সরকারের শেয়ার আছে, ঋণের বোঝাও বইছে, অথচ মিলের আর কোনো অস্তিত্ব নেই-সরকারি মিল বেসরকারি খাতে গিয়ে আবাসন প্লট by শুভংকর কর্মকার
একসময়ের সুতা বোনার জন্য বিখ্যাত রাজধানীর শ্যামপুরের চান্দ টেক্সটাইলের কর্মব্যস্ততা এখন আর নেই। নেই নাম-নিশানাও। জমি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সারি সারি প্লটে একের পর এক ভবন নির্মাণ করছেন বর্তমান মালিকেরা।
এভাবেই সরকারের শেয়ার থাকা সত্ত্বেও চান্দ টেক্সটাইলসহ ছয়টি টেক্সটাইল মিলের চরিত্র পরিবর্তন করা হয়েছে।
এভাবেই সরকারের শেয়ার থাকা সত্ত্বেও চান্দ টেক্সটাইলসহ ছয়টি টেক্সটাইল মিলের চরিত্র পরিবর্তন করা হয়েছে।
শর্ত ভঙ্গের মাধ্যমে কারখানা বন্ধ করে জমি বিক্রি করেছে মালিকপক্ষ। আবাসন প্রকল্প কিংবা গোডাউন ভাড়া দিয়ে অন্য ব্যবসায় নেমেছেন কেউ কেউ।
জানা গেছে, এ ধরনের ৩৫টি মিলে সরকারের শেয়ার থাকলেও বহু বছর ধরে তদারকি নেই। অনেক ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্য পর্যন্ত নেই। এসব কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু মিলগুলোর জন্য নেওয়া ব্যাংকঋণের বোঝা ঠিকই বয়ে বেড়াচ্ছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি)।
১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা ৭৪টি এবং পরবর্তীকালে সরকারের স্থাপিত ১২ মিলসহ বিভিন্ন সময়ে বিটিএমসির মালিকানায় ছিল ৮৬টি মিল। পরে সরকারের সিদ্ধান্তে ১৯৭৭-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে সাবেক বাংলাদেশি মালিকদের কাছে ৩৫টি মিল হস্তান্তর করে তৎকালীন শিল্প মন্ত্রণালয়। তবে পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় সরকার আবার দুটি মিল পুনঃ অধিগ্রহণ করে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন এসব মিলের ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। গত বছর সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিষয় উত্থাপন করেন। পরে গত জানুয়ারি ও চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদীয় কমিটি ছয়টি মিল পরিদর্শন করে। এ সময়েই মিলগুলোর পরিবর্তনসহ নানা ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত হয়।
বিটিএমসির চেয়ারম্যান মাহমুদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, হস্তান্তর চুক্তিতে ‘শিল্পকে শিল্প’ হিসেবেই রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। একই সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধেরও কথা ছিল মিলমালিকদের।
সরেজমিনে চান্দ টেক্সটাইল: গত বুধবার শ্যামপুরে গিয়ে চান্দ টেক্সটাইল মিলের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চারদিকে প্রাচীরঘেরা বিশাল লোহার ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে মিলের জায়গায় সারি সারি প্লট। সচল ও অচল অনেকগুলো ট্রাক এক পাশে রাখা। অন্য পাশে আটটি প্লটের একটিতে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া আরও দুটি তিনতলা বাড়ি নির্মাণাধীন।
কথা হয় মো. তোফাজ্জলের সঙ্গে। তিনি মিলের ভেতর টিনশেডের একটি বাড়িতে দুই বছর ধরে ভাড়া থাকেন। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘শুনেছি, এখানে একসময় সুতার মিল ছিল। তবে এখন আর কিছু নাই।’ তিনি বুলু মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন বলে জানান।
মূল ফটকের সামনে একাধিক দোকান মালিক ও পাশের এক মিলের কর্মচারী জানান, মিলের মালিকপক্ষ জুলহাস নামের এক ব্যক্তির কাছে মিলের জমি বিক্রি করে দেন। পরে জুলহাস আরও কয়েকজনের কাছে বিক্রি করে দেন।
ওই সময় মিলের মালিকপক্ষ কিংবা জমির বর্তমান মালিকদের সংশ্লিষ্ট কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে চান্দ টেক্সটাইলের পাশেই আছে একই মালিকপক্ষের আরেকটি মিল মোহাম্মদী কেলেন্ডারিং অ্যান্ড প্রিন্টিং মিলস। আর দুই মিলের মাঝে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে আরেকটি মিল মরিয়ম কটন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদী মিলের এক কর্মচারী বলেন, একসময় চান্দ টেক্সটাইলে সুতা বানানো হতো। সেই সুতা দিয়ে মরিয়মে কাপড় বুনে মোহাম্মদীতে মোড়কজাত করা হতো। তিনি জানান, বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সালেহ আহমেদ চান্দ টেক্সটাইল দেখাশোনা করেন। বছরের পর বছর লোকসান হওয়ায় তিনিই মিলের জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছেন।
তবে সালেহ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো তথ্য ওই কর্মচারী দিতে পারেননি। বিটিএমসির পরিদর্শক দলের সদস্যরাও মালিকদের খুঁজে পাননি।
বিটিএমসি জানায়, শ্যামপুরে ২১ বিঘা জমির ওপর ছিল চান্দ টেক্সটাইল। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মিলটির স্পিনিং ও উইভিং ইউনিট ২০০৩ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। ২০০৬ সালে মিলের ১১ দশমিক ৫০ বিঘা জমি বিক্রি করে দেয় মালিকপক্ষ। যদিও মিলটিতে সরকারের শেয়ারের পরিমাণ ২৭ হাজার ৮০, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
অস্তিত্বহীন আরও পাঁচ মিল: গত ৮ থেকে ১১ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি মিলগুলো পরিদর্শন করে সংসদীয় কমিটি। পরে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তৈরি করে বিটিএমসি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাভারের আফসার কটন মিলের ৬ দশমিক ১৯ একর জমির অধিকাংশই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তিন থেকে সাততলার বেশ কয়েকটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আফসার কটন মিল মসজিদ মার্কেট নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, শুধু এক একর জমির ওপর মিলটি বন্ধ অবস্থায় আছে। এতে ২৫টি মেশিনের মধ্যে বর্তমানে পাঁচটি আছে। ব্লো-রুম আছে কিন্তু অন্যান্য মেশিন নেই। মিলে সরকারের শেয়ারের পরিমাণ ৭৮ হাজার ৪০০, যা মোট শেয়ারের ৪৯ শতাংশ।
গাজীপুরের টঙ্গীর আশরাফ টেক্সটাইল মিলের দুটি ইউনিট ছিল। ১৯৮৩ সালে ৩ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হয় এবং অন্যান্য ইউনিটে নতুন যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) মাধ্যমে বাজারে এর শেয়ার ইস্যু করা হয়। এরপর পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর কারণে সরকারের শেয়ারের হার ১ শতাংশের নিচে নেমে যায়, যা আগে ছিল ২৪ শতাংশ।
বগুড়া কটন মিলের নয় একর জমির মধ্যে পাঁচ একর জমি ইতিমধ্যে মালিকপক্ষ বিক্রি করে দিয়েছে। বর্তমান জমির মালিক মিলটন হাজি বিভিন্ন প্লটে ভবনের নির্মাণ কাজ করছেন। মিল গেটে ভান্ডারী মেগাসিটি নামে বিশাল সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। বিটিএমসির তথ্য অনুযায়ী, বগুড়া কটন মিলে সরকারের এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৭০০ শেয়ার আছে, যা মোট শেয়ারের প্রায় ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
১৯৮৫ সালে হস্তান্তরকালে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের উত্তর কাট্টলীর ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলের জায়গা ছিল ১৮ দশমিক ১২ একর। পরে ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ জমি বিক্রি করে দেন সাবেক মালিক। মিলের বর্তমান মালিক চট্টগ্রাম সিটি মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলমও আট একর জমি বিক্রি করেছেন। বাকি জমিতে বর্তমানে কারখানার ভবন ও গোডাউন আছে। অবশ্য মন্জুর আলম প্রতিনিধিদের কাছে দাবি করেন, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিয়ে জমি বিক্রি করা হয়েছে।
কুমিল্লার কোটবাড়ীর হালিমা টেক্সটাইল মিলের জায়গায় আবাসন প্রকল্প করা হয়েছে। বিটিএমসির প্রধান হিসাবরক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোতালেব হোসেন বলেন, ঋণের দায়ে মিল পরিচালক আহমেদুল হক দেউলিয়া হন। পরে আদালতের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে মিলটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। বর্তমান রুহুল আহমেদ মিলের জায়গায় সারি সারি প্লট তৈরি করে বিক্রি করেছেন। এসব প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
তথ্য ও হিসাব নেই, তবু ঋণের বোঝা: বেশির ভাগ মিলের সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও আয়-ব্যয়ের হিসাব বিটিএমসির কাছে নেই। ওই সব মিলের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ, সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা নিযুক্ত পরিচালক কে, তারও কোনো তালিকা নেই। অভিযোগ আছে, এ-সংক্রান্ত অনেক নথিপত্রই ইতিমধ্যে গায়েব করে দিয়েছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
কোনো হিসাব বা তথ্য না থাকলেও কোটি কোটি টাকা ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে বিটিএমসি। ৩৫টি মিল থেকে বিটিএমসি ও সরকারের ৯৯৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পাওনা আছে। গত বছর খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলে এসব মিলের কিছু তথ্য পায় বিটিএমসি। এ পর্যন্ত ১৫টি মিলে সরকারের শেয়ারের পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। তবে বাকি ২০টি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।
চেয়ারম্যানের বক্তব্য: বিটিএমসির চেয়ারম্যান মাহমুদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পরিদর্শনের পর ছয় মিলের ব্যাপারে আরও তথ্য জানতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়াটি শেষ হলে সংসদীয় কমিটির কাছে তা উপস্থাপন করা হবে। তখন পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
ঋণের ব্যাপারে মাহমুদ উল আলম বলেন, মালিকেরা চুক্তি অনুযায়ী পরিশোধ না করায় বিটিএমসিকে ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে মিলমালিকদের ঋণ পরিশোধ করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে; অন্যথায় সরকার আবার তা ফেরত নিয়ে নেবে।
দীর্ঘদিন খোঁজখবর নেওয়া হয়নি কেন, এ প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, মিলগুলো হস্তান্তর করে শিল্প মন্ত্রণালয়। পরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেয়, এখন বিটিএমসি। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই অনেক তথ্য আর পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, এ ধরনের ৩৫টি মিলে সরকারের শেয়ার থাকলেও বহু বছর ধরে তদারকি নেই। অনেক ক্ষেত্রে বিস্তারিত তথ্য পর্যন্ত নেই। এসব কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু মিলগুলোর জন্য নেওয়া ব্যাংকঋণের বোঝা ঠিকই বয়ে বেড়াচ্ছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি)।
১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা ৭৪টি এবং পরবর্তীকালে সরকারের স্থাপিত ১২ মিলসহ বিভিন্ন সময়ে বিটিএমসির মালিকানায় ছিল ৮৬টি মিল। পরে সরকারের সিদ্ধান্তে ১৯৭৭-১৯৮৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে সাবেক বাংলাদেশি মালিকদের কাছে ৩৫টি মিল হস্তান্তর করে তৎকালীন শিল্প মন্ত্রণালয়। তবে পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় সরকার আবার দুটি মিল পুনঃ অধিগ্রহণ করে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন এসব মিলের ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। গত বছর সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যান ও পরিচালকেরা বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিষয় উত্থাপন করেন। পরে গত জানুয়ারি ও চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে সংসদীয় কমিটি ছয়টি মিল পরিদর্শন করে। এ সময়েই মিলগুলোর পরিবর্তনসহ নানা ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত হয়।
বিটিএমসির চেয়ারম্যান মাহমুদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, হস্তান্তর চুক্তিতে ‘শিল্পকে শিল্প’ হিসেবেই রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। একই সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধেরও কথা ছিল মিলমালিকদের।
সরেজমিনে চান্দ টেক্সটাইল: গত বুধবার শ্যামপুরে গিয়ে চান্দ টেক্সটাইল মিলের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। চারদিকে প্রাচীরঘেরা বিশাল লোহার ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে মিলের জায়গায় সারি সারি প্লট। সচল ও অচল অনেকগুলো ট্রাক এক পাশে রাখা। অন্য পাশে আটটি প্লটের একটিতে পাঁচতলা বাড়ি নির্মাণ শেষ পর্যায়ে। এ ছাড়া আরও দুটি তিনতলা বাড়ি নির্মাণাধীন।
কথা হয় মো. তোফাজ্জলের সঙ্গে। তিনি মিলের ভেতর টিনশেডের একটি বাড়িতে দুই বছর ধরে ভাড়া থাকেন। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘শুনেছি, এখানে একসময় সুতার মিল ছিল। তবে এখন আর কিছু নাই।’ তিনি বুলু মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকেন বলে জানান।
মূল ফটকের সামনে একাধিক দোকান মালিক ও পাশের এক মিলের কর্মচারী জানান, মিলের মালিকপক্ষ জুলহাস নামের এক ব্যক্তির কাছে মিলের জমি বিক্রি করে দেন। পরে জুলহাস আরও কয়েকজনের কাছে বিক্রি করে দেন।
ওই সময় মিলের মালিকপক্ষ কিংবা জমির বর্তমান মালিকদের সংশ্লিষ্ট কাউকেই পাওয়া যায়নি। তবে চান্দ টেক্সটাইলের পাশেই আছে একই মালিকপক্ষের আরেকটি মিল মোহাম্মদী কেলেন্ডারিং অ্যান্ড প্রিন্টিং মিলস। আর দুই মিলের মাঝে পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে আরেকটি মিল মরিয়ম কটন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোহাম্মদী মিলের এক কর্মচারী বলেন, একসময় চান্দ টেক্সটাইলে সুতা বানানো হতো। সেই সুতা দিয়ে মরিয়মে কাপড় বুনে মোহাম্মদীতে মোড়কজাত করা হতো। তিনি জানান, বর্তমানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সালেহ আহমেদ চান্দ টেক্সটাইল দেখাশোনা করেন। বছরের পর বছর লোকসান হওয়ায় তিনিই মিলের জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছেন।
তবে সালেহ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো তথ্য ওই কর্মচারী দিতে পারেননি। বিটিএমসির পরিদর্শক দলের সদস্যরাও মালিকদের খুঁজে পাননি।
বিটিএমসি জানায়, শ্যামপুরে ২১ বিঘা জমির ওপর ছিল চান্দ টেক্সটাইল। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত মিলটির স্পিনিং ও উইভিং ইউনিট ২০০৩ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। ২০০৬ সালে মিলের ১১ দশমিক ৫০ বিঘা জমি বিক্রি করে দেয় মালিকপক্ষ। যদিও মিলটিতে সরকারের শেয়ারের পরিমাণ ২৭ হাজার ৮০, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট শেয়ারের ৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
অস্তিত্বহীন আরও পাঁচ মিল: গত ৮ থেকে ১১ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি মিলগুলো পরিদর্শন করে সংসদীয় কমিটি। পরে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন তৈরি করে বিটিএমসি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাভারের আফসার কটন মিলের ৬ দশমিক ১৯ একর জমির অধিকাংশই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তিন থেকে সাততলার বেশ কয়েকটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আফসার কটন মিল মসজিদ মার্কেট নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, শুধু এক একর জমির ওপর মিলটি বন্ধ অবস্থায় আছে। এতে ২৫টি মেশিনের মধ্যে বর্তমানে পাঁচটি আছে। ব্লো-রুম আছে কিন্তু অন্যান্য মেশিন নেই। মিলে সরকারের শেয়ারের পরিমাণ ৭৮ হাজার ৪০০, যা মোট শেয়ারের ৪৯ শতাংশ।
গাজীপুরের টঙ্গীর আশরাফ টেক্সটাইল মিলের দুটি ইউনিট ছিল। ১৯৮৩ সালে ৩ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হয় এবং অন্যান্য ইউনিটে নতুন যন্ত্রাংশ সংযোজন করা হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) মাধ্যমে বাজারে এর শেয়ার ইস্যু করা হয়। এরপর পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর কারণে সরকারের শেয়ারের হার ১ শতাংশের নিচে নেমে যায়, যা আগে ছিল ২৪ শতাংশ।
বগুড়া কটন মিলের নয় একর জমির মধ্যে পাঁচ একর জমি ইতিমধ্যে মালিকপক্ষ বিক্রি করে দিয়েছে। বর্তমান জমির মালিক মিলটন হাজি বিভিন্ন প্লটে ভবনের নির্মাণ কাজ করছেন। মিল গেটে ভান্ডারী মেগাসিটি নামে বিশাল সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। বিটিএমসির তথ্য অনুযায়ী, বগুড়া কটন মিলে সরকারের এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৭০০ শেয়ার আছে, যা মোট শেয়ারের প্রায় ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
১৯৮৫ সালে হস্তান্তরকালে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের উত্তর কাট্টলীর ঈগল স্টার টেক্সটাইল মিলের জায়গা ছিল ১৮ দশমিক ১২ একর। পরে ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ জমি বিক্রি করে দেন সাবেক মালিক। মিলের বর্তমান মালিক চট্টগ্রাম সিটি মেয়র মোহাম্মদ মন্জুর আলমও আট একর জমি বিক্রি করেছেন। বাকি জমিতে বর্তমানে কারখানার ভবন ও গোডাউন আছে। অবশ্য মন্জুর আলম প্রতিনিধিদের কাছে দাবি করেন, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করে শেয়ারহোল্ডারদের অনুমোদন নিয়ে জমি বিক্রি করা হয়েছে।
কুমিল্লার কোটবাড়ীর হালিমা টেক্সটাইল মিলের জায়গায় আবাসন প্রকল্প করা হয়েছে। বিটিএমসির প্রধান হিসাবরক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোতালেব হোসেন বলেন, ঋণের দায়ে মিল পরিচালক আহমেদুল হক দেউলিয়া হন। পরে আদালতের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে মিলটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। বর্তমান রুহুল আহমেদ মিলের জায়গায় সারি সারি প্লট তৈরি করে বিক্রি করেছেন। এসব প্লটে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
তথ্য ও হিসাব নেই, তবু ঋণের বোঝা: বেশির ভাগ মিলের সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও আয়-ব্যয়ের হিসাব বিটিএমসির কাছে নেই। ওই সব মিলের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ, সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা নিযুক্ত পরিচালক কে, তারও কোনো তালিকা নেই। অভিযোগ আছে, এ-সংক্রান্ত অনেক নথিপত্রই ইতিমধ্যে গায়েব করে দিয়েছেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী।
কোনো হিসাব বা তথ্য না থাকলেও কোটি কোটি টাকা ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে বিটিএমসি। ৩৫টি মিল থেকে বিটিএমসি ও সরকারের ৯৯৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা পাওনা আছে। গত বছর খোঁজখবর নেওয়া শুরু করলে এসব মিলের কিছু তথ্য পায় বিটিএমসি। এ পর্যন্ত ১৫টি মিলে সরকারের শেয়ারের পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। তবে বাকি ২০টি সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।
চেয়ারম্যানের বক্তব্য: বিটিএমসির চেয়ারম্যান মাহমুদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পরিদর্শনের পর ছয় মিলের ব্যাপারে আরও তথ্য জানতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়াটি শেষ হলে সংসদীয় কমিটির কাছে তা উপস্থাপন করা হবে। তখন পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।
ঋণের ব্যাপারে মাহমুদ উল আলম বলেন, মালিকেরা চুক্তি অনুযায়ী পরিশোধ না করায় বিটিএমসিকে ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে মিলমালিকদের ঋণ পরিশোধ করতে চিঠি দেওয়া হয়েছে; অন্যথায় সরকার আবার তা ফেরত নিয়ে নেবে।
দীর্ঘদিন খোঁজখবর নেওয়া হয়নি কেন, এ প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, মিলগুলো হস্তান্তর করে শিল্প মন্ত্রণালয়। পরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেয়, এখন বিটিএমসি। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই অনেক তথ্য আর পাওয়া যায়নি।
No comments