‘ অচিন দেশে, অচিন কোনো গাঁয়’ by শাকুর মজিদ
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর। জীবদ্দশায় বাংলাদেশে হুমায়ূন আহমেদের শেষ জন্মদিনের এই রাতে ঘটনাক্রমেই আকাশে বড় একটা চাঁদ ছিল। ভরা পূর্ণিমা। সে রাতে হঠাৎ করে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের বলেছিলেন, ‘প্রতিটি ভরা পূর্ণিমা রাতে আমার খুব আশঙ্কা হয়, আমি কেন যে ওই গানটা লিখলাম। আমার মনে হয়, পাক-রাব্বুল আলামিন
আমার কথা কবুল করে ফেললে জ্যোৎস্না রাতেই আমার মৃত্যু হবে। আর এবার যেহেতু জন্মদিন আর জ্যোৎস্না রাত একই তারিখে, মনে হয়, আজ রাতটা পার করতে পারলে আরও কিছুদিন বাঁচা যাবে।’
সে যাত্রায় ওই রাত পার করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু তার কিছুদিন পর সিঙ্গাপুর হাসপাতালে শরীর পরীক্ষা করতে গিয়ে সর্বনাশা খবরটি নিয়ে এলেন বাংলাদেশে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই।
মৃত্যুর এত কাছাকাছি থাকা এই মানুষটি মৃত্যুকে এড়িয়ে থাকার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টার যা কিছু করা সম্ভব, তা করেছেন, কিন্তু মৃত্যুর আগে মৃত্যুভয়ে কাতর হননি তিনি। ক্যানসার যে কী পরিমাণ মরণব্যাধি, এটুকু হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে ভালো কজনই বা জানে!
সিঙ্গাপুর থেকে অসুখের খবর নিয়ে ঢাকায় আসার পর প্রথম দিকে তাঁর খুব চেষ্টা ছিল, যাতে এ খবর বেশি লোকের কানে না যায়। বিশেষ করে, সাংবাদিকেরা যাতে খবর না পান, এমন চেষ্টাই ছিল বেশি। তার পরও খবরটি রটে যায় এবং তাঁর বাড়িতে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। অযাচিত দর্শনার্থী দেখলে বিরক্ত হতেন। কেউ তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বের করলে মজা করে বলতেন, ‘আমি মরে যাব, এ জন্য ছবি তুলে রাখছ?’
মরে যাওয়ার চিন্তা তাঁর এসেই গিয়েছিল। বাদশাহ নামদার উপন্যাসের উৎসর্গপত্র লেখার সময় তাঁর মৃত্যুচিন্তার কথাটি পরিষ্কার এসে গেছে। হিসাব করলে বেরোতে পারে যে, চতুর্থ পর্যায়ে ধরা পড়া ক্যানসারের বীজটি হয়তো সে সময়ই তাঁর ভেতরে রোপণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরও শেষটুকু দেখতে চেয়েছিলেন।
নিউইয়র্কের হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের প্রধান ডা. মিলার তাঁকে নতুন জীবনের আশা দিয়েছিলেন। যে পর্যায়ে গিয়ে তাঁর অপারেশন হয়েছিল, সে পর্যায়ে শতকরা ৭০ জন ডাক্তারই সার্জারির সাহস পান না। এমন একটা পরিস্থিতির কথা জেনেও ডা. মিলারের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে তিনি হাজির হয়েছিলেন তাঁর কাছে। কিন্তু তাঁর ‘চন্দ্রকারিগর’, ‘দয়াময়, দয়ার সাগর’ তাঁর আকুতি রাখেননি, যে ‘চাননি পসর রাইতে’ তাঁর ‘যেন মরণ হয়’ বলে যে আকুতি তিনি জানিয়েছিলেন, তা আর কবুল হলো না। এর মধ্যে এক অচেনা ভাইরাস সবকিছু এলোমেলো করে দিল।
মৃত্যু নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেছেন। এই একই প্রশ্নের জবাব আমার উপস্থিতিতেই হয়তো আধঘণ্টার ব্যবধানে দুই সাংবাদিকের কাছে দুই রকম দিয়েছেন। তবে আস্তিক এই লেখক মৃত্যু-পরবর্তী তাঁর জীবন নিয়ে সংশয়বাদী ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে কোথায় কী হবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না তাঁর। অবলীলায় বলতেন, ‘আমি তো দেখতে পাব না, তাহলে কোথায় কী হলো তা নিয়ে আমার কী?’
এই মারাত্মক অসুখ কি তাঁর কোলনে ঠাঁই নেওয়ার অনেক আগেই লিখেছেন তাঁর ‘মৃত্যুসংগীত’। পরিষ্কার বলেছেন, ‘এখন খেলা থেমে গেছে, মুছে গেছে রং। অনেক দূরে বাজছে ঘণ্টা ঢং, ঢং, ঢং।’
প্রথমবার চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে (সেপ্টেম্বর ২০১১) নানা রকমের অদ্ভুত আচরণ করেছেন বন্ধুদের নিয়ে। একবার ঘোষণা দিলেন, যাওয়ার দুই দিন আগে তাঁর কুলখানি হবে। তিনি নিজের হাতে তাঁর বন্ধুদের খাওয়াতে চান। মৃত্যুর পরে কুলখানি কোথায় হবে, কে করবে, সব বন্ধুবান্ধব সেখানে দাওয়াত পাবে কি না সে ঝুঁকি তিনি নিতে চান না। শুধু আগাম কুলখানি নয়, আগাম শোকসভাও ডাকতে চেয়েছিলেন তাঁর দখিন হাওয়ার বাসায়। মিলন ভাই (ইমদাদুল হক মিলন) কী বক্তৃতা দেবেন, সেটাও তিনি অভিনয় করে দেখালেন।
হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত কষ্ট সবচেয়ে বেশি ছিল তাঁর পরিবারকে নিয়ে। দুঃসময়ে আপন সন্তানদের কাছে আসার প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রথম দফায় যে রাতে নিউইয়র্ক যাবেন, সে রাতে ১০টার দিকে নুহাশ এসেছিল বাবাকে বিদায় দিতে। ড্রইংরুম ভর্তি ২০-২৫ জন আত্মীয়স্বজন-অনুরাগী পরিবেষ্টিত হুমায়ূন আহমেদ পরম মমতায় নুহাশকে ডেকে এনে তাঁর কাছের চেয়ারে বসান। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমার মনে হয়, এটাই ছিল নুহাশের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা। এরপর ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর তাঁর ৬৩তম জন্মদিনে মাজহারের বাসায় স্কাইপিতে সংযোগ হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। দাদু ও ফুপির সঙ্গে নুহাশ এসেছিল স্কাইপিতে সবার সঙ্গে কথা বলতে। নুহাশ বাবার চুল ছাড়া মাথা এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়, কান্নায় ভেঙে পড়ে। পরে বাবার সঙ্গে তার কথাও হয়। বাবা জানতে চান, তার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, এসব।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হুমায়ূনকে তাঁর অবস্থান নির্ণয় করে দিয়েছে। সারা জাতি যে মানুষটির জন্য হাহাকারে লিপ্ত, সেখানে তাঁর নিজ পরিবারের কাছে তিনি বিভক্ত।
হুমায়ূন আহমেদ এক পরিপূর্ণ মানবের নাম। জগতে যা কিছুই তিনি চেয়েছেন, কোনো কিছু থেকেই তিনি বঞ্চিত হননি। চরম দারিদ্র্য থেকে পরম ঐশ্বর্য—সবই তাঁর ভাগ্যে জুটেছে। এখন তাঁর যাত্রা সেই চন্দ্রকারিগরের কাছে। তাঁর নিজের কথায়, ‘এখন যাব অচিন দেশে, অচিন কোনো গাঁয়। চন্দ্রকারিগরের কাছে ধবল পঙ্খী নায়।’
জাতি আজ তাঁকে ‘ধবল পঙ্খী’ নায়ে পাঠিয়ে দেবে তাঁর সেই ‘চন্দ্রকারিগর’-এর কাছে। সেখানে তিনি কেবলই একজন। কে তাঁকে কোথায় বিভক্ত করে রাখল, তার কিছুতেই কিছুই যায়-আসে না।
সে যাত্রায় ওই রাত পার করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু তার কিছুদিন পর সিঙ্গাপুর হাসপাতালে শরীর পরীক্ষা করতে গিয়ে সর্বনাশা খবরটি নিয়ে এলেন বাংলাদেশে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই।
মৃত্যুর এত কাছাকাছি থাকা এই মানুষটি মৃত্যুকে এড়িয়ে থাকার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টার যা কিছু করা সম্ভব, তা করেছেন, কিন্তু মৃত্যুর আগে মৃত্যুভয়ে কাতর হননি তিনি। ক্যানসার যে কী পরিমাণ মরণব্যাধি, এটুকু হুমায়ূন আহমেদের চেয়ে ভালো কজনই বা জানে!
সিঙ্গাপুর থেকে অসুখের খবর নিয়ে ঢাকায় আসার পর প্রথম দিকে তাঁর খুব চেষ্টা ছিল, যাতে এ খবর বেশি লোকের কানে না যায়। বিশেষ করে, সাংবাদিকেরা যাতে খবর না পান, এমন চেষ্টাই ছিল বেশি। তার পরও খবরটি রটে যায় এবং তাঁর বাড়িতে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। অযাচিত দর্শনার্থী দেখলে বিরক্ত হতেন। কেউ তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা বের করলে মজা করে বলতেন, ‘আমি মরে যাব, এ জন্য ছবি তুলে রাখছ?’
মরে যাওয়ার চিন্তা তাঁর এসেই গিয়েছিল। বাদশাহ নামদার উপন্যাসের উৎসর্গপত্র লেখার সময় তাঁর মৃত্যুচিন্তার কথাটি পরিষ্কার এসে গেছে। হিসাব করলে বেরোতে পারে যে, চতুর্থ পর্যায়ে ধরা পড়া ক্যানসারের বীজটি হয়তো সে সময়ই তাঁর ভেতরে রোপণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরও শেষটুকু দেখতে চেয়েছিলেন।
নিউইয়র্কের হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের প্রধান ডা. মিলার তাঁকে নতুন জীবনের আশা দিয়েছিলেন। যে পর্যায়ে গিয়ে তাঁর অপারেশন হয়েছিল, সে পর্যায়ে শতকরা ৭০ জন ডাক্তারই সার্জারির সাহস পান না। এমন একটা পরিস্থিতির কথা জেনেও ডা. মিলারের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে তিনি হাজির হয়েছিলেন তাঁর কাছে। কিন্তু তাঁর ‘চন্দ্রকারিগর’, ‘দয়াময়, দয়ার সাগর’ তাঁর আকুতি রাখেননি, যে ‘চাননি পসর রাইতে’ তাঁর ‘যেন মরণ হয়’ বলে যে আকুতি তিনি জানিয়েছিলেন, তা আর কবুল হলো না। এর মধ্যে এক অচেনা ভাইরাস সবকিছু এলোমেলো করে দিল।
মৃত্যু নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কথা বলেছেন। এই একই প্রশ্নের জবাব আমার উপস্থিতিতেই হয়তো আধঘণ্টার ব্যবধানে দুই সাংবাদিকের কাছে দুই রকম দিয়েছেন। তবে আস্তিক এই লেখক মৃত্যু-পরবর্তী তাঁর জীবন নিয়ে সংশয়বাদী ছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে কোথায় কী হবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না তাঁর। অবলীলায় বলতেন, ‘আমি তো দেখতে পাব না, তাহলে কোথায় কী হলো তা নিয়ে আমার কী?’
এই মারাত্মক অসুখ কি তাঁর কোলনে ঠাঁই নেওয়ার অনেক আগেই লিখেছেন তাঁর ‘মৃত্যুসংগীত’। পরিষ্কার বলেছেন, ‘এখন খেলা থেমে গেছে, মুছে গেছে রং। অনেক দূরে বাজছে ঘণ্টা ঢং, ঢং, ঢং।’
প্রথমবার চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্ক যাওয়ার আগে (সেপ্টেম্বর ২০১১) নানা রকমের অদ্ভুত আচরণ করেছেন বন্ধুদের নিয়ে। একবার ঘোষণা দিলেন, যাওয়ার দুই দিন আগে তাঁর কুলখানি হবে। তিনি নিজের হাতে তাঁর বন্ধুদের খাওয়াতে চান। মৃত্যুর পরে কুলখানি কোথায় হবে, কে করবে, সব বন্ধুবান্ধব সেখানে দাওয়াত পাবে কি না সে ঝুঁকি তিনি নিতে চান না। শুধু আগাম কুলখানি নয়, আগাম শোকসভাও ডাকতে চেয়েছিলেন তাঁর দখিন হাওয়ার বাসায়। মিলন ভাই (ইমদাদুল হক মিলন) কী বক্তৃতা দেবেন, সেটাও তিনি অভিনয় করে দেখালেন।
হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত কষ্ট সবচেয়ে বেশি ছিল তাঁর পরিবারকে নিয়ে। দুঃসময়ে আপন সন্তানদের কাছে আসার প্রত্যাশা করেছিলেন। প্রথম দফায় যে রাতে নিউইয়র্ক যাবেন, সে রাতে ১০টার দিকে নুহাশ এসেছিল বাবাকে বিদায় দিতে। ড্রইংরুম ভর্তি ২০-২৫ জন আত্মীয়স্বজন-অনুরাগী পরিবেষ্টিত হুমায়ূন আহমেদ পরম মমতায় নুহাশকে ডেকে এনে তাঁর কাছের চেয়ারে বসান। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমার মনে হয়, এটাই ছিল নুহাশের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা। এরপর ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর তাঁর ৬৩তম জন্মদিনে মাজহারের বাসায় স্কাইপিতে সংযোগ হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। দাদু ও ফুপির সঙ্গে নুহাশ এসেছিল স্কাইপিতে সবার সঙ্গে কথা বলতে। নুহাশ বাবার চুল ছাড়া মাথা এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়, কান্নায় ভেঙে পড়ে। পরে বাবার সঙ্গে তার কথাও হয়। বাবা জানতে চান, তার পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, এসব।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু হুমায়ূনকে তাঁর অবস্থান নির্ণয় করে দিয়েছে। সারা জাতি যে মানুষটির জন্য হাহাকারে লিপ্ত, সেখানে তাঁর নিজ পরিবারের কাছে তিনি বিভক্ত।
হুমায়ূন আহমেদ এক পরিপূর্ণ মানবের নাম। জগতে যা কিছুই তিনি চেয়েছেন, কোনো কিছু থেকেই তিনি বঞ্চিত হননি। চরম দারিদ্র্য থেকে পরম ঐশ্বর্য—সবই তাঁর ভাগ্যে জুটেছে। এখন তাঁর যাত্রা সেই চন্দ্রকারিগরের কাছে। তাঁর নিজের কথায়, ‘এখন যাব অচিন দেশে, অচিন কোনো গাঁয়। চন্দ্রকারিগরের কাছে ধবল পঙ্খী নায়।’
জাতি আজ তাঁকে ‘ধবল পঙ্খী’ নায়ে পাঠিয়ে দেবে তাঁর সেই ‘চন্দ্রকারিগর’-এর কাছে। সেখানে তিনি কেবলই একজন। কে তাঁকে কোথায় বিভক্ত করে রাখল, তার কিছুতেই কিছুই যায়-আসে না।
No comments