খাদ্যে ভেজাল আর বিষ-উৎস সন্ধান ও কঠোর প্রতিকার জরুরি
'কত কিছু খাই ভস্ম আর ছাই'_ডি এল রায়ের (দ্বিজেন্দ্র লাল রায়) বিখ্যাত এই গানের পঙ্ক্তির সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের অমিল খুঁজে পাওয়া ভার। বাজারে মাছ, শাকসবজি থেকে শুরু করে ফলমূল, এমনকি নিত্যদিনের সাধারণ খাবার দ্রব্য বিষ আর ভেজালে সয়লাব।
এর ফলে শুধু জনস্বাস্থ্যই মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েনি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। শারীরিক নানা রকম জটিল অসুখে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ মহল থেকে নবজাতক শিশু পর্যন্ত বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেওয়ার মতো উদ্বেগজনক সতর্কবার্তা শোনানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অপকর্ম ব্যবসায়ী নামের এক শ্রেণীর অসাধু নিজেদের লাভালাভের অঙ্ক কষে জীবনবিনাশী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। ২৫ জুন কালের কণ্ঠে 'ভেজাল আর বিষে ভরা খাদ্য' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নতুন কিছু তথ্যচিত্র তুলে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, এর ফলে সংগতভাবেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মানুষ বাঁচবে কী করে? একই দিন কালের কণ্ঠের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকাশ, বিএসটিআইয়ের নজরদারির বাইরে রয়েছে অনেক খাবার। রাসায়নিক মেশানো ছাড়া কোনো ফল নেই বাজারে। ভেজাল শনাক্তকরণে কাজে লাগছে না সায়েন্স ল্যাব। আমরা জানি না সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল এসব বিষয়ের সুরাহা কিভাবে করবে।
ব্যক্তিগত লাভ কিংবা হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণের জন্য মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে, নিজেকে কতটা পশুর কাতারে নিয়ে যেতে পারে এর দৃষ্টান্ত অহরহ মিলছে। খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন ও কার্বাইড মেশানোর নিত্য প্রমাণ মিলছে। নিকট-অতীতে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ এ ব্যাপারে আদালতে একটি রিট করেছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ যে নির্দেশনা জারি করেছিলেন, তাও উপেক্ষিত হয়েছে, বিদ্যমান চিত্র আবারও সেটাও প্রমাণ করে। এই ভেজালের উৎস সন্ধানের নির্দেশ জারি করে আদালত সংশ্লিষ্ট মহলগুলোকে কঠোর প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও বলেছিলেন। কখনো কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালতের যে কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা টোটকা দাওয়াইয়ের মতো। স্থায়ী সমাধানকল্পে আমদানীকৃত পণ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ ও বিক্রয়ব্যবস্থা পর্যন্ত স্তরে স্তরে কঠোর নজরদারি দরকার।
ভেজালবিরোধী অভিযান জোরদারভাবে অব্যাহত রাখার পাশাপাশি আমদানীকৃত কিংবা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যের গুণগতমান যাচাই ও সংরক্ষণে যথাযথ পরিকল্পিত কঠোরতা দরকার। এসব নিয়ে এ যাবৎ কথা হয়েছে বিস্তর; কিন্তু কাজের কাজ যা হয়েছে তা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের বসবাস দারিদ্র্যসীমার অনেক নিচে। আবার বেশির ভাগ মানুষ অচেতন ও অক্ষরজ্ঞানহীন। এসব মানুষ নিত্য নানা ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং জীবন-মরণসংক্রান্ত এত বড় বিষয় সম্পর্কে কথার ফুলঝুরি না ছড়িয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, এরই পরিকল্পিত আরো উদ্যোগ দরকার। মনে রাখা দরকার, মানবদেহে প্রতিগ্রাম রক্তে বিষের সহনীয় মাত্রা হলো শূন্য দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম, অথচ গবেষণায় জানা গেছে, ৯ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বিষ মানুষের দেহে ঢুকছে খাদ্যপণ্যের মাধ্যমে! এরপর মানুষ সুস্থ থাকতে পারে কি? গবেষণায় রক্তে বিষের যে পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে, তা স্বাভাবিকের তুলনায় এত বেশি যে কল্পনা করতেও ভয় হয়। মানুষের জীবন নিয়ে এ ভয়ংকর অপতৎপরতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তা না হলে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকারের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। যেসব অসাধু সচেতনভাবে এ ধরনের অপক্রিয়ায় লিপ্ত তাদের সামাজিক শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতেই হবে। মানুষের জীবন নিয়ে এমন নৈরাজ্য বরদাশত করা যায় না।
No comments