শিবের গীত-হরতাল by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
ঝগড়াপুর নামক দেশটিতে (এর একটি সুন্দর নাম ছিল একসময়। কিন্তু দেশের সব মানুষ দুই দলে ভাগ হয়ে প্রতিদিন শুধুই ঝগড়া করতে থাকলে এখন এই নাম) ঘন ঘনই হরতাল হয়। ২০ বছর ধরে প্রতি সরকারের সময় হরতাল হয়েছে এবং হচ্ছে। কখনো বা ১১-১২ বা ৪৮ ঘণ্টা, কখনো বা লাগাতার।
তাতে রাজধানী ধাক্কাসহ (শহরটার একটা ভিন্ন নাম ছিল, কিন্তু জনসংখ্যা ফুলে-ফেঁপে এটি এক কুৎসিত কংক্রিট-জঙ্গলে পরিণত হলে রাস্তায় বেরোলেই নাগরিকেরা শুধু একে অপরের সঙ্গে, রিকশা-গাড়ি-ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে এই নাম) ছোট-বড় সব শহর অচল হয়; কলকারখানা বন্ধ হয়, স্কুল-কলেজ বিরান হয় এবং অর্থনীতির বারোটা-সাড়ে বারোটা বাজে। দুই বড় দল—আমি-আমি লীগ এবং আত্মীয়তাবাদী দলের কোনো একটি যখন ক্ষমতায় থাকে, হরতালের পেছনে তারা উঠেপড়ে লাগে। যখন ক্ষমতায় থাকে না, তখন হরতাল তাদের সাংবিধানিক অধিকার হয়ে দাঁড়ায়। তাই সরকারি দল যখন ‘হরতাল হয়নি’, ‘জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে’—এ রকম দাবি করে, বিরোধীরা তখন ‘সর্বাত্মক ও সফল হরতালের মাধ্যমে জনগণ ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানিয়েছে’—এ রকম রা তুলে মিডিয়া-অঙ্গনে ঝড় তোলে।
হরতাল নিয়ে একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন এক চিত্রনির্মাতা। তিনি ২০ বছরের হরতালের দৃশ্য ও সংলাপ নিয়ে একটা চিত্রনাট্য খাড়া করেছেন। তিনি মাত্র দুজন মূল চরিত্র রেখেছেন, যারা দুই দলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছে এবং করছে। তাঁর চিত্রনাট্যের দৃশ্যগুলো এ রকম:
দৃশ্য-১: আত্মীয়তাবাদী দল ক্ষমতায়, সঙ্গে তাদের দোসর উগ্রবাদী কেরামতিরা (আত্মীয়তাবাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামটা চিত্রনাট্যে ভয়ে রাখেননি চিত্রনির্মাতা। যেহেতু হাওয়া-বাগিচাপ্রেমী এক মোগল সম্রাটের মতো তার প্রতাপ)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুলিশ-র্যাব ঘিরে রেখেছে আমি-আমি দলের অফিস, একজন নেতা-কর্মীকেও ঢুকতে বা বেরোতে দিচ্ছে না। ধাক্কাসহ সব শহরে যেখানেই হরতালের সমর্থনে মিছিল হচ্ছে, পুলিশ ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দিচ্ছে, হাত-পা ভেঙে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কারও মাথা ফাটছে, তো, অন্য কারও ভুঁড়িতে লাঠির বাড়ি পড়ছে।
দৃশ্য-২: হরতাল শেষ। আত্মীয়তাবাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছে, ‘ইস্যুবিহীন হরতালে জনসমর্থন ছিল না। জনগণ ঘৃণাভরে হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে।’
দৃশ্য-৩: দুই দিন পর। অর্থনীতিবিদেরা জানাচ্ছে, হরতালে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা।
দৃশ্য-৪: আমি-আমি দল ক্ষমতায় (তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামটাও চিত্রনাট্যে নেই। শুধু লেখা আছে, উনি বেশ দিশেহারা)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুলিশ-র্যাব ঘিরে রেখেছে আত্মীয়তাবাদী দলের অফিস। একজন নেতা-কর্মীকেও ঢুকতে বা বেরোতে দিচ্ছে না। ধাক্কাসহ সব শহরের যেখানেই হরতালের সমর্থনে মিছিল হচ্ছে, পুলিশ ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দিচ্ছে, হাত-পা ভেঙে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কারও মাথা ফাটছে, তো, অন্য কারও ভুঁড়িতে লাঠির বাড়ি পড়ছে।
দৃশ্য-৫: হরতাল শেষ। আমি-আমির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছে, ‘ইস্যুবিহীন হরতালে জনসমর্থন ছিল না। জনগণ ঘৃণাভরে হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে।’
দৃশ্য-৬: দুই দিন পর। অর্থনীতিবিদেরা জানাচ্ছে, হরতালে দেশের ক্ষতি ৮০০ কোটি টাকা।
দৃশ্য-৭: আত্মীয়তাবাদী দল ক্ষমতায়। সঙ্গে তাদের দোসর উগ্রবাদী কেরামতিরা...।
চিত্রনাট্যে এরপর যা আছে, তা হুবহু দৃশ্য-১-এর অনুরূপ।
দৃশ্য-৮: হুবহু দৃশ্য-২-এর অনুরূপ।
দৃশ্য-৯: ওখানে টাকার অঙ্কটা শুধু বারো শ কোটি টাকা।
দৃশ্য-১০: হুবহু দৃশ্য-৪-এর অনুরূপ।
দৃশ্য-১২ ও ১৫-তে টাকার অঙ্কটা লাফিয়ে বাড়ছে।
এরপর চিত্রনাট্যটি পড়ার আর কোনো আগ্রহ থাকার কথা নয়। এর পরও বেশ কিছু দৃশ্য পার হয়ে একটি দৃশ্যে আসা গেল, যেখানে একজন অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা গেল ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ নাম তোলার জন্য আবেদন করতে। কর্তৃপক্ষের কাছে সে একটা চিঠি লিখেছে, যার বাংলা করলে এই দাঁড়ায়:
‘মহাশয়, একটি দিক দিয়ে আমি এক বিরল বিশ্ব রেকর্ডধারী। আমি দাবি করছি, আমিই বিশ্বের একমাত্র পুলিশ কর্মকর্তা, যে গত ২০ বছরে এক হাজার ২৫৪ জন রাজনৈতিক নেতাকে রাজপথে পিটিয়েছে। আমি অনেককে মেরে জখমও করেছি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে এমপি, প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রী—এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁরা প্রায় সমানসংখ্যক দেশের দুটি বড় দলের সদস্য। তাজ্জব ব্যাপার, একটি দলের এমন নেতাকেও পিটিয়েছি, যিনি পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে অন্য দলের এমন নেতাকে পেটাতে আমাকে আদেশ দিয়েছেন; যিনি পরে ওই দলের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। পরে তিনিও আমাকে...যা-ই হোক, আমি আমার বিশ্ব রেকর্ডের স্বীকৃতি চাই। ইতি—’
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
হরতাল নিয়ে একটা সিনেমা বানানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন এক চিত্রনির্মাতা। তিনি ২০ বছরের হরতালের দৃশ্য ও সংলাপ নিয়ে একটা চিত্রনাট্য খাড়া করেছেন। তিনি মাত্র দুজন মূল চরিত্র রেখেছেন, যারা দুই দলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছে এবং করছে। তাঁর চিত্রনাট্যের দৃশ্যগুলো এ রকম:
দৃশ্য-১: আত্মীয়তাবাদী দল ক্ষমতায়, সঙ্গে তাদের দোসর উগ্রবাদী কেরামতিরা (আত্মীয়তাবাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামটা চিত্রনাট্যে ভয়ে রাখেননি চিত্রনির্মাতা। যেহেতু হাওয়া-বাগিচাপ্রেমী এক মোগল সম্রাটের মতো তার প্রতাপ)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুলিশ-র্যাব ঘিরে রেখেছে আমি-আমি দলের অফিস, একজন নেতা-কর্মীকেও ঢুকতে বা বেরোতে দিচ্ছে না। ধাক্কাসহ সব শহরে যেখানেই হরতালের সমর্থনে মিছিল হচ্ছে, পুলিশ ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দিচ্ছে, হাত-পা ভেঙে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কারও মাথা ফাটছে, তো, অন্য কারও ভুঁড়িতে লাঠির বাড়ি পড়ছে।
দৃশ্য-২: হরতাল শেষ। আত্মীয়তাবাদী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছে, ‘ইস্যুবিহীন হরতালে জনসমর্থন ছিল না। জনগণ ঘৃণাভরে হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে।’
দৃশ্য-৩: দুই দিন পর। অর্থনীতিবিদেরা জানাচ্ছে, হরতালে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা।
দৃশ্য-৪: আমি-আমি দল ক্ষমতায় (তাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামটাও চিত্রনাট্যে নেই। শুধু লেখা আছে, উনি বেশ দিশেহারা)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুলিশ-র্যাব ঘিরে রেখেছে আত্মীয়তাবাদী দলের অফিস। একজন নেতা-কর্মীকেও ঢুকতে বা বেরোতে দিচ্ছে না। ধাক্কাসহ সব শহরের যেখানেই হরতালের সমর্থনে মিছিল হচ্ছে, পুলিশ ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দিচ্ছে, হাত-পা ভেঙে পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কারও মাথা ফাটছে, তো, অন্য কারও ভুঁড়িতে লাঠির বাড়ি পড়ছে।
দৃশ্য-৫: হরতাল শেষ। আমি-আমির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছে, ‘ইস্যুবিহীন হরতালে জনসমর্থন ছিল না। জনগণ ঘৃণাভরে হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে।’
দৃশ্য-৬: দুই দিন পর। অর্থনীতিবিদেরা জানাচ্ছে, হরতালে দেশের ক্ষতি ৮০০ কোটি টাকা।
দৃশ্য-৭: আত্মীয়তাবাদী দল ক্ষমতায়। সঙ্গে তাদের দোসর উগ্রবাদী কেরামতিরা...।
চিত্রনাট্যে এরপর যা আছে, তা হুবহু দৃশ্য-১-এর অনুরূপ।
দৃশ্য-৮: হুবহু দৃশ্য-২-এর অনুরূপ।
দৃশ্য-৯: ওখানে টাকার অঙ্কটা শুধু বারো শ কোটি টাকা।
দৃশ্য-১০: হুবহু দৃশ্য-৪-এর অনুরূপ।
দৃশ্য-১২ ও ১৫-তে টাকার অঙ্কটা লাফিয়ে বাড়ছে।
এরপর চিত্রনাট্যটি পড়ার আর কোনো আগ্রহ থাকার কথা নয়। এর পরও বেশ কিছু দৃশ্য পার হয়ে একটি দৃশ্যে আসা গেল, যেখানে একজন অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তাকে দেখা গেল ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ নাম তোলার জন্য আবেদন করতে। কর্তৃপক্ষের কাছে সে একটা চিঠি লিখেছে, যার বাংলা করলে এই দাঁড়ায়:
‘মহাশয়, একটি দিক দিয়ে আমি এক বিরল বিশ্ব রেকর্ডধারী। আমি দাবি করছি, আমিই বিশ্বের একমাত্র পুলিশ কর্মকর্তা, যে গত ২০ বছরে এক হাজার ২৫৪ জন রাজনৈতিক নেতাকে রাজপথে পিটিয়েছে। আমি অনেককে মেরে জখমও করেছি, যাঁরা বিভিন্ন সময়ে এমপি, প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রী—এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁরা প্রায় সমানসংখ্যক দেশের দুটি বড় দলের সদস্য। তাজ্জব ব্যাপার, একটি দলের এমন নেতাকেও পিটিয়েছি, যিনি পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে অন্য দলের এমন নেতাকে পেটাতে আমাকে আদেশ দিয়েছেন; যিনি পরে ওই দলের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। পরে তিনিও আমাকে...যা-ই হোক, আমি আমার বিশ্ব রেকর্ডের স্বীকৃতি চাই। ইতি—’
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments