আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬৪)-শহর ছেড়ে গ্রামে by আলী যাকের
২৯ তারিখ ঢাকা ছেড়েছিলাম জিঞ্জিরার উদ্দেশে। আমাদের রাজারবাগের বাড়িতে একটা তালা ঝুলিয়ে দিয়ে আমি, ভাইয়া, ভাবি, সঙ্গে আমার দুলাভাই আবুল খায়ের, যিনি '৭০-এর নির্বাচনে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমার বড় খালাতো বোন, তাঁদের বাচ্চারা, আমার ছোট বোন, বোনাই ও তাদের এক মেয়ে, আমার দিদির মেয়ে মুনাসহ দুবার
পেঁৗছলাম বুড়িগঙ্গার ধারে। আমার বন্ধু লিটু আমারই বঙ্ওয়াগন গাড়িটিতে করে আমাদের পেঁৗছে দিল লালকুঠির পেছনে। আমি শেষ দফায় এসেছি। তখনো পাকিস্তানি সেনারা বুঝে উঠতে পারেনি যে লোকজন সবাই ত্রাসে শহর ছাড়ছে। কিন্তু আমি যখন আসি, আমাদের গাড়িটা থামিয়ে ওরা জিজ্ঞেস করল, 'কাহা যা রাহা?' আমি তাকে বলেছিলাম, 'দারিয়াকে উছ পার আপনা ঘর যা রাহা।' আমাদের ছেড়ে দিয়েছিল। নদীর ধারে লিটু আমায় জিজ্ঞেস করল, 'গাড়িটাকে কোথায় রাখব?' আমি আনমনে বলেছিলাম, 'যেখানে ইচ্ছা সেখানে অথবা পথে ফেলে দিলেও আমার কিছু যায় আসে না।' আমরা কয়েকজন একটা ছোট নৌকায় উঠে বুড়িগঙ্গা পার হচ্ছি আর আমি মনে মনে ভাবছি, এ শহরে আর নয়। যেখানে খুশি সেখানে পালিয়ে যাব। এ দেশেও আর নয়। কোনোমতে যদি সীমানা পেরোতে পারি, তাহলে ভারতে গিয়ে প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাব, তাও ভালো। কিন্তু পাকিস্তান পদানত এ শহরে আর নয়। তখনো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার কথা মনে আসেনি। ওদের যে নিষ্ঠুরতা দেখেছি গত তিন দিন, তার সঙ্গে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির যুদ্ধ করে জেতা প্রায় অসম্ভব। বুড়িগঙ্গার ওপারে জিঞ্জিরা উপশহরে একরাত কাটিয়ে আমরা দীর্ঘপথ হেঁটে পরদিন প্রায় মধ্যরাতে একটি খালের পাশে পেঁৗছলাম। দলে আমরা তখন ২৬ জন এবং সবাই আমার আত্মীয়। খালটির সঠিক নাম এ মুহূর্তে আর মনে পড়ছে না। তবে এ খালটি গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে পড়ে। ততক্ষণে মনস্থির করে ফেলেছি যে আমরা সবাই আমার গ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত রতনপুরে আপাতত আশ্রয় নেব। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বোধ হয় অত দূর পর্যন্ত পেঁৗছায়নি।
পরদিন একটা বিশাল গয়না নৌকা ভাড়া করে আমরা সবাই তার ছৈয়ের নিচে আশ্রয় নিলাম। নৌকা যাত্রা শুরু করল শীতলক্ষ্যার দিকে। আমাদের পথ শীতলক্ষ্যা হয়ে মেঘনা এবং মেঘনার একটি লঞ্চঘাট মানিকনগর। এই মানিকনগর থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। পথে এক রাতের যাত্রাবিরতি দিতে হলো আমাদের। কেননা তখনো যন্ত্রচালিত নৌকা চালু হয়নি আমাদের এখানে। আমরা দাঁড়টানা নৌকায় গিয়েছিলাম। সুতরাং দীর্ঘ সময় লেগেছে আমাদের মানিকনগর পেঁৗছতে। রাতের বেলায় মেঘনা নদীর একটি খাঁড়ির ভেতর ঢুকে এক চালকলের চাতালে আমরা উন্মুক্ত আকাশের নিচে শুয়ে রাত কাটিয়েছি। পাশ ফিরেই দেখি, উত্তরের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। বুঝলাম, আজও ঢাকা জ্বলছে। ঠিক যেমন জ্বলছিল ২৫ মার্চ রাতে। এখানে একটু ওই রাতের ধ্বংসযজ্ঞের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিই।
ওই রাতে রাজারবাগ আর পিলখানা ছাড়াও ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ঢাকার কয়েকটি বাজারে। ভস্মীভূত হয়েছিল ওইসব বাজার। ঠাটারিবাজারের অবস্থা তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ২৯ তারিখে ঢাকা ত্যাগ করার আগে, সদরঘাটে যাওয়ার পথে। ওইসব বাজারের মধ্যে শুয়ে থাকা অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ওই রাতে। আগুনে না পুড়লেও বাজার থেকে প্রাণ ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এলে পাকিস্তানিদের গুলির শিকার হয়েছে তারা। সদরঘাটের লঞ্চঘাটে যেসব যাত্রী ওই রাতে শুয়েছিল ভোরবেলা লঞ্চ ধরবে বলে, তাদেরও নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তখন ভিক্টোরিয়া পার্কে একটি স্ট্যান্ড ছিল। সেখানে দাঁড়াত পুরনো বেশ কিছু ট্যাঙ্।ি ট্যাঙ্রি ড্রাইভাররা তাদের গাড়ির ভেতরেই সিটের ওপর ঘুমাত। তাদের সেখানেই হত্যা করা হয়। এ ছাড়া রিকশাওয়ালাকে রিকশায়, মুদি দোকানদারকে দোকানে, বস্তিবাসীদের বস্তির ভেতরে অবলীলায় হত্যা করা হয় ওই রাতে। সব বস্তি পুড়িয়ে ফেলা হয়। ওই রাতে খোলা আকাশের নিচে চালকলের চাতালের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি, পোড়ানোর আরো কোনো জায়গা তাহলে রয়ে গিয়েছিল বাকি? মনটা ভারী হয়ে আসে। তারপর কখন ক্লান্ত শরীর ঢলে পড়ে ঘুমে। ভোরের প্রথম আলো চোখে এসে পড়তেই আমরা সবাই হুড়মুড় করে জেগে উঠি। নৌকা আবার রওনা হয় গন্তব্যের পথে। গুড়, মুড়ি দিয়ে নাশ্্তা সারি আমরা। সামান্য কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘনা-বক্ষ থেকে লক্ষ করি, দুই পাড়ে চট্টগ্রামের রাস্তার ওপর মেঘনার ফেরিঘাট। সেখানে খাকি পোশাকে সৈন্যদের দেখা যায়। আমার বড় ভাইয়ের নির্দেশে আমরা সবাই নৌকার ছাউনির ভেতরে গুটিসুটি মেরে স্থান করে নিলাম। বলা যায় না, হয়তো আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে পারে। মাঝি নৌকা বেয়ে চলে। পথে কোনো বিপদ হয় না আর। আমরা বিকেল ৪টার দিকে মানিকনগর পেঁৗছি। এরপর হাঁটা। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের গ্রামের পশ্চিমে ধান ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে যখন হাঁটছি, তখন দূরে বিন্দুর মতো দুজন মানুষকে দেখতে পাই। আমার সবচেয়ে বড় জ্যাঠাতো ভাই, যাকে আমরা সেজদা ডাকতাম, তিনি এবং তাঁর সার্বক্ষণিক সহচর সুন্দর আলী সরদার দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। আমার সেজদার গায়ে জড়ানো সুতির চাদরটি মাটিতে লুটাচ্ছে। তিনি আমাদের কাছে এসে আমাদের আলিঙ্গন করলেন এবং বলতে লাগলেন যে আমি তো ভেবেছিলাম আমার পরিবারের সবাই ঢাকায় মারা পড়েছে। আমরা বাড়িতে পেঁৗছার পর হারিকেনের আলোয় সবাই আমাদের পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। আমাদের ঘিরে রতনপুরবাসী অনেকেই নানা রকম গল্প শুনতে চাইছে। সবারই মনে শঙ্কা। কেননা সবারই কেউ না কেউ রয়েছে ঢাকা শহরে। যদিও গ্রামের ত্রিসীমানার মধ্যে তখনো পাকিস্তানি আর্মি আসেনি, কিন্তু আসতে কতক্ষণ?
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
পরদিন একটা বিশাল গয়না নৌকা ভাড়া করে আমরা সবাই তার ছৈয়ের নিচে আশ্রয় নিলাম। নৌকা যাত্রা শুরু করল শীতলক্ষ্যার দিকে। আমাদের পথ শীতলক্ষ্যা হয়ে মেঘনা এবং মেঘনার একটি লঞ্চঘাট মানিকনগর। এই মানিকনগর থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। পথে এক রাতের যাত্রাবিরতি দিতে হলো আমাদের। কেননা তখনো যন্ত্রচালিত নৌকা চালু হয়নি আমাদের এখানে। আমরা দাঁড়টানা নৌকায় গিয়েছিলাম। সুতরাং দীর্ঘ সময় লেগেছে আমাদের মানিকনগর পেঁৗছতে। রাতের বেলায় মেঘনা নদীর একটি খাঁড়ির ভেতর ঢুকে এক চালকলের চাতালে আমরা উন্মুক্ত আকাশের নিচে শুয়ে রাত কাটিয়েছি। পাশ ফিরেই দেখি, উত্তরের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। বুঝলাম, আজও ঢাকা জ্বলছে। ঠিক যেমন জ্বলছিল ২৫ মার্চ রাতে। এখানে একটু ওই রাতের ধ্বংসযজ্ঞের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিই।
ওই রাতে রাজারবাগ আর পিলখানা ছাড়াও ওরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ঢাকার কয়েকটি বাজারে। ভস্মীভূত হয়েছিল ওইসব বাজার। ঠাটারিবাজারের অবস্থা তো আমি স্বচক্ষে দেখেছি, ২৯ তারিখে ঢাকা ত্যাগ করার আগে, সদরঘাটে যাওয়ার পথে। ওইসব বাজারের মধ্যে শুয়ে থাকা অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে ওই রাতে। আগুনে না পুড়লেও বাজার থেকে প্রাণ ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এলে পাকিস্তানিদের গুলির শিকার হয়েছে তারা। সদরঘাটের লঞ্চঘাটে যেসব যাত্রী ওই রাতে শুয়েছিল ভোরবেলা লঞ্চ ধরবে বলে, তাদেরও নির্বিচারে হত্যা করা হয়। তখন ভিক্টোরিয়া পার্কে একটি স্ট্যান্ড ছিল। সেখানে দাঁড়াত পুরনো বেশ কিছু ট্যাঙ্।ি ট্যাঙ্রি ড্রাইভাররা তাদের গাড়ির ভেতরেই সিটের ওপর ঘুমাত। তাদের সেখানেই হত্যা করা হয়। এ ছাড়া রিকশাওয়ালাকে রিকশায়, মুদি দোকানদারকে দোকানে, বস্তিবাসীদের বস্তির ভেতরে অবলীলায় হত্যা করা হয় ওই রাতে। সব বস্তি পুড়িয়ে ফেলা হয়। ওই রাতে খোলা আকাশের নিচে চালকলের চাতালের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি, পোড়ানোর আরো কোনো জায়গা তাহলে রয়ে গিয়েছিল বাকি? মনটা ভারী হয়ে আসে। তারপর কখন ক্লান্ত শরীর ঢলে পড়ে ঘুমে। ভোরের প্রথম আলো চোখে এসে পড়তেই আমরা সবাই হুড়মুড় করে জেগে উঠি। নৌকা আবার রওনা হয় গন্তব্যের পথে। গুড়, মুড়ি দিয়ে নাশ্্তা সারি আমরা। সামান্য কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘনা-বক্ষ থেকে লক্ষ করি, দুই পাড়ে চট্টগ্রামের রাস্তার ওপর মেঘনার ফেরিঘাট। সেখানে খাকি পোশাকে সৈন্যদের দেখা যায়। আমার বড় ভাইয়ের নির্দেশে আমরা সবাই নৌকার ছাউনির ভেতরে গুটিসুটি মেরে স্থান করে নিলাম। বলা যায় না, হয়তো আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে পারে। মাঝি নৌকা বেয়ে চলে। পথে কোনো বিপদ হয় না আর। আমরা বিকেল ৪টার দিকে মানিকনগর পেঁৗছি। এরপর হাঁটা। সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের গ্রামের পশ্চিমে ধান ক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে যখন হাঁটছি, তখন দূরে বিন্দুর মতো দুজন মানুষকে দেখতে পাই। আমার সবচেয়ে বড় জ্যাঠাতো ভাই, যাকে আমরা সেজদা ডাকতাম, তিনি এবং তাঁর সার্বক্ষণিক সহচর সুন্দর আলী সরদার দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। আমার সেজদার গায়ে জড়ানো সুতির চাদরটি মাটিতে লুটাচ্ছে। তিনি আমাদের কাছে এসে আমাদের আলিঙ্গন করলেন এবং বলতে লাগলেন যে আমি তো ভেবেছিলাম আমার পরিবারের সবাই ঢাকায় মারা পড়েছে। আমরা বাড়িতে পেঁৗছার পর হারিকেনের আলোয় সবাই আমাদের পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। আমাদের ঘিরে রতনপুরবাসী অনেকেই নানা রকম গল্প শুনতে চাইছে। সবারই মনে শঙ্কা। কেননা সবারই কেউ না কেউ রয়েছে ঢাকা শহরে। যদিও গ্রামের ত্রিসীমানার মধ্যে তখনো পাকিস্তানি আর্মি আসেনি, কিন্তু আসতে কতক্ষণ?
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments