নিত্যজাতম্‌-হে ক্ষণিকের অতিথি by মহসীন হাবিব

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল জেএফআর জ্যাকব ঢুকলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট পাকিস্তানের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির কক্ষে। সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার। জ্যাকব সঙ্গে করে আনা আত্মসমর্পণের দলিলটি নিয়াজির সামনে বাড়িয়ে ধরলেন।


নিয়াজি সেটি পড়লেন। তারপর বললেন, তাহলে এটি একটি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দলিল?
জ্যাকব : না, একেবারে নিঃশর্ত নয়। আমরা এই চুক্তিতে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেছি। জেনারেল, আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, যদি এ শর্তগুলো মেনে নেন, তাহলে আমরা আপনাদের হেফাজত করব। আমি তা নিশ্চিত করব। ভারতের সরকার কথা দিয়েছে আপনাদের নিরাপত্তা বিধানের। আপনি যদি রাজি না হন, তাহলে পরিণতির জন্য আমরা দায়ী থাকব না। আমরা কোন দায়িত্ব নেব না।
জেনারেল নিয়াজি কিছু কথা বলতে থাকলেন। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে জ্যাকব বললেন, এর চেয়ে ভালো কোনো শর্ত আমি আপনাকে দিতে পারছি না। আমি আপনাকে ৩০ মিনিট সময় দিচ্ছি। আপনি যদি রাজি না হন আমার যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার আদেশ দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না (হড় ড়ঢ়ঃরড়হ নঁঃ ঃড় ড়ৎফবৎ ৎবংঁসঢ়ঃরড়হ ড়ভ যড়ংঃরষরঃরবং)।
লে. জেনারেল জ্যাকব ৩০ মিনিটের জন্য বাইরে বের হয়ে গেলেন। চিন্তা করলেন, হায় ঈশ্বর, যদি নিয়াজি রাজি না হন, তাহলে কী করা যাবে? কী উপায় হবে! ঢাকায় পাকিস্তানের ৩০ হাজার সেনার বিরুদ্ধে রয়েছে ভারতের মাত্র তিন হাজার সেনা! (পাকিস্তান বাহিনী এ খবর জানতে পেলে হয়তো একটি ভারতীয় সেনাও বেঁচে থাকত না)
ঠিক ৩০ মিনিট পর তিনি আবার নিয়াজির কক্ষে প্রবেশ করলেন। দলিলটি নিয়াজির সামনে টেবিলের ওপর পড়ে আছে। জ্যাকব বললেন, আপনি কি রাজি?
নিয়াজি নিরুত্তর।
জ্যাকব : আপনি রাজি?
নিয়াজি নিরুত্তর।
জ্যাকব : আপনি কি রাজি?
নিয়াজি নিরুত্তর।
জ্যাকব : (দলিলটি হাতে তুলে নিয়ে) আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি রাজি আছেন।
স্বেচ্ছায় বাঙালিদের দমন করতে আসা নিয়াজি এবার কেঁদে ফেললেন।
এটি কোনো কাল্পনিক সংলাপ নয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল স্যাম হরমুসজি ফ্রামজি জামসেদজি মানেকশ' লে. জেনারেল জ্যাকবকে টেলিফোনে বলেন, ঢাকা যাও, আত্মসমর্পণের কাজটি সম্পন্ন কর।
জ্যাকব : কিন্তু আমি যে আত্মসমর্পণের খসড়াটি আপনার কাছে পাঠিয়েছি, সেটি অনুসারেই কি হবে?
ম্যানেকশ : তুমি শুধু যাও। তুমি ভালো করেই জানো কী করতে হবে।
জ্যাকব ঢাকায় চলে আসেন। সব ভয়, শঙ্কা পেছনে ফেলে রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট শহরকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকার দিকে ছুটে এসেছে। ঢাকায় ৩০ হাজার পাকিস্তানি নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিপক্ষে মাত্র তিন হাজার সেনা ঢাকার দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করেছে। জেনারেল নাগ্রা সন্ধর্ব আগে থেকেই নিয়াজিকে জানতেন। দুজনের পরিচয় ছিল। তিনি ছোট একটি চিরকুট পাঠিয়েছেন নিয়াজিকে, জানিয়েছেন, ডিয়ার নিয়াজি, আই অ্যাম হিয়ার।
অসীম সাহসিকতার সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ ঝুঁকির মধ্যে নিজেদের ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার তাগিদ অনুভব করেছিল। রাশিয়া পোল্যান্ডের ইস্যুতে জাতিসংঘে ব্যস্ত। তারা ভারতকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে আর ভেটো দিতে পারবে না। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা ঝুঁকে পড়েছেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভের দিকে। রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের চাপে মানেকশ জ্যাকবকে বললেন, তিন ব্রিগেড সৈন্য পিছিয়ে নিতে। কিন্তু কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী এবং দার্জিলিংয়ে লেখাপড়া করা জ্যাকব তা শুনলেন না। কুমিল্লা এবং যশোর মুক্ত করতে অনেক ভারতীয় সেনাকে জীবন দিতে হয়েছে। এভাবে শহর থেকে শহর মুক্ত করতে গেলে একদিকে হবে ভয়াবহ রক্তক্ষয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আদেশ আসবে যুদ্ধবিরতির। তখন বাঙালির স্বাধীনতা হয়ে পড়বে সুদূরপরাহত। সুতরাং মরণ হাতে নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাইতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, আমাদের স্বাধীনতায় ভারত যে অবদান রাখল, তা কী করে ভুলি?
এই ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্তমান প্রধান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীর মুক্তিযোদ্ধা ভি কে সিং ঢাকা সফর করে গেলেন। তিনি ১৯৭১ সালে ছিলেন তরুণ লেফটেন্যান্ট। সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার ও ফেনীতে। তিনি তাঁর সফরে বাংলাদেশের জন্য সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ১৯৭১ সালে যুদ্ধে ব্যবহৃত দুটি কামান। তাঁর এ সফরকেও কিছু মানুষ ভারতের প্রতি আনুগত্য বলে দেশবাসীকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। এ কি কৃতঘ্নতার পরিচয় নয়?
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, জলসীমা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, পানিবণ্টন, বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ভারতের কিছু বাণিজ্যিক মনোভাব, কিছু সংকীর্ণতা দায়ী বটে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে ভারতকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলার উৎস সেখানে নয়। এর গভীরে রয়েছে ভারতবিদ্বেষ, অন্য কথায় পাকিস্তান-প্রীতির রাজনীতি। রয়েছে প্রতিবেশীর প্রতি ছড়িয়ে দেওয়া হিংসা ও বিদ্বেষ। এ দেশের রাজনীতির বাস্তবতা হলো, ভারত বিদ্বেষকেই যাঁরা দেশপ্রেমের মানদণ্ড হিসেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাঁরা দেশপ্রেমিক নন, পাকিস্তানপ্রেমী। এর ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। বাংলাদেশে যারা প্রতিবেশী বিশাল রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে উন্নয়নবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি না করে উসকানিমূলক আচরণ করেছেন এবং করছেন, তারা গুনে গুনে একটি একটি করে রাজাকার, আলবদর তুলে এনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, মন্ত্রী বানিয়েছেন। সত্তরের দশকের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ভারতের বিরুদ্ধে বিষ বপনে সহায়তা করেছিল। কারণ, তখন ভারত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই যুক্তরাষ্ট্রের এখন ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক। কিন্তু আমরা আমাদের বন্ধ্যত্ব ঘোচাতে পারিনি।
যদিও সীমান্তে ফেলানীর মৃত্যু নিয়ে ভারত পরে দুঃখ প্রকাশ করেছে, কিন্তু সে দুঃখ প্রকাশই শেষ কথা নয়। এত বড় অমানবিক কাণ্ড ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা করতে পারে না। একটি বন্ধু মনোভাবাপন্ন সরকার ক্ষমতায়, যারা ভারতের একাধিক রাজ্যে 'রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায়' যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সহায়তা করেছে, সেই দেশের একটি নিরপরাধ বালিকাকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা কেন গুলি করে হত্যা করল, তা আজও আমার কাছে বোধগম্য নয়। সীমান্তে দুই দেশের রক্ষীদের মধ্যে মাঝেমধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তার পেছনে সব সময় যে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন থাকে, তা নয়। ব্ল্যাক মার্কেটিং, চোরাই পথে গরু আমদানির বাণিজ্যও এর পেছনে কাজ করে। কিন্তু ফেলানীকে হত্যা এসবের অংশ হতে পারে না।
মাত্র দুই দিন আগে কাজ শেষে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাছাকাছি কয়েকজন মাইক্রোবাসের চালক দাঁড়িয়ে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আলোচনা করছিলেন। একজন গাড়িচালকের নিকটজন নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। সেই চালক অভিযোগ করে বলছেন, এ নির্বাচন কোনোক্রমেই সুষ্ঠু হচ্ছে না। আমরা অবাক হয়ে শুনলাম তিনি তাঁর বক্তব্যের একটি পর্যায়ে জুড়ে দিলেন, বাংলাদেশের এসব অনিয়মের পেছনে রয়েছে ভারত।
নিঃসন্দেহে ভারতের সঙ্গে আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিয়ে একটি বন্ধুত্ব চাই। নিজেরা সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ করব এবং ভারতের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ প্রত্যাশা করব। কিন্তু পাঠক, এমন বিষ-বিদ্বেষ সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়া কি আপনি সমর্থন করতে পারেন যে, আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তার জন্যও ভারত দায়ী?
পুনশ্চ : এই লেখাটি যেদিন প্রকাশ হবে সেদিন ফিল্ড মার্শাল মানেকশর মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৮ সালের ২৭ জুন তিনি ৮৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কয়েক বছর আগে পাকিস্তানের সাবেক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের ছেলে গওহর আইয়ুব অভিযোগ করেছেন, মানেকশ পাকিস্তানের কাছে গোপন দলিল বিক্রি করেছেন। আমরা যদি মানেকশর সারা জীবনের বর্ণিল কর্মক্ষেত্র ও কৃতিত্বের দিকে না তাকিয়ে গওহর আইয়ুবের অভিযোগের দিকেই মনোনিবেশ করে থাকি, তাহলে কি মানেকশর প্রতি অবিচার করা হবে না?
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.