্য ইংরেজি তথা পশ্চিমি সাহিত্যেরও কথা। শেলির ভাষায়, ‘লাইফ লাইক এ ডোম অব মেনি-কালারড গ্লাস/স্টেইনস দ্য হোয়াইট রেডিয়েন্স অব ইটার্নিটি।’
তথ্যসূত্র
১. উনিশের শহীদ ও আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা
আশুতোষ দাস, হাইলাকান্দি, অসম
২. নদীকথা: তিস্তা
রণজিৎ কুমার মিত্র
দ্যোতনা—প্রধান সম্পাদক: গৌতম গুহ রায়
জুলাই, ২০১১, জলপাইগুড়ি
No comments