নেত্রকোনায় ‘যথেচ্ছ’ সাদা মাটি উত্তোলন-নেই নজরদারি বা নীতিমালা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবেশ, পর্যটন by শরিফুল হাসান

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। নেই সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর তদারকি। দীর্ঘদিন ধরে নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন টিলা ও খনি কেটে সাদা মাটি তোলা হচ্ছে এভাবেই। এর ফলে সরকার যেমন যথাযথ রাজস্ব পাচ্ছে না, তেমনি বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও পর্যটন-সম্ভাবনা।


খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর ১৯৫৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, এ এলাকায় সাদা মাটি বা চীনামাটির মজুদ ২৪ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। এটি বাংলাদেশের ৩০০ বছরের চাহিদা পূরণে সক্ষম বলে তখন বলা হয়েছিল।
সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয় দুর্গাপুরের সাদা মাটি। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকার খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো থেকে অনুমতি নিয়ে এই মাটি সংগ্রহ করছে। তবে ঢাকার বাইরে ব্যুরোর কোনো দপ্তর না থাকায় কী পরিমাণ মাটি কাটা হচ্ছে, তা দেখার কেউ নেই। অভিযোগ রয়েছে, এ সুযোগে ইচ্ছামতো সাদা মাটি তোলা হচ্ছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অনেকবার আপত্তি তুললেও দুর্গাপুরের সাদা মাটির টিলা কাটা বন্ধ বা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আসেনি। এ নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা স্থবির হয়ে পড়েছে। বিভ্রান্তি রয়েছে পাহাড় কাটাসংক্রান্ত আইনের প্রয়োগ নিয়েও।
অতিরিক্ত মাটি তোলার অভিযোগ: স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসীর অভিযোগ, অনুমতির চেয়ে বেশি মাটি তুলছে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো।
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ১০টি প্রতিষ্ঠান অনুমতি নিয়ে দুর্গাপুরের সাদা মাটি তুলে থাকে। এগুলো হলো: তাজমা সিরামিক, ইনসুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি, পিপলস সিরামিক, জাকের রিফ্র্যাক্টরি অ্যান্ড টাইলস এন্টারপ্রাইজ, মোমেনশাহী সিরামিক অ্যান্ড গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ, চায়না বাংলা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ফু-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ, জার্ডিন ইন্টারন্যাশনাল, বেঙ্গল ফাইন সিরামিক এবং মেসার্স এস আর ইন্টারন্যাশনাল। অভিযোগ আছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও স্থানীয় একটি মহল অনুমতি ছাড়াই মাটি কেটে বিক্রি করছে।
সমস্যা হচ্ছে, অনুমতি নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকৃতই কী পরিমাণ মাটি উত্তোলন করছে, তা নির্ণয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ এলাকার অনেকেরই দাবি, এ ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার চলছে।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ওজন স্কেল ও তল্লাশি চৌকি করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো, স্থানীয় সাংসদসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অনেকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কোনো কাজ হয়নি।
দুর্গাপুর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল সায়াদাৎ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানকার সাদা মাটির পাহাড় ও টিলাগুলো দেখতে অনেক পর্যটক আসে। কিন্তু এগুলোতে যেন এখন লুটপাট চলছে। যে যেভাবে পারছে, সব সাদা মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানিগুলো ঢাকা থেকে অনুমতি নিয়ে আসে। আমাদের শুধু অনুলিপি দেওয়া হয়। ফলে কী পরিমাণ মাটি তোলা হচ্ছে, কীভাবে তোলা হচ্ছে, সে সব আমরা জানি না।’
খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, সাদা মাটি তোলার অনুমতি দেওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশের ক্ষতি না করা, এলাকার রাস্তাঘাট নষ্ট না করাসহ নয়টি শর্ত দেওয়া হয়। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, অনবরত বহু ট্রাকের চলাচল এলাকার নৈসর্গিক পরিবেশ ও সৌন্দর্য তো বটেই, রাস্তারও ক্ষতি করছে।
আদিবাসী উচ্ছেদের অভিযোগ: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্থানীয় আদিবাসী প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেছেন, সাদা মাটির জন্য অনেক আদিবাসীকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আদিবাসীরা এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনে অভিযোগও দিয়েছেন।
১ নম্বর কুল্লাগড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুর রহমান পাঠান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার এলাকায় নয়টি খনি এলাকা আছে। এক একটি খনি এলাকায় চার-পাঁচটি টিলা আছে। এগুলো ইচ্ছামতো কেটে ফেলা হচ্ছে। এখানে অনেক আদিবাসী থাকত। তাদের অনেককেই টাকা-পয়সা দিয়ে বা জোর করে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’
চার বছরেও তৈরি হয়নি সুপারিশমালা: সাদা মাটি সুষ্ঠু ও নিয়ন্ত্রিতভাবে সংগ্রহ ও সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সুপারিশমালা তৈরি করার জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালের ১০ জুন উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিতে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, খনিজ সম্পদ বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং সিরামিক ব্যবসায়ী মহলসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতিনিধি রাখা হয়। তবে চার বছর হলেও ওই কমিটি এখনো সুপারিশমালা তৈরি করতে পারেনি।
পরিবেশ আইন মানা হচ্ছে না: ২০১০ সালে পাস হওয়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে যেকোনো ধরনের পাহাড় ও টিলা কাটা অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই আইন পাসের পরও দুর্গাপুরের টিলা কাটা চলছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে মাটি কাটা সম্পর্কে জানতে চাইলে সিরামিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সচিব জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের পাহাড় বা টিলা কাটা যাবে না। কিন্তু সেখানে বলা হয়নি খনিজ সম্পদ থাকলে সে ক্ষেত্রে কী করা হবে। ফলে বিষয়টি নিয়ে আমরাও সমস্যায় পড়ছি। সরকারের এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করা জরুরি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ আইন অনুযায়ী সব ধরনের পাহাড় ও টিলা ‘কর্তন ও মোচন’ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। জরুরি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অনুমতি দেওয়া হলেও সে জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু দুর্গাপুরে কাউকে এ ধরনের কোনো ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। কাজেই খতিয়ে দেখে এ ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: খনিজ সম্পদ ব্যুরোর কর্মকর্তারা বলছেন, লোকবলের অভাবে তাঁদের পক্ষে নেত্রকোনার কার্যক্রম দেখভাল করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ, ব্যুরোর সব মিলিয়ে কর্মকর্তা মাত্র সাতজন। ব্যুরোর পরিচালক আবু মো. নূর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নেত্রকোনায় কী হচ্ছে সেটি আমরা সার্বক্ষণিকভাবে দেখতে পাই না। তবে আমরা সীমিত সাধ্য নিয়েও চেষ্টা করি। মাঝেমধ্যেই আমাদের কর্মকর্তারা সেখানে যান।’
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক আনিস মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেখানে কোনো ওজনস্কেল নেই। চেকপোস্ট নেই। ফলে সবকিছু তদারকি করা সম্ভব হয় না। তার পরও আমরা চেষ্টা করি। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা করার জন্য আমরা খনিজ সম্পদ ব্যুরোতে প্রস্তাব দিয়েছি।’

No comments

Powered by Blogger.