আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৩০)-'রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা' by আলী যাকের

ঢাকায় থাকতে যে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মহিলা ডাক্তার মাকে দেখেছিলেন, তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন, মায়ের ক্যান্সারই হয়েছে। কলকাতা পেঁৗছার পর আমার নানা এবং দুই খালা বললেন, 'ঢাকার ডাক্তার আবার কী জানে? মার ক্যান্সার হয়নি।' যাহোক, সেখানে আমরা একজন বিখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে মাকে নিয়ে গেলাম।


তিনি বায়োপসি করিয়ে নিশ্চিত হলেন, মায়ের ক্যান্সারই হয়েছে। এই বিশেষ ডাক্তার ছিলেন একজন শল্য চিকিৎসক। তিনি বললেন, 'অপারেশন করা সম্ভব, তবে সময় লাগবে।' কেননা ইতিমধ্যেই মায়ের ক্যান্সার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর আমরা আরো বিস্তারিত জানার জন্য কলকাতার ভবানীপুরে অবস্থিত চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে মাকে নিয়ে গেলাম। সেখানে তারা বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, দুই রকম চিকিৎসা মায়ের জন্য উন্মুক্ত আছে_১. শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া, ২. রেডিয়াম থেরাপি। এই রেডিয়াম থেরাপি সম্পর্কে আজকাল আর বিশেষ শোনা যায় না। তখন এটা বেশ চালু ছিল এবং অনেকেই অপারেশন না করিয়ে এই চিকিৎসা করাতেন। এই চিকিৎসায় আক্রান্ত স্থানের আশপাশে রেডিয়াম নিডল বিঁধিয়ে রাখা হতো বেশ কিছু সময়। তারপর রেডিয়েশন দেওয়া হতো আক্রান্ত স্থানে। আমার গুরুজনরা সবাই অপারেশনকে ভয় পেতেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন, মাকে রেডিয়াম থেরাপিই করানো হবে। ১৯৬২ সালে, যখন আমি কলেজের ছাত্র এবং এই কর্কট রোগ সম্পর্কে খুবই সীমিত আমার জ্ঞান, তখন আমার পক্ষে এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। অতএব, আমি সবার সঙ্গে একমত হলাম, হয়তো বা শল্য চিকিৎসার বিকল্পটিই সঠিক চিকিৎসা হবে। পরে অবশ্য আমার বড় মামার এক বন্ধু, যিনি কলকাতার প্রখ্যাত সার্জন ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, অপারেশন করে জরায়ুটা বাদ দিয়ে দিলে সেটাই হতো উত্তম পন্থা।
যাহোক, মাকে দীর্ঘ তিন মাস ধরে রেডিয়াম থেরাপি দেওয়া হলো। আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে আমার উচ্চ মাধ্যমিকের ফল বের হলো। আমি ভালোভাবেই ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। ওই তিন মাস আমার দিদি মায়ের কাছে ছিলেন। চিকিৎসার শেষ দিকে মায়ের রোগ প্রায় সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে ঝুনু কলকাতায় গেল। আমার বড় ভাইয়ের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কেননা সদ্যই তিনি চাকরিতে যোগ দেওয়ায় তাঁর কোনো ছুটি প্রাপ্য ছিল না। এরপর দিদি ও ঝুনু দুজনে মিলে মাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এল। দীর্ঘদিন পর মায়ের হাসিমুখ দেখে আমাদের আনন্দ আর ধরে না। সংসারের সম্রাজ্ঞী ফিরে এসেছেন তাঁর সাম্রাজ্যে। আবার তিনি সব কিছুর হাল ধরলেন। বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগল_খাওয়া-দাওয়া, হৈচৈ, আড্ডা। আমি ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। আমার সাবসিডিয়ারি ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য। আমাদের সময় ইংরেজি সহজপাঠ ধরনের একটি প্রায় হাস্যকর কোর্স আমাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে করতে হতো, যার নাম ছিল 'ফাংশনাল ইংলিশ'। আমার সৌভাগ্য, এ বিষয়টির অনেক কিছুই বাবার ঘরোয়া শিক্ষাদানের কল্যাণে আমার আয়ত্তে এসে গিয়েছিল। এই সময়টায় মা, বাসার কাজকর্ম, খেলাধুলা এবং প্রান্তিক মুকুল মেলার কাজ নিয়ে আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। মায়ের জটিল রোগের কারণে আমার কোনো এক বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধুর পরামর্শে আমি ওই সময় রবীন্দ্রনাথের গান এবং কবিতার গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করি। ওই বয়সেও মায়ের কাছে এলেই রবীন্দ্রনাথের 'বীরপুরুষ' কবিতাটি আমার খুব মনে পড়ত। সেই যে বিখ্যাত লাইনগুলো_"রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা/এমন কেন সত্যি হয় না আহা/ঠিক যেন এক গল্প হত তবে/শুনত যারা অবাক হত সবে/দাদা বলত, 'কেমন করে হবে/খোকার গায়ে এত কি জোর আছে'/পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে/ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।" আমার মনে হতো, যদি আমার শক্তি থাকত, তাহলে মায়ের সব অসুখ উপড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলতাম। কিন্তু সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা/এমন কেন সত্যি হয় না আহা?' কাজেই আমার মনের ইচ্ছা মনেই চেপে রাখতে হলো। এ সময় রবীন্দ্রনাথ এবং মৃত্যুচিন্তা নিয়েও আমি অনেক লেখাপড়া করেছি। কেন যে পড়েছি, আমি নিজেও জানি না। হয়তো এমন হয়েছিল, মায়ের দুরারোগ্য ব্যাধির কারণে প্রথমবারের মতো মনে হয়েছিল, মৃত্যু অনিবার্য। অথচ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই শিখেছি, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে একটি অতি ক্ষীণ ভেদরেখা রয়েছে। অতএব, জীবন থেকে মৃত্যুতে রূপান্তর অতি স্বাভাবিক একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.