ইউরোপের চিঠি-আর্কটিক তেল চুক্তি ও জলবায়ু ঝুঁকি by পিটার কাস্টার্স
চুক্তিটিকে অভিহিত করা হচ্ছে অভ্যুত্থান হিসেবে। প্রশ্ন হলো, এটা কী ধরনের অভ্যুত্থান? গত ৩০ আগস্ট খ্যাতনামা দুটি বিশাল কোম্পানি—মার্কিন এক্সনমবিল ও রুশ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রোসনেফট—একটি কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তিটি রাশিয়ার কারা সাগরে কোম্পানি দুটির তেল উত্তোলনের ক্ষেত্রে সহযোগিতার পথ করে দিয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও পারস্পরিক সহযোগিতার পথ খুলে দিয়েছে। খোলা চোখেও দেখা যায়, বৈশ্বিক তেল খাতের অন্য কোম্পানিগুলো পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বড় আঘাত এই চুক্তি। অনেক বছর ধরেই এক্সনমবিল দুনিয়ার বৃহত্তম বেসরকারি তেল কোম্পানির তালিকার শীর্ষে। ২০১০ সালে এটি ৩৮২ বিলিয়ন ডলার আয় করে। আর পৃথিবীর প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়ার মোট উৎপাদিত অশোধিত তেলের এক-পঞ্চমাংশ তুলেছে রোসনেফট। উল্লিখিত চুক্তিকে অভ্যুত্থান বিবেচনার আরেক কারণ হয়তো, এ চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা চলাকালেও শেলসহ অন্যান্য পশ্চিমা তেল করপোরেশন রোসনেফটের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য পাল্লা দিয়েছিল। এই চুক্তি বেসরকারি ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল করপোরেশনের মধ্যকার পার্থক্য ঘুচিয়ে সামনে অগ্রণী। চুক্তিটি এখনো অনাবিষ্কৃত ও অনুসন্ধান করা হয়নি, এমন তেল মজুদের জন্য প্রতিযোগিতায় এক্সনমবিল-রোসনেফটকে কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থান পাইয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে সময়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ—কেননা, বৈশ্বিক তেল উত্তোলন এখন সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এখানেই শেষ নয়। এ চুক্তিটাকে প্রতিদ্বন্দ্বী করপোরেশনগুলো থেকে এগিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রতিযোগিতার আরেকটি নমুনা হিসেবে পাশে ঠেলে দেওয়া যেতে পারত। তা করা যাচ্ছে না। কেননা, মার্কিন ও রুশ করপোরেশন দুটির মধ্যে চুক্তির প্রধান লক্ষ্য কিন্তু মরুভূমি কিংবা কাদাময় ভূমিতে তেল অনুসন্ধান নয়, কারা সাগরে—যে সাগর উত্তর মেরুতে থেকে বিশেষ দূরে নয় আর আর্কটিক বৃত্তের ভেতরই অবস্থিত, বরফাচ্ছাদিত। বছরের কিছু সময়, বিশেষত শীত মৌসুমে এ সাগরের বিপুল অংশ বরফে ঢাকা থাকে। যেমনটা দেখা যায় আর্কটিক মহাসাগরের বড় অংশের ক্ষেত্রে। যে সময়ে হিমবাহ, হিমশৈল ও বরফ চাদর গলে যাওয়ার বিষয়টি বৈশ্বিক মাত্রা পেয়েছে, তখন জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর এ চুক্তির প্রভাব নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। গত চার দশকে আর্কটিকে বরফে আচ্ছাদিত থাকা এলাকা যেমন বেড়েছে, তেমনি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে বরফের পুরুত্ব। সারা পৃথিবীর মধ্যে এখানেই জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য। উষ্ণ মৌসুমে কতটা এলাকা বরফে আচ্ছাদিত থাকে, সেটাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ২০০৭ সালে গ্রীষ্ম মৌসুমে আর্কটিক অঞ্চলে বরফাচ্ছাদিত ছিল ৪০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা। তিন দশক আগে স্যাটেলাইটের সাহায্যে পরিমাপ শুরু করার সময় থেকে এখন বরফাচ্ছাদিত এলাকা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আট লাখ বছর ধরে আর্কটিক মহাসাগর কখনো বরফমুক্ত থাকেনি। অথচ কতগুলো কম্পিউটার মডেলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে চলতি শতকের ত্রিশের দশকে এসে গ্রীষ্ম মৌসুমে এ মহাসাগর পুরোপুরি বরফশূন্য থাকবে।
এমন উদ্বেগ কোম্পানি দুটির চিন্তাভাবনা থেকে অনেক দূরের; এ চুক্তি বরং আর্কটিক রাষ্ট্রগুলোর চলমান দ্বন্দ্বের চরিত্র নতুন করে গড়ার ক্ষেত্রে অভিঘাত ব্যাপক। গত দশকে পাঁচ আর্কটিক রাষ্ট্র—যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, রাশিয়া ও নরওয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দ্রুত তীব্রতর হয়েছে। আর্কটিকের মুখ্য অংশ উত্তর মেরুকে মানবজাতির সাধারণ উত্তরাধিকার গণ্য করা হতো এত দিন। এখানে কোনো আর্কটিক রাষ্ট্রের ভূখণ্ডগত অধিকার ছিল না। এখন আর্কটিক রাষ্ট্রগুলো তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের দাবি আর্কটিকের অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত করার মাধ্যমে নিজেদের অধিকার বিস্তারের জন্য বিপুল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। দূর উত্তরের তথাকথিত ‘লোমোনোসভ’ মহীসোপান প্রাকৃতিকভাবে উত্তর মেরুর অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত—এটা তারা প্রমাণ করতে চাইছে। অন্য রাষ্ট্রগুলো মামলা করেছে। আবার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হওয়ায় একেকটা রাষ্ট্র তাদের পেশিশক্তি বাড়াচ্ছে। উত্তর মেরুর ওপর দিয়ে রুশ বোমারুদের তথ্যানুসন্ধানমূলক বিমান অভিযান চালানোর খবর প্রকাশিত হয়েছে। কানাডা ও নরওয়ে উভয়েই আর্কটিকের সীমানা-বরাবর সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই দ্বন্দ্ব রাষ্ট্রগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের ক্ষুধার সঙ্গে আন্তরিকভাবে সম্পর্কিত। এখন সময়টা এমন, আর্কটিক বরফ গলার মানে হলো, রাষ্ট্রগুলোর সামনে ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ আহরণের লোভনীয় পথ খুলে যাওয়া। পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা তাই স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন।
চুক্তিতে পৌঁছার মাধ্যমে এক ধাক্কায় মার্কিন ও রুশ তেল করপোরেশন আর্কটিকের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র দুটির বিদ্যমান দ্বন্দ্বের কিছুটা ডিঙিয়ে যেতে পেরেছে। আর্কটিক অঞ্চলে সামরিক সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়ছে। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে গত কয়েক মাসে রুশ মুখপাত্ররা বারবার জোর দিয়ে বলছেন, আর্কটিক রাষ্ট্রগুলোর দ্বন্দ্ব সংযত রাখা খুবই সম্ভব। ক্রেমলিনের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পাদিত রোসনেফট ও এক্সনমবিল চুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের কথার যৌক্তিকতাই ফুটে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।
আর্কটিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সামনে যে সবচেয়ে বড় বিপদ অপেক্ষমাণ সেটাকেই। কারা সাগর ও আর্কটিক অঞ্চল থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন সম্ভব হবে কেবল জলবায়ু পরিবর্তন হলেই। আর জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ ওই জীবাশ্ম জ্বালানি। আর্কটিক কেবল জলবায়ু পরিবর্তন দৃশ্যমান হওয়ার জায়গাই নয়, এখান থেকেই আগামী দিনের বিপর্যয়ের সূত্রপাত হওয়ার ঝুঁকি আছে। জলবায়ু-বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তন থেকে জলবায়ু বিপর্যয়ে রূপান্তরের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে যে দুটি ফ্যাক্টরকে চিহ্নিত করেন, সেগুলো হয়তো ঘটবে আর্কটিক ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই। প্রথমটি, শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেন প্রচুর পরিমাণে নির্গত হওয়া। দ্বিতীয়টি, বরফে প্রতিফলিত হয়ে সূর্যরশ্মি মহাকাশে ফিরে যাওয়া, অর্থাৎ ‘আলবেদো’র অবসান। এসব কিছু ঘটলে পরে গ্রিনল্যান্ডে আর্কটিকের প্রধান বরফ স্তূপ দ্রুতগতিতে হারিয়ে যেতে থাকবে আর প্লাবিত হবে উপকূলীয় অঞ্চল।
সোজা কথায়, কারা সাগরের ব্যাপারে এই করপোরেট চুক্তির তাৎপর্য বৈশ্বিক। এ চুক্তি তেল খাতের বৃহৎ করপোরেশনগুলোর মধ্যকার শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দিয়েছে এবং আর্কটিক অঞ্চলে জীবাশ্ম জ্বালানি অনুসন্ধানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় নতুন পর্যায় শুরুর কথা বলে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই আগামী নভেম্বরে পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনের আগেই রোসনেফট-এক্সনমবিল চুক্তির সুস্পষ্ট বিকল্প একটি এজেন্ডা তৈরি করা প্রয়োজন।
রুশ পরিবেশবিষয়ক সংগঠনগুলো চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার বহু আগে থেকেই কারা সাগরে তেল অনুসন্ধানের কড়া সমালোচক। আবার এক্সনমবিলের বিরোধিতা করছেন মার্কিন পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে, বিশেষত এটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বউত্তরের রাজ্য আলাস্কায় তেল নির্গমন ঘটানোর পর থেকে। এখন দরকার মার্কিন ও রুশ পরিবেশবিষয়ক সংগঠন এবং দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক মৈত্রী গড়ে তোলা, যাতে কারা সাগর কিংবা আর্কটিকে জীবাশ্ম জ্বালানি অনুসন্ধানের যেকোনো চেষ্টা মোকাবিলা করা যায়। এমন এজেন্ডা ইতিবাচক। কেননা, এর আকাঙ্ক্ষা জলবায়ুর বিপর্যয় থেকে মানবজাতি ও পৃথিবীকে রক্ষা করা। জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন বাংলাদেশ, উপকূলবর্তী ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। এসব রাষ্ট্র কেবল তখনই টিকে থাকবে, যদি তারা একটি সাধারণ এজেন্ডা দাঁড় করাতে পারে, যার ভেতরে থাকবে আর্কটিকে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন নিষিদ্ধকরণ।
পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপীয় প্রতিনিধি।
এখানেই শেষ নয়। এ চুক্তিটাকে প্রতিদ্বন্দ্বী করপোরেশনগুলো থেকে এগিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রতিযোগিতার আরেকটি নমুনা হিসেবে পাশে ঠেলে দেওয়া যেতে পারত। তা করা যাচ্ছে না। কেননা, মার্কিন ও রুশ করপোরেশন দুটির মধ্যে চুক্তির প্রধান লক্ষ্য কিন্তু মরুভূমি কিংবা কাদাময় ভূমিতে তেল অনুসন্ধান নয়, কারা সাগরে—যে সাগর উত্তর মেরুতে থেকে বিশেষ দূরে নয় আর আর্কটিক বৃত্তের ভেতরই অবস্থিত, বরফাচ্ছাদিত। বছরের কিছু সময়, বিশেষত শীত মৌসুমে এ সাগরের বিপুল অংশ বরফে ঢাকা থাকে। যেমনটা দেখা যায় আর্কটিক মহাসাগরের বড় অংশের ক্ষেত্রে। যে সময়ে হিমবাহ, হিমশৈল ও বরফ চাদর গলে যাওয়ার বিষয়টি বৈশ্বিক মাত্রা পেয়েছে, তখন জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর এ চুক্তির প্রভাব নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। গত চার দশকে আর্কটিকে বরফে আচ্ছাদিত থাকা এলাকা যেমন বেড়েছে, তেমনি নাটকীয়ভাবে বেড়েছে বরফের পুরুত্ব। সারা পৃথিবীর মধ্যে এখানেই জলবায়ু পরিবর্তন সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য। উষ্ণ মৌসুমে কতটা এলাকা বরফে আচ্ছাদিত থাকে, সেটাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ২০০৭ সালে গ্রীষ্ম মৌসুমে আর্কটিক অঞ্চলে বরফাচ্ছাদিত ছিল ৪০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা। তিন দশক আগে স্যাটেলাইটের সাহায্যে পরিমাপ শুরু করার সময় থেকে এখন বরফাচ্ছাদিত এলাকা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আট লাখ বছর ধরে আর্কটিক মহাসাগর কখনো বরফমুক্ত থাকেনি। অথচ কতগুলো কম্পিউটার মডেলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে চলতি শতকের ত্রিশের দশকে এসে গ্রীষ্ম মৌসুমে এ মহাসাগর পুরোপুরি বরফশূন্য থাকবে।
এমন উদ্বেগ কোম্পানি দুটির চিন্তাভাবনা থেকে অনেক দূরের; এ চুক্তি বরং আর্কটিক রাষ্ট্রগুলোর চলমান দ্বন্দ্বের চরিত্র নতুন করে গড়ার ক্ষেত্রে অভিঘাত ব্যাপক। গত দশকে পাঁচ আর্কটিক রাষ্ট্র—যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, রাশিয়া ও নরওয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দ্রুত তীব্রতর হয়েছে। আর্কটিকের মুখ্য অংশ উত্তর মেরুকে মানবজাতির সাধারণ উত্তরাধিকার গণ্য করা হতো এত দিন। এখানে কোনো আর্কটিক রাষ্ট্রের ভূখণ্ডগত অধিকার ছিল না। এখন আর্কটিক রাষ্ট্রগুলো তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের দাবি আর্কটিকের অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত করার মাধ্যমে নিজেদের অধিকার বিস্তারের জন্য বিপুল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। দূর উত্তরের তথাকথিত ‘লোমোনোসভ’ মহীসোপান প্রাকৃতিকভাবে উত্তর মেরুর অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত—এটা তারা প্রমাণ করতে চাইছে। অন্য রাষ্ট্রগুলো মামলা করেছে। আবার দ্বন্দ্ব তীব্রতর হওয়ায় একেকটা রাষ্ট্র তাদের পেশিশক্তি বাড়াচ্ছে। উত্তর মেরুর ওপর দিয়ে রুশ বোমারুদের তথ্যানুসন্ধানমূলক বিমান অভিযান চালানোর খবর প্রকাশিত হয়েছে। কানাডা ও নরওয়ে উভয়েই আর্কটিকের সীমানা-বরাবর সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এই দ্বন্দ্ব রাষ্ট্রগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের ক্ষুধার সঙ্গে আন্তরিকভাবে সম্পর্কিত। এখন সময়টা এমন, আর্কটিক বরফ গলার মানে হলো, রাষ্ট্রগুলোর সামনে ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ আহরণের লোভনীয় পথ খুলে যাওয়া। পশ্চিমা পর্যবেক্ষকেরা তাই স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যাবর্তন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন।
চুক্তিতে পৌঁছার মাধ্যমে এক ধাক্কায় মার্কিন ও রুশ তেল করপোরেশন আর্কটিকের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র দুটির বিদ্যমান দ্বন্দ্বের কিছুটা ডিঙিয়ে যেতে পেরেছে। আর্কটিক অঞ্চলে সামরিক সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়ছে। এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে গত কয়েক মাসে রুশ মুখপাত্ররা বারবার জোর দিয়ে বলছেন, আর্কটিক রাষ্ট্রগুলোর দ্বন্দ্ব সংযত রাখা খুবই সম্ভব। ক্রেমলিনের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পাদিত রোসনেফট ও এক্সনমবিল চুক্তির মধ্য দিয়ে তাদের কথার যৌক্তিকতাই ফুটে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে।
আর্কটিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সামনে যে সবচেয়ে বড় বিপদ অপেক্ষমাণ সেটাকেই। কারা সাগর ও আর্কটিক অঞ্চল থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন সম্ভব হবে কেবল জলবায়ু পরিবর্তন হলেই। আর জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ ওই জীবাশ্ম জ্বালানি। আর্কটিক কেবল জলবায়ু পরিবর্তন দৃশ্যমান হওয়ার জায়গাই নয়, এখান থেকেই আগামী দিনের বিপর্যয়ের সূত্রপাত হওয়ার ঝুঁকি আছে। জলবায়ু-বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তন থেকে জলবায়ু বিপর্যয়ে রূপান্তরের চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে যে দুটি ফ্যাক্টরকে চিহ্নিত করেন, সেগুলো হয়তো ঘটবে আর্কটিক ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই। প্রথমটি, শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস মিথেন প্রচুর পরিমাণে নির্গত হওয়া। দ্বিতীয়টি, বরফে প্রতিফলিত হয়ে সূর্যরশ্মি মহাকাশে ফিরে যাওয়া, অর্থাৎ ‘আলবেদো’র অবসান। এসব কিছু ঘটলে পরে গ্রিনল্যান্ডে আর্কটিকের প্রধান বরফ স্তূপ দ্রুতগতিতে হারিয়ে যেতে থাকবে আর প্লাবিত হবে উপকূলীয় অঞ্চল।
সোজা কথায়, কারা সাগরের ব্যাপারে এই করপোরেট চুক্তির তাৎপর্য বৈশ্বিক। এ চুক্তি তেল খাতের বৃহৎ করপোরেশনগুলোর মধ্যকার শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দিয়েছে এবং আর্কটিক অঞ্চলে জীবাশ্ম জ্বালানি অনুসন্ধানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় নতুন পর্যায় শুরুর কথা বলে। এসবই জলবায়ু পরিবর্তন ত্বরান্বিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই আগামী নভেম্বরে পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনের আগেই রোসনেফট-এক্সনমবিল চুক্তির সুস্পষ্ট বিকল্প একটি এজেন্ডা তৈরি করা প্রয়োজন।
রুশ পরিবেশবিষয়ক সংগঠনগুলো চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার বহু আগে থেকেই কারা সাগরে তেল অনুসন্ধানের কড়া সমালোচক। আবার এক্সনমবিলের বিরোধিতা করছেন মার্কিন পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে, বিশেষত এটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বউত্তরের রাজ্য আলাস্কায় তেল নির্গমন ঘটানোর পর থেকে। এখন দরকার মার্কিন ও রুশ পরিবেশবিষয়ক সংগঠন এবং দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক মৈত্রী গড়ে তোলা, যাতে কারা সাগর কিংবা আর্কটিকে জীবাশ্ম জ্বালানি অনুসন্ধানের যেকোনো চেষ্টা মোকাবিলা করা যায়। এমন এজেন্ডা ইতিবাচক। কেননা, এর আকাঙ্ক্ষা জলবায়ুর বিপর্যয় থেকে মানবজাতি ও পৃথিবীকে রক্ষা করা। জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন বাংলাদেশ, উপকূলবর্তী ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। এসব রাষ্ট্র কেবল তখনই টিকে থাকবে, যদি তারা একটি সাধারণ এজেন্ডা দাঁড় করাতে পারে, যার ভেতরে থাকবে আর্কটিকে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন নিষিদ্ধকরণ।
পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপীয় প্রতিনিধি।
No comments